Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

সুনামগঞ্জ জেলার সাহিত্য নিয়ে বিশেষ আয়োজন

সাহিত্যে সুনামগঞ্জ

Icon

মোহাম্মদ আব্দুল হক

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাহিত্যে সুনামগঞ্জ

সুনামগঞ্জের সাহিত্য সুরমা নদীর প্রবহমান জলের মতো। বহুদূর থেকে আসে এবং ছোটে আরও আরও দূরে। এখানে সুনামগঞ্জের জানালা খুলে তাকালে দৃষ্টি শুধু সুনামগঞ্জে আটকে রাখা যায় না। তাই সুনামগঞ্জের সাহিত্যে বাংলা সাহিত্যকেই দেখি। আমার ‘চেতনায় সারাবেলা’ প্রবন্ধে আমি লিখেছি, ‘সুরমা প্রিয় নদী আমার। আমার যত প্রেম সুনামগঞ্জ ঘিরে, সুরমার জল ছুঁয়ে। আমার প্রথম কবিতা, আমার প্রথম নাটকের শহর সুনামগঞ্জ।’ এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সুনামগঞ্জের পথে পথে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে এবং জলের তিরতির কম্পনে কবিতা ছড়া ছন্দে দোল খায়।

সুনামগঞ্জের সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের মাঠের সাহিত্য। সে জন্যই সুনামগঞ্জের হাছন রাজার গান যুগ যুগ ধরে শুধু সুনামগঞ্জের সীমানায় নয়, বরং; প্রতিদিন সারা বাংলাদেশের মাঠে, মঞ্চে, বেতার ও টেলিভিশনে গাওয়া হয়। হাছন রাজা মরমি কবি, তার গানে মরমের বেদনা আলোড়ন তুলে। মানুষ হাছন রাজার গানে উদাস হয়। যারা হাছন রাজার রচনার গভীর দর্শন বুঝতে পারে, তারা হাছন রাজাকে নিয়ে ভাবে। দেখুন, নিজেকে জানার কথা বলেছেন বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক শিক্ষক সক্রেটিস। হাছন রাজা তার গানে বলেছেন, ‘আঁখি মুঝিয়া দেখো রূপ-রে, আঁখি মুঝিয়া দেখো রূপ।’ এখানে হাছন রাজা চোখ বন্ধ করে নিজেকে দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু; চক্ষু বন্ধ করলেই কি নিজেকে দেখতে পাওয়া যায়। ধ্যান ও জ্ঞান সহযোগে অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখতে হয়। সাধারণের পক্ষে অন্তর চক্ষুর খোঁজ পাওয়া কঠিন। কিন্তু; হাছন রাজা পেরেছেন। তাই তো; তার আরেক গানে তিনি বলেন, ‘রূপ দেখিলাম-রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম-রে, আমার মাঝতোন বাহির হইয়া দেখা দিলো আমারে।’ এ জন্যই হাছন রাজাকে আমি সাহিত্যের উঁচু আসনে দেখি। হাছন রাজা একজন বড় মাপের দার্শনিক। সুনামগঞ্জের শাহ আব্দুল করিম গানে গানে সুনামগঞ্জকে পৌঁছে দিয়েছেন সুনামগঞ্জের হাওড়াঞ্চল থেকে বাংলাদেশের সর্বত্র।

সুনামগঞ্জের মরমি কবিদের তালিকায় হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের পাশাপাশি পাই, রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ, সৈয়দ শাহ নূর, শাহ আছদ আলী পীরসহ আরও অনেক গুণিজন। এখানে আমার জানা সব বাউল গানের রচয়িতাদের নাম, কবি, গল্পকার, কলামিস্ট, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, প্রাবন্ধিকের নাম নেওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও আমার উদ্দেশ্য সুনামগঞ্জের সাহিত্যের মাঠে সুনামগঞ্জের মানুষ খোঁজা।

