|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বয়েই একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। আমাদের দেশ আপাতদৃষ্টিতে বাঙালি অধ্যুষিত হলেও এদেশে নানা ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ বাস করে। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীরই রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষা, পেশা, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান এবং অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার বিশেষ ধরন। বাংলাদেশে বসবাসরত তৃতীয় বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠী হলো ‘ত্রিপুরা’। ত্রিপুরা জাতিসত্তার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করে। এছাড়া হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, সিলেট, চাঁদপুর ও কুমিল্লা জেলায় এবং ভারতের কয়েকটি রাজ্যে (ত্রিপুরা, আসাম ও মিজোরাম) ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ বাস করে। এ জাতির মূল অংশ বর্তমানে বসবাস করছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে।
ত্রিপুরা জাতি ভারতীয় উপমহাদেশের এক প্রাচীন জাতি। ত্রিপুরা শব্দটি এসেছে ‘তৈপ্রা’ শব্দ থেকে। অনেক আগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ নদীর তীরে বসবাস করত বলে তারা তৈপ্রা নামে পরিচিত ছিল। ‘তৈ’ শব্দের অর্থ ‘পানি’ আর ‘প্রা’ শব্দের অর্থ ‘গ্রাম’ বা ‘মহল্লা’। পরবর্তীকালে তৈপ্রা শব্দটি বিবর্তনের মাধ্যমে তৈপ্রা থেকে টিপরা, টিপরা থেকে টিপুরা, সবশেষে টিপুরা থেকে ত্রিপুরা নামে পরিচিতি লাভ করে।
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব বৈসু বা বৈসুক। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এই তিন দিনব্যাপী এ উৎসব পালন করা হয়। প্রথম দিনকে বলা হয় বৈসু। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন এ উৎসব উদযাপন করা হয়। এই দিনে মূলত আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়। ত্রিপুরীরা নদীর তীরে, মন্দিরে কিংবা বিশেষ পবিত্র স্থানে ফুল, ধূপ ও দ্বীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এছাড়া গবাদিপশুর পরিচর্যা এবং পশুর গলায় ফুলের মালা পরানো হয়। ভোরবেলা থেকে শুরু হয় ফুল তোলার প্রতিযোগিতা। কথিত আছে, ছোটদের তোলা ফুল বড়রা নিতে পারবে, কিন্তু বড়দের তোলা ফুল ছোটরা নিতে পারবে না। এই দিন ফুল দিয়ে পুরো বাড়ি সাজানো হয়।
দ্বিতীয় দিনটিকে বলা হয় বৈসুমা। চৈত্রসংক্রান্তিতে এ উৎসব উদযাপন করা হয়। এ দিনকে বলা যায় খাদ্য উৎসব। এদিন পুরোনো শত্রুতা, দ্বন্দ্ব, বিবাদ ভুলে পরস্পরের বাড়িতে হরেক রকমের পিঠা, ফলমূল, মিষ্টান্নসহ নানা ধরনের মুখরোচক খাবার পাঠানো হয়। এ উৎসবের প্রধান আকর্যণ হলো জনপ্রিয় খাবার ‘লাবড়া’ বা ‘পাচন’। লাবড়া মানে মিশ্রণ। ২৫ থেকে ৩০ ধরনের সবজির সংমিশ্রণে তৈরি হয় লাবড়া। এই দিন দরিদ্র মানুষদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। গ্রামের সব মানুষ গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় এবং পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে।
তৃতীয় তথা শেষদিনকে বলা হয় বিসিকতাল বা নববর্ষ। এই দিন নববর্ষকে বরণ করা হয়। এদিন আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য ছোটরা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের পা ধুয়ে প্রণাম করে। এতে পরিবার তথা আত্মীয়তার বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। এ দিনের বিশেষ আয়োজন থাকে ফুল ও পানি নিয়ে খেলার। বিশেষ করে পানি নিয়ে খেলাটা বৈসুর প্রধান আকর্ষণ হিসাবে বিবেচিত। এর প্রধান উদ্দেশ্য পানি দিয়ে পুরোনো দিনের সব গ্লানি ধুয়ে দেওয়া। অবশ্য এ উৎসবের আগে জলপূজা করার রীতি আছে।
ধন রঞ্জন ত্রিপুরা : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
