Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

তাদের স্মরণে

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তাদের স্মরণে

শেখ আবদুল হাকিম

আহমেদ বাসার

থ্রিলার ও রহস্যোপন্যাস কথাসাহিত্যের একটি অন্যতম জনপ্রিয় শাখা। বিশ্বসাহিত্যের বেস্টসেলার বইগুলোর দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জেমস রোলিন্সের দ্য আই অফ গড, সিডনি শেলডনের দ্য নেকেড ফেইস, ড্যান ব্রাউনের দ্য দা ভিঞ্চি কোড, দ্য লস্ট সিম্বল, ইনফার্নো, থমাস হ্যারিসের সাইলেন্স অফ দা ল্যাম্বস প্রভৃতি গ্রন্থের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। এ ধারার উপন্যাসগুলো পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার ক্ষমতা রাখে। বাংলা সাহিত্যেও থ্রিলার ও রহস্যোপন্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আর এ ক্ষেত্রে যার নামটি উজ্জ্বল হয়ে আছে তিনি শেখ আবদুল হাকিম। মূলত গোস্ট রাইটার হিসাবে তিনি সৃজনশক্তির একটি বড় অংশ ব্যয় করেছেন। মাত্র বিশ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত হন। ষাটের দশকে ‘কুয়াশা’র দশম কিস্তি দিয়ে ‘সেবা’র সঙ্গে তার দীর্ঘযাত্রার সূচনা। প্রথম উপন্যাস ‘অপরিণত প্রেম’ লিখে তিনি কথাসাহিত্যিক কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন। দেশভাগের পটভূমিতে লেখা অসাধারণ উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি পড়ে কাজী আনোয়ার হোসেন মুগ্ধ হন। ১৯৬৮ সালে সেবা প্রকাশনী থেকে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য ও যৌনতার ‘বাড়াবাড়ির’ অভিযোগে বইটি প্রকাশের পর কিছুদিন নিষিদ্ধ থাকে। পরে অবশ্য আবার প্রকাশিত হয়েছিল। জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন হলেও এ সিরিজের বেশ কিছু বইয়ের নেপথ্য লেখক হিসাবে তিনি কাজ করেছেন। রহস্য পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন সুদীর্ঘকাল।

শেখ আবদুল হাকিমের প্রতিভার স্ফূর্তি ঘটেছিল মূলত বিশ্বসাহিত্যের সাড়া জাগানো থ্রিলার ও রহস্যোপন্যাসের অনুবাদকর্মের মধ্য দিয়ে। তার অনূদিত মারিয়ো পুজোর গডফাদার আশির দশকে পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিল। শেখ আবদুল হাকিম রহস্যোপন্যাস ও থ্রিলারকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। উপন্যাসের এ বিশেষ ধারাটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কাজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে তিনি বিষয় উপযোগী ভাষাভঙ্গি নির্মাণে দারুণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। অভিনব ও অভাবিতপূর্ব বিষয় বেছে নিয়ে তিনি সরস ও অনন্য ভাষায় নির্মাণ করেছেন রোমাঞ্চকর সব সৃষ্টিকর্ম, যা পাঠককে চুম্বকের মতো প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। টান টান ভাষার জাদুই পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টেনে রাখতে সক্ষম।

তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে সাইন্স ফিকশন : সোনালি পোকা, ঋজু সিলেটির প্রণয়, স্মৃতিচোর; তিনটি উপন্যাসিকার সংকলন ‘মানুষ মারার কল’, থ্রিলার : হয় আমি থাকব, নয়তো ভূত, এ ভূতটা ভাইরাস, সাগর বিভীষিকা, ভূততাড়ুয়া, এর জন্য মানুষ কাঁদে; রোমাঞ্চ উপন্যাস : অধরা কুমারী প্রভৃতি। তার অনূদিত জনপ্রিয় কিছু বই-ড্যান ব্রাউনের এঞ্জেলস্ অ্যান্ড ডেমনস্, দি লস্ট সিম্বল, ইনফার্নো, মার্ক টোয়েনের পুড্ন্হেড উইলসন, দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব হাকলবেরি ফিন, জুল ভার্নের আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ, এরিক মারিয়া রেমার্কের দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক, নাইজেল ওয়াটসের দ্য ওয়ে অভ লাভ, কোজি সুজুকির লূপ, স্টিফেন কিংয়ের কুজো, ল্যারি কিংয়ের সবই শুদ্ধ, জোনাথন নাশার হোয়েন শি ওয়াজ ব্যাড অবলম্বনে মেয়েটা যখন খারাপ ছিল, ভিক্টর হুগোর দ্যা ম্যান হু লাফস, মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন প্রভৃতি।