এ পর্যন্ত প্রাপ্ত বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন হিসাবে যে গ্রন্থটির সন্ধান পাওয়া গেছে তার নাম হচ্ছে, চর্যাপদ। সেই সাহিত্যের প্রভাব বা প্রাচীন যুগের সাহিত্যের ঢেউ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে সুনামগঞ্জের সাহিত্যের পুরোপুরি মূল্যায়ন করা যাবে না। সুনামগঞ্জের সাহিত্য মানে সুনামগঞ্জের মানুষের রচিত এবং লালিত সাহিত্য। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকে ১৯১১ খ্রিষ্টীয় সালে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ : ‘নানা দেশ নানা মানুষ’ ১৯৬৫ খ্রিষ্টীয় সালে প্রকাশিত হয়। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ১৯২৯ খ্রিষ্টীয় সালে জন্ম নেওয়া আসাদ্দর আলী বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। সুনামগঞ্জের মাটিতে শিকড় প্রোথিত সুনামগঞ্জবাসী ছুটে গেছেন সারা বাংলায় এবং বিদেশেও। দেশে-বিদেশে যেখানেই আমরা সুনামগঞ্জী আছি, আমরা বুকের গভীরে সুনামগঞ্জ ধরে রাখি। কাজেই বলা যেতে পারে, সুনামগঞ্জের সাহিত্য সবখানে ছড়িয়ে আছে এবং বাংলা সাহিত্যে তা বড় জায়গা নিয়ে আছে এবং নিঃসন্দেহে তা গুরুত্ববহ। কিন্তু; আমার লেখাটির পরিসর ততটা বড় নয় এবং আমার অল্প জানার কারণেই সারা সুনামগঞ্জের সাহিত্য নিয়ে এখানে উপস্থাপনের সাহসের সীমাবদ্ধতাও আছে।

সুনামগঞ্জের সাহিত্য যেহেতু বাংলা সাহিত্য; তাই সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সুনামগঞ্জের সাহিত্য জগতের সেকালের ও একালের মানুষের পাশাপাশি সারা বাংলাদেশের আরও আরও বিখ্যাত কবি ও লেখকদের নাম সব সময় প্রাসঙ্গিক। চর্যাপদ থেকে এ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন যারা তাদের মধ্যে অনেকে আছেন সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও সিলেটের। সিলেট সুনামগঞ্জের লোকসাহিত্য গবেষক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত মুস্তাক আহমেদ দীন-এর নাম সর্বজনবিদিত।

সুনামগঞ্জের বাতায়নে সাহিত্যকে খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাই, বিশ্বের মাঠে আসন গেড়ে আছেন সুনামগঞ্জের সন্তান, বিশিষ্ট দার্শনিক ও একুশে পদকে ভূষিত দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। তার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারা বাজার উপজেলায়। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ পাঠ করলে মানুষের মনে শুদ্ধ সাহিত্যচর্চার অভ্যাস গড়ে উঠবে। সুনামগঞ্জের সাহিত্যিক শাহেদ আলী সাহিত্যের মাঠে এক উজ্জ্বল তারা। তার ‘জিব্রাইলের ডানা’ বিখ্যাত। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক এবং আরও অনেক সম্মানে সম্মানিত। শাহ আছদ আলী পীর সুফি সাধক ও মরমি কবি, তিনি সুনামগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

মুহাম্মদ আবদুল হাই নামটি সুনামগঞ্জের সাহিত্যাঙ্গনে জড়িয়ে আছে গবেষণা ধর্মী লেখক হিসাবে। তিনি মরমি গানও রচনা করেছেন। তার জন্ম সুনামগঞ্জ শহরের আরপিন নগরে। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হাছন রাজার গান, উতলা বাতাসে ইত্যাদি। বহু সম্মানজনক পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির মনকাড়া বহু দেশাত্মবোধক গানের রচয়িতা। তিনি সুনামগঞ্জের তেঘরিয়ায় বেড়ে উঠেছেন এবং ঢাকায় প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত। সুনামগঞ্জের কবি মোহাম্মদ সাদিক বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। তার পৈতৃক নিবাস সুনামগঞ্জের ধারার গাঁও গ্রামে। সুনামগঞ্জের ধ্রুব এষ শুধু প্রচ্ছদ শিল্পী নয়, তার গল্প সমৃদ্ধ এবং তিনি তার সৃষ্টির দ্বারা সুনামগঞ্জকে ঢাকা ও কলকাতায় নিয়ে গেছেন। সুনামগঞ্জের ধ্রুব এষ এখন শুধু সুনামগঞ্জের নয়, ভারত উপমহাদেশে যেখানে বাংলা সেখানেই তিনি আছেন।

