এক সুতা জমি
সাদিকুল নিয়োগী পন্নী
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রামপুরা টেলিভিশন ভবনের পাশে যাত্রীছাউনি। সেখানে একজনকে প্রায়ই দেখা যায়। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। পরনে ছেঁড়া পুরোনো ময়লাযুক্ত প্যান্ট-শার্ট। নিয়মিত গোঁফ না কাটায় ঠোঁট দুটো ঠিকমতো দেখা যায় না। অগোছালো দাড়িতে ময়লা লেগে থাকে সব সময়। এলাকায় সবার কাছে তিনি পাগল। গত কয়েক মাসে তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। সেদিন রাতে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু। যাত্রীছাউনিতে আশ্রয় নিলাম। লোকটি তখন যাত্রীছাউনির নিচে শুয়ে আছেন। পুরোনো কাপড়-চোপড়ের পুঁটলিকে বালিশ বানিয়ে বাম পায়ের ওপর ডান পা রেখে শুয়ে আছেন রাজকীয় ভঙ্গিতে। বাম হাত মাথার নিচে গুটিয়ে রেখে ডান হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে সিগারেট চেপে চোখ বন্ধ করে মনের সুখে টেনে যাচ্ছেন। আমার উপস্থিতি তার ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। রাত বেশি হওয়ায় তখন যাত্রীছাউনিতে আমি ছাড়া কেউ ছিল না। আমার কাছে লোকটিকে কেন যেন পাগল মনে হয়নি। তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমার অনেক দিন থেকে। লোকটির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই দিয়াশলাই হবে?
আমার কথা শুনে তিনি চোখ খুলে বললেন, সিগারেট থেকে নিলে নিতে পারেন। আমি কিন্তু পাগল। হা হা হা।
কিছুটা ভয় ও সংকোচে আমি তার হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেট নিলাম। তারপর আমার সিগারেট ধরিয়ে তা ফেরত দিলাম। লোকটি তখন বললেন, ভাইজান আগুন খুব খারাপ জিনিস। একটু প্রশ্রয় পেলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
বাহ্। আপনি তো দারুণ কথা জানেন। আমি বললাম।
সত্য কথাই বললাম ভাইজান। কতক্ষণ আগে আপনার মতো আমিও একজনের সিগারেট থেকে আগুন নিলাম। সে আগুনে আমার ফুসফুস জ্বলতেছে। এখন আপনারটা। আপনি আরেকজনকে দিলে তারটাও জ্বলবে। সুযোগ পেলে এভাবে আগুন গোটা দুনিয়া জ্বালিয়ে দেবে। হা হা হা...
আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার বেশ ভালো লাগছে। যদি কিছু মনে না করেন একটু বসতে চাচ্ছিলাম।
শোয়া থেকে উঠে বসলেন তিনি। ছালার চটের বিছানা হাত দিয়ে পরিষ্কার করে তিনি বললেন, পাগল দেখলে মানুষ দৌড়ে পালায়। আপনি বসতে চাইছেন। বসেন বসেন।
তারপর গলা উঁচিয়ে গান ধরলেন, দুই পাগলের হলো মেলা...
এলোমেলো লিরিক মেশিয়ে দুই তিন মিনিট গান গেয়ে হঠাৎ কান্না শুরু করলেন লোকটি। বৃষ্টির মতো অঝোর ধারায় পানি তার চোখ দিয়ে বের হয়ে দু’কানের লতি বেয়ে টপটপ করে পড়তে শুরু করল।
হতবাক হয়ে গেলাম। কী দিয়ে কথা শুরু করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বৃষ্টিও তখন বেড়েছে আগের চেয়ে দ্বিগুণ।
কান্না করছেন কেন? মাত্র গান গাইলেন।
আমার কথা শুনে কান্না থামিয়ে তিনি বললেন, পাগল মানুষের হাসি কান্না কারণ লাগে না। আমরা যখন যা খুশি তাই করি। আপনাদের মতো অভিনয় করতে পারি না।
আপনাকে পাগল বলল কে? কত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছেন।
আবার হো হো করে হেসে উঠলেন লোকটি।
আমার মনে হলো এই সুযোগে প্রশ্নটা করে ফেলি। যে কোনো সময় আবার আচরণ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।
আচ্ছা ভাইজান আমার একটা বিষয় জানার খুব আগ্রহ। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলতে পারি।
পাগল মানুষ আবার কারও কথায় কিছু মনে করে নাকি? বলেন বলেন। হো হো হো...
শুনেছি এই এলাকায় আপনি দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই জীবনযাপন করছেন। কেউ আপনার সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। ঘটনা কী?
পাগলের কথা শুনতে চাইছেন! শোনেন তাহলে...