‘মাসুদ রানা’ সিরিজের আদলে তিনি ‘জ্যাকি আজাদ’ নামে আরেকটি গোয়েন্দা সিরিজ লেখার চেষ্টা করেন। এগুলো ভিন্ন একটি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। এ সিরিজের বইগুলোর মধ্যে জিপসি জাদু, বিপদ ভয়ংকর, ওস্তাদ সাবধান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এ সিরিজের বইগুলো কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জন করতে পারেনি।

১৯৪৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় জন্ম নেওয়া এ রোমাঞ্চ রূপকার দেশভাগের অব্যবহিত পরই ঢাকায় পা রাখেন। পঁচাত্তর বছরের ঝঞ্ঝামুখর জীবনে স্বনামে বেনামে সৃষ্টি করে গেছেন অসামান্য সব রহস্যোপাখ্যান। রোমাঞ্চ ও থ্রিলারপ্রিয় পাঠকদের হৃদয়ে শেখ আবদুল হাকিম স্থায়ী একটি আসন দখন করেত পেরেছেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

বুলবুল চৌধুরী

আতা সরকার

‘রঘু বংশীয় বাংলা ঘরে/ মধ্যরাতে পিদিম জ্বলে/ রঘু বংশীয় বাড়ির ধারে/ নদী আছে, নৌকা আছে/ বংশীয় এক রূপসী মেয়ে/ সেই নদীতে গোসল করে।/ যদি বলি বংশী শোন,/ তোমার মেয়ে রূপ বিলোবে?/ বংশী বলে অর্থ পেলে,/ কেঁদে কেঁদে বাঁচতে পারি।’ [কথাশিল্পীদের রচিত কবিতা : বাবুল মোশাররফ সম্পাদিত; প্রকাশকাল : ঢাকা, নভেম্বর, ১৯৮২]

কবিতাটি বুলবুল চৌধুরীর। একজন কথাসাহিত্যিকের। কবিতায় যেন এক পরিপূর্ণ ও নিটোল গল্প বেরিয়ে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে কবিতার সার্থক রূপকল্পের আবহও সৃষ্টি হয়েছে। আবার তিনি যখন তার গল্প বা উপন্যাস লিখতে বসেন, তখন তার গদ্য থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে কবিতার পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি। বুলবুল চৌধুরী এমনই। গদ্যময়। কাব্যময়। কথাময়।

এভাবেই তিনি জীবনকে দেখেন, জীবন সংগ্রামকেও।

‘প্রাকৃত’ শিরোনামের এ কবিতাটিতেই আমরা বুলবুল চৌধুরীর লেখালেখির উপকরণ সম্পর্কে একটা ধারণা অর্জন করতে পারি। তিনি কালাতিকাল পেরিয়ে এক আবহমান ব্যস্ত রূপকল্প চিত্রিত করেছেন, যেখানে নদী নৌকা øানসহ জাগ্রত প্রকৃতিতে বাংলার সৌন্দর্যের প্রতীকরূপে রূপসী নারীকে প্রতিস্থাপিত করেছেন, যো লোভাতুরের দৃষ্টিকবলিত হয়। বাংলার চিরন্তন জীবনসংগ্রাম মানেই যেন কেঁদে কেঁদে বাঁচা। এ জীবন বারবার ফিরে এসেছে বুলবুল চৌধুরীর লেখায়।

কবি সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ বুলবুল চৌধুরীর লেখায় তার রূপকল্পের অনুসন্ধান করেছেন: ‘খোলা চোখে দেখেছেন প্রবহমান জীবনকে, মানুষ ও মানুষীকে, ধাবমান নদী আর আঁধার-করে আসা বৃষ্টিধারাকে। তার গল্পে ‘জলে, মাটিতে, গাছে সব একাকার।’ চরিত্রের একেবারে ভেতর মহলে ঢুকে পড়েন তিনি। তাই তার সংলাপ আর তার বর্ণনার মধ্যে ভেদচিহ্ন লুপ্ত হয়ে যায়।

বুলবুল চৌধুরীর লেখার, বিশেষ করে গল্পের চরিত্র, ক্ষেত্রভূমি ও পটরেখাও চিহ্নিত করার প্রয়াস পান আবদু মান্নান সৈয়দ : ‘জীবন ও শিল্পের বিচিত্র বিশাল অভিজ্ঞতা তাকে সমৃদ্ধ করেছে দিন-দিন। বুলবুল চৌধুরীর অপার আগ্রহ মানুষে- বিচিত্র মানুষে। প্রায় সব সময় সে-মানুষ নাগরিক নয়- গ্রামীণ মানুষ। গ্রামীণ অভিজ্ঞতাই বুলবুল চৌধুরীর প্রধান অবলম্বন। ...তবু গ্রামজীবনে কোথাও একটি আবহমানতা আছে। বুলবুল চৌধুরীর ছোটগল্পে গ্রাম তার সেই আশ্চর্য বিস্ময় চিরন্তনত্ব আর সদ্য নতুনত্ব নিয়ে জেগে উঠেছে আবার। মানুষ-মানুষীর প্রেম ব্যস্ত অন্নকষ্ট খুন ভালোবাসা এবং নিসর্গের বৃষ্টি উদ্ভিদ খেতখামার বাঁশঝাড় নদী- বুলবুল চৌধুরীর ছোটগল্পে এমন সপ্রাণ সজীবতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে সাম্প্রতিকালে যার কোনো তুলনা মেলে না।’

বুলবুল চৌধুরীর জন্ম (১৪ আগস্ট, ১৯৪৮, দক্ষিণবাগ, ঢাকা) ও পৈতৃক নিবাস ঢাকা জেলায়, লেখাপড়া ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজে, বসবাস পুরনা ঢাকায় (পূর্ণ ব্যানার্জি লেন), কর্মস্থল সংবাদপত্রে, লেখালেখিতে। নানা সুবাদে সময়ের পর সময় কেটেছে বাংলাবাজারের বইপাড়ায়। পেশায়, সখে, নেশায়, ভালোবাসায় অভিজ্ঞতার ভান্ডার পরিপূর্ণ হয়েছে। তিনি একাধারে যেমন অভিজাত ম্যাগাজিন ও পত্রিকায় লিখেছেন, পর্নো পত্রিকায় লিখতে দ্বিধা করেননি। যখন যা লিখছেন, সবই তো বুলবুল চৌধুরীরই লেখা।

যেখানে যে অবস্থায় যেমনই থাকুন, লিখেছেন দু’হাতে, লেখনিতে উজাড় করে দিয়েছেন অভিজ্ঞতার ভান্ডার, আন্তরিক দরদ নিয়ে চিত্রশিল্পীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে লেখায় সুনিপুণ এঁকেছেন মানুষের মুখ, তাদের জীবন সংগ্রাম ও অন্তর্জগৎসহ। সেই মানুষদেরই প্রতিস্থাপিত করেছেন সৌম্য শান্ত প্রকৃতিতে, আবার এ প্রকৃতিই মানুষের হাহাকারা বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সেখান থেকেই বুলবুল চৌধুরী শুষে আনেন জীবনের রং। তাসের কাচ্চু খলার গভীরে প্রতিনিয়ত জীবনকেই বাজি রাখেন। কলকের দীর্ঘ দমে সম্মোহিত ঢুকে যান যোগ-সাধকের ঘোর-বলয়ে, সমগ্রহ করে আনেন অন্তর্জগতের রসদ।

গত শতকের সত্তরের দশকে বুলবুল চৌধুরীর উত্থান। তখন এ দেশের পোড়ামাটির উত্তাপে হাওয়ায় বারুদের গন্ধ, কেউ বলে ঘ্রাণ। টগবগে তরুণ কথাকার, কবিরা তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে টগবগে। স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ বোধ প্রবলতর। সে সময়কার গল্প-কবিতায় তারই উত্তাপ।

এরপরও তো আশাবাদী কৃষক পোড়ামাটিতেই লাঙল চালায়। উঠে আসে সোঁদা মাটি। ফসল ফলায়। হাসি-দুঃখ সুখ-কান্না জড়াজড়ি করে চলে জীবন। জীবনের পর জীবন। মাটির এ সোঁদা গন্ধ আর ফসলের ঘ্রাণ নিয়ে কথাসাহিত্যে, বিশেষ করে ছোটগল্পে পা রাখেন বুলবুল চৌধুরী। আর তখনই গল্প জগতের উঁচু স্থানটিতে তার আসন হয়ে যায়।

আমৃত্যু তার এ লেখালেখি। জীবনের গভীর গল্প।

আতাউর রহমান

হাসান হাফিজ

বাংলাসাহিত্যে রম্যলেখার ধারাস্রোত বরাবরই ক্ষীণ। এমনিতেই গদ্য রচনা ভীষণ পরিশ্রমের কাজ। ব্যঙ্গ কৌতুক রস শিল্পিত নান্দনিকতায় উপস্থাপন করার কাজটি অধিকতর কঠিন। লোক হাসানোর কর্ম সবার দ্বারা হয় না। লেখকের সে রকম রসবোধ, ভাষার ওপর দখল, ব্যাপক পড়াশোনা, পরিবেশনার মুনশিয়ানা ইত্যাকার নানা গুণ থাকতে হয়। পরশুরাম, সৈয়দ মুজতবা আলী, শিবরাম চক্রবর্তী এমনি আরও বেশ কিছু নমস্য লেখক আছেন, যাদের কথা আমরা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি। বাংলাদেশের হালফিল সাহিত্যে এ ধারায় কম লেখকই মনোনিবেশ করছেন। বিশিষ্ট রম্যলেখক আতাউর রহমানকে আমরা হারালাম সম্প্রতি। গত ২৮ আগস্ট তিনি ইন্তেকাল করেন ৭৯ বছর বয়সে। ভুগছিলেন করোনায়। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ২৪।

জন্ম   তার সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায়, ১৯৪২ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করার পর সিলেটের মদনমোহন কলেজ ও এমসি কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরে তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সিএসপি অফিসার হিসাবে চাকরিতে যোগ দেন। চাকরি জীবনে তিনি লন্ডন ও রিয়াদের বাংলাদেশ মিশনে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মহাপরিচালক হিসাবে অবসর নেন তিনি। শেষ জীবনে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তার রম্যলেখা দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। ব্যক্তি মানুষ হিসাবেও তিনি ছিলেন সুরসিক, আড্ডাপ্রিয়, অমায়িক, পরোপকারী। মৃদু পরিচয়ের সুবাদে সেই পরিচয় আমিও পেয়েছি যৎকিঞ্চিৎ। ব্যাপক পঠন পাঠন ও পাণ্ডিত্য ছিল তার, কিন্তু তজ্জনিত দম্ভ ছিল না মোটেও।

স্মরণ করতে গিয়ে তার লেখার শরণ নেওয়াই এক্ষণে উত্তম। গল্পচ্ছলে কঠিন কঠিন কথা তিনি বলতেন, যা সমাজ ও দেশের কল্যাণচিন্তারই প্রতিফলন। সহজ সুললিত ভাষায়, ‘চটি গল্পের’ মোড়কে সহজ ব্যাখ্যায় ছিল এসব স্বাদু পরিবেশনা। দেশ বিদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-আচার, তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে আশ্চর্য নৈপুণ্যে তুলে ধরতে সমর্থ ছিলেন। ‘দুই দুগুণে পাঁচ’ আতাউর রহমানের বিখ্যাত রম্যকলাম, যা বেরোত প্রথম আলো পত্রিকায়। দুর্ভাগ্য ও লজ্জার বিষয়, জীবদ্দশায় তিনি যথাযথ স্বীকৃতি সম্মাননা, পুরস্কার পাননি। ‘ছাগল বৃত্তান্তু’ তার একটি লেখার শিরোনাম। সেখানে তিনি লিখছেন, “ছাগল একটি নিরীহ প্রাণী। তা গল্প আছে, একজন অতি আধুনিকা মা তার শিশুপুত্রকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্লে গ্র“পে ভর্তি করে দিয়ে এসেছেন। ক্লাসটিচার শিশুটিকে যতই জিজ্ঞেস করেন তার পিতার নাম কী, সে উত্তর দেয় ‘ড্যাডি’। অবশেষে মরিয়া হয়ে টিচার ‘তোমার মা তোমার বাবাকে কী বলে ডাকেন’, জিজ্ঞেস করতেই সে ঝটপট জবাব দিল,‘ছাগল’। গল্পটির মধ্যে যথেষ্ট হাসির খোরাক থাকলেও একটা নির্মম সত্যও আছে বটে। জগৎ সংসারে এমন কিছু লোক আছেন, যাঁরা এতটাই নিরীহ প্রকৃতির যে তাদের আপনজন তাদের স্নেহবশত ‘ছাগল’ আর স্নেহের আধিক্য হলে ‘রামছাগল’ বলে অভিহিত করতে কার্পণ্য করেন না।”

লেখায় যে হুল, খোঁচা আছে, তা সহজেই বোধগম্য ও প্রমাণিত হলো। ব্যক্তি পর্যায়েই না, সমাজ রাষ্ট্রের প্রসঙ্গও ব্যঙ্গের চাবুকে জর্জরিত ঝাঁঝরা হয়েছে কোনো কোনো স্থানে। একই শিরোনামের লেখায় ভিন একটি প্রসঙ্গ। আতাউর রহমান লিখেছেন, খুশবন্ত সিংয়ের লেখায় পড়েছিলাম-ইন্ডিয়ার একটি ডাকবাংলোর পরিদর্শন বইয়ে পিডব্লিউডির ইঞ্জিনিয়ার লিখেছিলেন ‘ডাকবাংলোর চতুর্দিকে বেড়া দেওয়া দরকার। বেড়া না থাকায় বারান্দায় রাখা পূর্ব কাজের প্রাক্কলনের অর্ধেক আমার কয়েক মিনিটের অনুপস্থিতিতে ছাগলে খেয়ে ফেলেছে।’ সেটার নিচে আরেকজন লিখেছেন, ‘পিডব্লিউডির প্রাক্কলনগুলোর গুণগত মান এমনই যে ছাগলও পুরোটা খেতে অনীহা প্রকাশ করেছে।’

বিভিন্ন দেশের রঙ্গ কাহিনির সরেস বয়ান তিনি পাঠকসমীপে উপস্থাপন করেছেন। তার ভাষা সাবলীল। দারুণ কথক তিনি। নিষ্ঠুর অনেক কথা অবলীলায় বলে ফেলতে পারেন। রসের কথা সবাই রসিয়ে কইতে পারেন না। আতাউর রহমান ছিলেন সেই দুর্লভ গুণের অধিকারী। রম্যলেখা সম্পর্কে তার নিজের মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে এ লেখার ইতি টানি। তিনি বলেছেন, ‘রসগল্প কেবল হাসির খোরাকই জোগায় না, বিভিন্ন দেশ ও জাতির আচার-আচরণ, দেশপ্রেমের নিদর্শন, জাত্যাভিমান, অহংবোধ, নির্বুদ্ধিতা, চাটুকারিতা, পরশ্রীকাতরতা, কৃপণতা, কূটবুদ্ধি, যৌনজীবন ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক তথ্যও প্রদান করে।’

সাহিত্য উপন্যাস স্মরণ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম