অবশেষে বইমেলা চিরায়ত রূপে
খান মাহবুব
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অমর একুশে বইমেলা অঙ্কুরকাল থেকে প্রতিবছর উৎকর্ষ সাধন করে আজ বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার এক উৎসভূমি হিসাবে স্বীকৃত। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এ মেলার আঁতুড়কথন রচিত হলেও ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে বইমেলা পরিচালনা করছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমণে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির পরিতোষণে বইমেলাকে কম চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়নি। বইমেলা আগুনে পুড়েছে, ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছে, প্রগতিশীল লেখক বইমেলায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ বলিদান দিয়েছেন কিন্তু বইমেলা থেমে থাকেনি স্বমহিমায় প্রতিভাত হয়ে এগিয়ে গেছে।
বলে রাখা প্রয়োজন, ১৯৮৩ সালেই বাংলা একাডেমি বইমেলার পোশাকি নাম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ স্থির করে প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করলেও নানা কারণে বইমেলা শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। ২০২০ সাল করোনা প্যান্ডেমিক বিশ্বের তাবৎ মানুষের মধ্যে ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এ বৈশ্বিক দুর্যোগের বাইরে নয় বইমেলা। করোনায় বাংলাদেশে প্রায় ২৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কাজ হারিয়েও অনেক মানুষ দিকভ্রান্ত। এ ক্রান্তিকালেও মানুষ টিকে থাকতে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে আবার নবদিশা খুঁজছে। খুলে গেছে হাটবাজার, সিনেমা হল, পর্যটন কেন্দ্র, নাটমহল, শপিংমল ইত্যাদি। মানুষ প্রতিকূল এ অবস্থায় টিকে থাকতে এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাতে বর্তমান সময়কে নামকরণ করেছে ‘নিউ নরমাল সিচুয়েশন’। মূলত দীর্ঘমেয়াদি এ করোনাকালে মানুষ জবুথবু হয়ে ঘরে বসে থেকে আর্থিক ও মানসিকভাবে টিকতে পারে না। তাই বাস্তবতাকে মেনে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করে যাচ্ছে যতদূর সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যার নিুমধ্যম আয়ের দেশের পক্ষে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যথার্থ শারীরিক দূরত্ব, আইসোলেশন ইত্যাদির মান্যতা দুরূহ।
এ দুর্যোগকালেই সময়ের কালচক্রে আমরা পার করেছি অমর একুশে বইমেলা ২০২১। প্রকাশকরা বইমেলায় সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে অংশ নিলেও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ২০২১ সালের শেষার্ধে করোনা পরিস্থিতির প্রণিধানযোগ্য উন্নতি হয়। প্রকাশকরা আশায় বুক বেঁধে ঋণ-ধার করে বই প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু বিধি বাম। জানুয়ারি ২০২২-এ শুরু হয় নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনের তাণ্ডব। শুরু হয় বইমেলা নিয়ে দোলাচাল। কিন্ত লেখক, প্রকাশকরা চেয়েছে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ কালপর্বে মেলাটি শতবর্ষের তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠুক। সংশ্লিষ্ট সবার মানসিক প্রস্তুতি ছিল এ বছর মেলাটিকে উৎকর্ষতার উতঙ্গে পৌঁছে দেওয়ার। আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিসহ বইমেলার অংশীজনদের আগ্রহ ও উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। যদিও করোনা সেসবকে অনেকটা থিতিয়ে দিয়েছিল। অবশেষে বইমেলা রীতি থেকে সরে এসে শুরু হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি। আশা জাগানিয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করে ওমিক্রনের নিুগামীর মাত্রা। উদ্বোধন পর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বইমেলা এক মাসব্যাপী হওয়ার অভিপ্রায় জানান। বইমেলায় নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়। বইমেলা যাত্রা করে স্বমহিমায়। বলে রাখা প্রয়োজন করোনার মাঝেও ২০২১-এর বইমেলায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রণিধানযোগ্য সংখ্যক বই প্রকাশ করে প্রকাশকরা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশিত প্রায় পাঁচ হাজার বইয়ের তালিকা এক মলাটে প্রকাশ করেছে। এ বছর বইমেলার পর এই তালিকা দীর্ঘ হবে। আমরা সবাই চাই অমর একুশের বইমেলা যথার্থভাবে হোক মাসব্যাপী। শুধু ধারাবাহিকতার জন্য নয়, প্রয়োজনের তাগিদেই। তবে করোনার ঢেউ ও স্বাস্থ্যবিধি মাথায় রেখে। পৃথিবীতে মানব বসতির প্রভাত বেলা থেকে দুর্যোগ-দুর্বিপাক, মহামারি মানুষের যাত্রাপথের সঙ্গী। এ সবকে সঙ্গে নিয়েই মানুষ আজ এখানে দাঁড়িয়ে।
বইমেলার পরিবেশ ঠিক রাখতে সামাজিক দূরত্বমানা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠকরা যেন প্রবেশ করে সে বিষয়ে জোর তদারকি প্রয়োজন। একই সঙ্গে মেলার মাঠে যেন বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় পাঠকদের জন্য নিরাপদ হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রযুক্তির ব্যবহারও প্রয়োজন।
অনেকেই ভাবে বইমেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশকরা মেলাশেষে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরে। কিন্তু বাস্তবতা যোজন যোজন দূর। বইমেলায় অংশ নেওয়া মাঝারি ও ছোট পুঁজির প্রকাশকদের বড় একটা অংশ মুনাফা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে না। প্রচার, যোগাযোগ, অংশগ্রহণ, প্রতিষ্ঠানের তারল্য বৃদ্ধি, সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদি কারণে বইমেলায় অংশ নেয়।
গতবছর সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর উদ্যোগ প্রকাশকরা বইমলার ভাড়ায় অর্ধেক রেয়াত পায়, বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। এ বছরও বইমেলায় প্রকাশকদের প্রণোদনা প্রয়োজন। বইমেলার লাভ-ক্ষতির তোয়াক্কা না করে প্রকাশকরা এ বছর ‘মুজিববর্ষ’ ও ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’র এ মাহেন্দ্রক্ষণে বইমেলার মাধ্যমে প্রকাশকরা সারথি হতে চেয়েছে। বাঙালির নিজস্ব দেশজ সংস্কৃতির বিকাশে নিজেদের অংশগ্রহণ চায়, করোনাকালেও পাঠকদের নতুন বইয়ের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে চায়, সামাজিক দায়বদ্ধ মানুষ হিসাবে জাতির প্রগতির অগ্রায়ণে ভূমিকা রাখতে চায়। করোনাকালে নগরজনদের একটু প্রশস্তিও দেবে বইমেলা।
করোনায় নিউ নরমাল সিচুয়েশনে সরকার বইমেলা, বাণিজ্যমেলাসহ প্রতি বছরের মতো নৈমিত্তিক আয়োজনে ইতিবাচকভাবে পরিকল্পনা করেছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশকদের প্রণোদনা প্রয়োজন শুধু মেলার ভাড়ায় রেয়াত নয়, উৎপাদিত বই যেন সারা বছর বিক্রি হয় সে জন্যও প্রয়োজন। এ কারণেই বইমেলায় জন্য সবার ঐক্য ও সংযোগটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সরকার নিয়ন্ত্রকের আসনে বসে এসব বিষয়ে ইতিবাচকভাবে ভাববে এটাই স্বাভাবিক।
করোনার মাঝেও বইমেলার মাঠের আয়তন ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ বর্গফুট। বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৪৩। রয়েছে ৩৫টি প্যাভিলিয়ন। গত বছরের প্যাভিলিয়নের সঙ্গে এ বছর নতুন মাত্রা যোগ করেছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির প্যাভিলিয়ন। ২০২২ সালের বইমেলার প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’। এ বছর তরুণ ও উদ্ভাবনশীল সাহিত্যকর্মীদের কথা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করে লিটল ম্যাগাজিনের স্টলের জায়গা দেওয়া হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যভাগে।
স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ সরকার সমাসীন। কাজেই প্রগতির লড়াইটা চালানোকে কতটা প্রয়োজন সেটা সরকারকে বোঝানো নিষ্প্রয়োজন। বইমেলা শুধু বইয়ের পসরা সাজিয়ে পাঠকের সঙ্গে সংযোগ নয় পরিশীলিত মানসিকতা তৈরি করে ভেদহীন দেশ গঠনের ভ্রূণমূল প্রোথিত আছে এ বইমেলার মাঠে। সবাই সেই বিষয়টি অনুধাবন করবেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে, এটাই কাম্য।
সার্বিক দিক বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বইমেলার সময়কাল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছেন। বইমেলা ইতোমধ্যে স্বমহিমায় চিরায়ত রূপে ফিরেছে। করোনা সংক্রমণ সহনীয় মাত্রায় চলে নেমে এসেছে-এখন প্রয়োজন বইমেলার অংশীজনদের নিয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের দ্রুতি বিশ্বময় করা।
বাংলাভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাবে বিশ্বে অবস্থান পঞ্চম। ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসাবেও বিশ্বে বাংলাদেশ অনন্য। বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের বাইরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় বাংলাদেশের সমান। এ বিবেচনা মাথায় রেখে অমর একুশে বইমেলা যেন বাংলাভাষা ও সাহিত্যের দূত হিসাবে কাজ করে বহির্বিশ্বে ছড়াতে পারে সেই প্ল্যাটফরম হিসাবেও বইমেলাকে এগিয়ে নিতে হবে, এ আমাদের জাতীয় দায়, এ দায় বহন করতে হবে অবধারিতভাবেই।
