|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ছোট্ট মেয়েকে পুতুলের মতো করে সাজানো, তাকে আদর-স্নেহ-যত্নে আগলে রাখা বাঙালি বাবাদের চিরায়ত ভালোবাসার প্রকাশ। মান্না দের কণ্ঠে একটি আবেগমথিত গানের কথা আজও ভুলতে পারিনি। মেয়ে যখন বিয়ের সাজে সজ্জিত, তখন স্নেহান্ধ বাবা এক গভীর বেদনায় ডুবে যান। তিনি নিজের মনকে বোঝাতে পারেন না। বলেন : ‘তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে/যাকে নিয়ে স্বপ্ন আমার ঝরতো দুচোখ বেয়ে/নতুন নতুন করে তোকে যতো সাজাতাম/ভরতো না মন দিতাম কত নতুন নতুন নাম/আজকে দেখি নতুন তোকে লাগছে সবার চেয়ে/তবু কেন জল আসেরে আমার দুচোখ ভরে’ (পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়)।
আমরা পুতুলকে জীবন্ত করি স্নেহের মায়াজালে। তাই মাটির পুতুল আমাদের মন ভোলানো সামগ্রী নয় শুধু, চিরায়ত বাঙালির দুঃখ-বেদনা-আনন্দের উপাখ্যানও বটে। গবেষকরা মনে করেন, আদিম গুহাচিত্রের ধারণা থেকে পুতুলের জন্ম। অনাগত ভয় ও ভাবনা থেকে প্রাচীন মানুষ দেব-দানব, পশু-পাখির অবিকল ক্ষুদ্র অবয়ব বানাতো মাটি, বাঁশ, গাছ দিয়ে। তখন এগুলোই হতো পুতুল। বাংলা অভিধানে পুতুলের অনেক নাম : পুত্তলিকা, পুত্রিকা, পুতলি, পোতলা ইত্যাদি। পুত্ ধাতু থেকে পুতুল শব্দের জন্ম। আবার পুত্ মানে পুত্র। পুত্রের কায়ায় পুতুল। পুতুলকে ইংরেজিতে বলে পাপেট। এ পাপেট নারী প্রতিমাতুল্য।
সুতরাং পুতুল নিয়ে সারা দুনিয়ার ভাবাবেগ হচ্ছে জীবনের শুরু থেকেই। এজন্য পুতুল হয় কোনো প্রত্যক্ষ বস্তু বা জীবনের প্রতিরূপ-মুখোশ, পাপেট, মাপেট ইত্যাদি। তারপর পুতুল খেলনা, কাকতাড়ুয়া, জীবজন্তু হয়ে, ভাস্কর্য হয়ে নানা রঙে, নানা রূপে, নানা মানুষের কল্পনায় আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
এদেশে যশোরের বর-বউ পুতুল, নড়াইলের ঘাড় কাঁপানো বুড়ো পুতুল, ময়মনসিংহ ও শরীয়তপুরের টেপা পুতুল, কুমিল্লার টেরাকোটা পুতুল, মাগুরার শোলা পুতুল, ফরিদপুরের তালপাতার সেপাই পুতুল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুল নাচের পুতুল, ঢাকার কাগজ, পুঁতি ও ধাতব পুতুল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে নদীয়ার মাটির পুতুল, বাকুড়ার ধোকরা পুতুল, পুরুলিয়ার মুখাশ পুতুল, মুর্শিদাবাদের জীবন পুতুল, উত্তর দিনাজপুরের ষষ্ঠী পুতুল, হাওড়ার টেপা পুতুল ইত্যাদি।
পুতুল কল্পনায় যখন রূপকথা, কেচ্ছাকাহিনী, পৌরাণিক উপাখ্যানের উপাদান হয়, তখনই পুতুল নাচে। মানুষ সূত্রধর হয়ে সুতার টানে সেই পুতুলকে নাচায় কথায়-গানে-সুরে-বাদ্যে। লোকায়ত পার্বণে পুতুল নাচ হয়ে ওঠে বাঙালির শিক্ষা-দীক্ষা, প্রচার-প্রচারণায় বিনোদনের মাধ্যম। সৃষ্টি হয় নাট্যধারায় পুতুলনাট্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগে পুতুল নাচ বা পুতুল নাট্য নিয়ে ব্যাপক পঠনপাঠন ও গবেষণা চলছে। আমাদের দেশে শিল্পকলা একাডেমি প্রতিবছর ২১ মার্চ ‘বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবস’ নানা আয়োজনে উদ্যাপন করে আসছে। শিল্পের উপাদান ও শিল্প হিসাবে টিকে আছে পুতুল ও পুতুল নাচ। আর আছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’।
চয়ন সেনগুপ্ত : প্রাবন্ধিক