‘আমার নাম সাত্তার। বাড়ি করিমগঞ্জের নেয়ামতপুরে। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাদের ছিল যৌথ পরিবার। তিন ভাইয়ের মধ্যে বাবা ছিলেন সবার বড়। মেজো চাচার দুই ছেলে। ছোট চাচার এক ছেলে এক মেয়ে। দুই চাচাই তাদের পরিবার নিয়ে থাকতেন ঢাকায়। ঈদ ও অন্যান্য ছুটিতে তারা বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। সবাই বাড়িতে এলে আমাদের বাড়িকে বিয়ে বাড়ির মতো মনে হতো। এভাবে চলছিল দীর্ঘকাল। চাচাতো বোনের বিয়ে হলো। ভাইয়েরাও ঢাকায় চাকরি নিলেন। আমি কিশোরগঞ্জের একটা কলেজ থেকে পড়াশোন করে করিমগঞ্জ বাজারে আড়তদারের ব্যবসা শুরু করি। সব মিলে ভালোই চলছিল আমাদের যৌথ পরিবার। এখন থেকে প্রায় বছর দশেক আগে ঈদের ছুটিতে চাচারা তাদের পরিবারসহ বাড়িতে এলেন। সন্তানরা বড় হয়ে যাওয়ার কারণে সবাই বাড়িতে আলাদা ঘর করতে চাইলেন। কে কোনদিকে ঘর করবেন তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিল। পরিবারের সবাই সিদ্ধান্ত নিল বাড়ি বণ্টন করে নিজ নিজ সীমানায় ঘর করার জন্য। বাবা-চাচারা তাতে সম্মতি দিলেন।
পরদিন স্থানীয় এক আমিনকে ডাকা হলো। সকাল থেকেই শুরু হলো বাড়ির মাপজোখ। আমিসহ চাচাতো ভাইয়েরা শেকল টেনে আমিনকে সহযোগিতা করছি। বাড়ির মোট জমিকে তিনভাগ করা হলো। বাম পাশের অংশ ছোট চাচাকে। মাঝের অংশ মেজো চাচাকে। সবার ডানের অংশ রাখা হলো আমাদের জন্য। শেকল টেনে সীমানা নির্ধারণের সময় পড়লাম বিপাকে। মাত্র এক সুতার জমির জন্য একটা বড় আমগাছ পড়ে যাচ্ছে মেজো চাচার সীমানাতে। আমি শেকল কিছুটা বাঁকা করে গাছটাকে আমাদের সীমানাতে রাখতে চাইলাম। বিষয়টি মেজো চাচার নজরে পড়ল।
তিনি বললেন, আমগাছ তুই নিতে চাইলে এমনিতে বল। কিন্তু মাপজোখে কোনো দুই নম্বরি চলবে না।
এভাবে এক কথা দু’কথায় চাচার সঙ্গে আমার ঝগড়া বেধে গেল। এক পর্যায়ে বাড়ির মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে তা সমাধান হলো। আমগাছ মেজো চাচার সীমানায়ই রয়ে গেল। এ ঘটনায় আমার মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ জন্ম নিল। আমরা বাড়িতে থাকি সব সময়। আর তারা উড়ে এসে জুড়ে বসল। বিষয়টি আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না।
ঈদের ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় পরদিন সবাই আবার ঢাকায় চলে গেলেন। যাওয়ার আগে চাচারা তাদের নিজ নিজ সীমানায় খুঁটি বসিয়ে গেলেন।
আমার মাথায় তখনো আমগাছ আত্মসাতের বুদ্ধি ঘুরপাক খাচ্ছিল। একজন আমাকে পরামর্শ দিল সাদা কাগজে চাচার টিপসহ নিতে পারলে পুরো জমিই আমার নামে লিখে নিতে পারব। বাবা প্রথমে এ বিষয়ে রাজি হলেন না। অনেক ভুলভাল বোঝানোর পর তিনি আমার কথায় সম্মতি দিলেন।
পরের বছর ঈদের ছুটিতে দুই চাচা পরিবারসহ বাড়িতে এলেন। আমরা আগের মতোই সবাই মিলে আনন্দ ফূর্তি করলাম। রাতের খাবারও খেলাম সবাই একসঙ্গে। তারপর আমার পরামর্শ মতো বাবা রাতে মেজো চাচাকে নিয়ে বাইরের ঘরে ঘুমাতে গেলেন। আমি বাবাকে বলে রেখেছিলাম চাচা ঘুমিয়ে পড়লে তিনি যেন বাড়ির বাইরের বাতি বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে যান। আমি তখন চাচার হাতের টিপসই নিয়ে আসব।
রাত তখন দেড়টা বা দুইটা হবে। বাইরের ঘরের টিন শেডের দেওয়াল ঘেঁষে আমি বসে আছি। হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল। আমি সন্তর্পণে ঘরে ঢুকে পড়লাম। পুরো ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটু ধাতস্থ হয়ে আমি মোবাইল ফোনের আলো জ্বালিয়ে খাটের ওপরের জায়গাটা শনাক্ত করে নিলাম। তারপর একলাফে বিছানায় উঠে চাচার মুখে বালিশ চেপে ধরলাম। ঘুমের মধ্যে তিনি কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। ফলে বেশি নড়াচড়া করার সুযোগ পাননি। মিনিট দশেকের মধ্যে দেহ নিস্তেজ হয়ে গেল। বাইরে পায়ের শব্দ শুনে আমি দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলোম।’
আমি সাত্তারকে প্রশ্ন করলাম, আপনি টিপসই না এনে খুন করতে গেলেন কেন?
আসলে টিপসই নিলেও জায়গাটুকু পেতে ঝামেলা হতো।
তারপর কী হলো?
‘কিছুক্ষণ পর বাড়িতে হইচই পড়ে গেল। আমি ভয়ে দৌড়ে পালালাম। রাতেই চলে এলাম কিশোরগঞ্জ শহরে। এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। ঘোরে মধ্যে রাত কাটল। সকালে দেখি আমার মোবাইলে মেজো চাচার মোবাইল নম্বর থেকে একাধিক কল। ভাবলাম তার ছেলে হয়েতো ফোন করেছিলেন।
আমি কলব্যাক করলাম। ওপাশের কণ্ঠ শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। মেজো চাচা নিজে ফোন রিসিভ করেছেন।’
মৃত মানুষ আবার ফোন ধরলেন কীভাবে? আমি সাত্তারকে প্রশ্ন করলাম।
সাত্তার বললেন, রাতে কাকতালীয়ভাবে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। তখন মেজো চাচা সিগারেট খেতে বের হয়েছিলেন। বালিশ চাপা দিয়ে আমি খুন করেছিলাম বাবাকে।’
