|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গ্রামের মানুষ এখনো গরমে হাতপাখা ব্যবহার করে। তালপাতার পাখা এখনো টিকে আছে ঐতিহ্য ধারণ করে। এ পাখা তৈরি ও ব্যবহারের ইতিহাস বহু প্রাচীন। হাতপাখার প্রচলন ছিল আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে গ্রিক-রোমান যুগেও।
তবে প্রথমদিকের পাখাগুলো ছিল সম্পূর্ণ অংশের। ভাঁজ করা বা ফোল্ডিং পাখা এসেছে অনেক পরে। ইউরোপীয় বণিকরা প্রথম এ ধরনের পাখা নিয়ে আসে চীন ও জাপান থেকে। তখন এসব পাখা ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। এগুলোয় ব্যবহার করা হতো মণিমুক্তা ও হাতির দাঁত। সোনা-রুপার পাত বসানো হাতপাখাগুলোয় নিপুণ হাতে শিল্পীরা আঁকতেন সেসময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট, ধর্মীয় নানা কাহিনি এবং ফুল-লতাপাতাসহ নানা বিষয়।
তালপাতা ছাড়াও সুতা, বাঁশ, বেত, খেজুরপাতা, শোলা, শন, গমের কাঠি ও ময়ূরের পালক দিয়ে নকশি পাখা তৈরি করা হয়। নকশি পাখার কদর সেই বেদ পুরাণের আমল থেকেই। রাজা-মহারাজাদের সিংহাসনের দুপাশেও ময়ূরের পালক বা চমৎকার রেশমি কাপড়ের তৈরি পাখা হাতে ডানে-বামে দাঁড়িয়ে বাতাস করত দাসদাসী।
ইংরেজ আমলে, এমনকি ইংরেজ আমলের পরেও জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এ ধরনের পাখা টেনে বাতাস করার ব্যবস্থা ছিল। অষ্টাদশ শতকে বিত্তশালীরা চন্দন কাঠের পাখা ব্যবহার করত, যেটি জলে ভিজিয়ে হাওয়া খেলে চন্দনের সুগন্ধে চারদিক আমোদিত হতো। ছিল হাতির দাঁতের কারুকার্য করা পাখাও। বিত্তবান লোকের কাছারি ঘরে ছাদ বরাবর কড়িকাঠে ঝুলানো থাকত বড় কাপড়ের পাখা। রশি টেনে চালানো হতো সেই পাখা।
বর্তমানে হাতপাখা কমই দেখা যায়। তবে গ্রামবাংলায় হাতপাখার কদর এখনো কমেনি। কৃষক মাঠে কাজ করছে, আর স্ত্রী তার জন্য খাবার নিয়ে আসছে, সঙ্গে একটি হাতপাখা। কৃষক খাচ্ছে আর গৃহবধু হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে-এ ছবি যেন মনে দাগ কেটে যায়। সৌন্দর্যের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রঙিন সুতার ‘নকশি পাখা’। সুতা দিয়ে পাখার গায়ে পাখি, ফুল, লতা-পাতা কিংবা ভালোবাসার মানুষের নাম অথবা ভালোবাসার চিহ্ন ফুটিয়ে তোলা হয়। পাখার বাতাসে যেমন প্রাণ জুড়িয়ে যায়, তেমনই বাহারি সব পাখা দেখে চোখও জুড়ায়। একসময় কত রকমের পাখা থাকত বাড়িতে-কাপড়ের পাখা, বাঁশের চাটাইয়ের রঙিন পাখা, তালপাতার পাখা, ভাজ পাখা, চায়না পাখা, ঘোরানো পাখা।
শীতের মাঝামাঝি সময়েই তালপাতার পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। তালপাতা, বাঁশের কঞ্চি ও সুঁই-সুতা হলো পাখার উপকরণ। প্রথমে তিন-চার ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় পাতা। তারপর সেই পাতাকে সাইজ করে কাটা, সরু লম্বা কাঠি দিয়ে বাঁধা, রং করা প্রভৃতি নানা পর্বের মধ্য দিয়ে পাখা তৈরি হওয়ার পর বিপণনের ব্যবস্থা করা হয়। একটি তালপাতা থেকে একটি বা দুটি পাখা তৈরি করা যায়। তালপাতার পাখা তৈরি ও বিক্রি করে এখনো অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে। বর্তমানে তালগাছ কমে আসার কারণে শিল্পীর সংখ্যাও কমে আসছে। অন্যদিকে সর্বত্র বিদ্যুতের লাইন যাওয়ায় বাংলার এ জনপ্রিয় লোকশিল্পকর্ম ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। তবে হাতপাখার বাতাস এখনো প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। চিরায়ত বাংলায় হাতপাখা আজও গরমে শরীর জুড়ায়।
প্রদীপ সাহা : লেখক
pradipsaha509@gmail.com