সুনামগঞ্জের সাহিত্য জগতে আছেন সালেহ চৌধুরী এক উজ্জ্বল নাম, সুনামগঞ্জ জেলার আলমপুর গ্রামের মু. আব্দুর রহিম একজন কবি, আছেন ‘কবর পূজা’ গ্রন্থের রচয়িতা করম আলী, মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী মোট ৯টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। সুনামগঞ্জে অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি মমিনুল মউজদীন, তার ‘এ শহর ছেড়ে পালাবো কোথায়’ বিখ্যাত। কবি ইকবাল কাগজী, কবি সাব্রী সাবেরিন, লোক গবেষক সুমন কুমার দাশ, দেওয়ান সামারিন রাজা, কবি বাবর বখত, ইশতিয়াক আহমেদ রূপু, ইয়াকুব বখত বাহালুল, কবি শেরগুল আহমেদ, তৌফিক দোলন, আবুল বশর আনছারী সহ বহুজন দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আছেন। কলামিস্ট কবি ও ঔপন্যাসিক মোহাম্মদ আব্দুল হক-এর উপন্যাস ‘শ্বশুর বাড়ির জাঙ্গাল’, কাব্যগ্রন্থ ‘যদি থাকো কবিতায়’ ইত্যাদি। তার লেখালেখি শুরু সুনামগঞ্জে এবং প্রকাশিত সিলেটে। গীতিকার রইছ রহমান আমেরিকায় আছেন, কিন্তু; সুনামগঞ্জের মায়ায় তার মন পড়ে থাকে সুনামগঞ্জের মাঠে।

সুনামগঞ্জের কবি ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহমদ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মেয়ে সাদিয়া চৌধুরী পরাগ, কবি রোকেস লেইস, কবি নাসরিন আবেদিন, কবি মুনমুন চৌধুরী, মহী জামান, কবি ইখতিয়ার উদ্দিন, কলামিস্ট ও লেখক পীর হাবিবুর রহমানসহ সুনামগঞ্জের কবি জুনেদ আহমেদ, কবি আজমল আহমদ, এস ডি সুব্রত, লেখক মোঃ মশিউর রহমান, আবু তালহা বিন মনির, গল্প লেখক জেনারুল ইসলাম, কবি জীবন কৃষ্ণ সরকার, শফিকুল ইসলাম সোহাগ, মনোয়ার পারভেজ, আনোয়ারা খাতুন, কবি মোঃ আমিরুল হক, ফজলুল হক দোলন, কবি সুলতানা রাজিয়া আছমা, দোয়ারা বাজার উপজেলার মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালীসহ আরও বহু কবি ও লেখক প্রকাশিত। সৈয়দ আলী আহমদ-এর ‘মুভে ফাম’ বিখ্যাত এক গ্রন্থ।

যদিও সুনামগঞ্জের খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে সাহিত্যের সুবিশাল অবারিত প্রান্তর দেখা যায়, তারপরও; লেখাটি শেষ করতে হচ্ছে। যুগ যুগের পথে চলে সাহিত্য সাধনা। এখানে অনেক গুণী কবি ও সাহিত্যিকের নাম এসেছে, আবার অনেক অনেক রয়ে গেছেন দূরের ও কাছের সীমানায়। কবি ও সাহিত্যিক তৈরি করা যায় না। এ হচ্ছে প্রকৃতি ও সমাজের প্রভাব সৃষ্ট। প্রকৃতির প্রভাবে ও মানুষের বসবাসরত সমাজের নানামুখী গতির প্রভাবে যখন কোনো মানুষের চিন্তার দরজায় জ্ঞানের বিজলি এসে পড়ে, তখনই সে কবি হয়ে ওঠে প্রকাশে অথবা অপ্রকাশে। সুনামগঞ্জের জানালায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাই সুনামগঞ্জের সমৃদ্ধ সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের মাঠে উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্য। পরিশেষে উপলব্ধি হচ্ছে, সাহিত্যের সব শাখা গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রবন্ধ সাহিত্য হচ্ছে উন্নত সাহিত্য। নিজেকে সাহিত্যে বিকশিত করার জন্য প্রবন্ধ পাঠে অধিক মনোযোগ দিতে হয়।

সাহিত্য সুনামগঞ্জ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম