প্রকল্প প্রস্তাব একনেকে উঠছে আজ
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের ব্যয় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মাতারবাড়ীতে হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। এজন্য ‘মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উঠছে আজ মঙ্গলবার।
এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)।
বাকি ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল এবং ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় একনেক বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সংযোগ সড়কসহ মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, যা ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাহিদা মেটানো এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত বন্দর সেবা দেয়া সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মো. নূরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটি একনেকের জন্য তৈরি তালিকায় রয়েছে। আমরা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করব। তবে অনুমোদন দেয়া-না-দেয়া একনেকের বিষয়। তবে আশা করি অনুমোদন পাবে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পটির প্রস্তাব পাওয়ার পর গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সভায় দেয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। ফলে এটি একনেকে উপস্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
একনেকের জন্য তৈরি প্রকল্পের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, পিইসি সভায় জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী প্রকল্পোর নিট বর্তমান মূল্য ঋণাত্মক। আর্থিক ও অর্থনৈতিক রিটার্ন অলাভজনক হওয়া সত্ত্বেও প্রকল্পটি গ্রহণের যৌক্তিকতা প্রকল্পের ডিপিপির পটভূমিতে বিস্তারিত উল্লেখ করতে বলা হয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ে বন্দর নির্মাণে স্বল্প হলেও খুব কম সুদে তহবিল পাওয়া যাবে। তাই এটি আর্থিকভাবে লাভজনক হবে। এক্ষেত্রে জাইকা শূন্য দশমিক ০১ শতাংশ হারে প্রকৌশল সেবা দেবে।
এছাড়া শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ হারে মূল প্রকল্পের ঋণ দেবে। প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হবে। তাই এটি উল্লেখযোগ্যভাবে লাভজনক হবে। এছাড়া পরামর্শকের ব্যয় ও সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে কমাতে বলা হয় পিইসি সভায়।
আরও বলা হয়, পায়রা বন্দরে চার লেন রাস্তা নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ৬০ কোটি টাকা হলেও এ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১৬০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে, যা অত্যাধিক বলে প্রতীয়মান হয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা হচ্ছে, জাইকার সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্ভাব্য সমীক্ষা তৈরির সময়ই বিস্তারিত ব্যয়বিভাজন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে প্রকৌশলগত প্রয়োজনীয়তা এবং স্থানীয় পর্যায়ে নির্মাণসামগ্রীর প্রাপ্যতা যৌক্তিকতার ভিত্তিতে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে যে কটি সমুদ্রবন্দর রয়েছে, তার কোনোটিই গভীর সমুদ্রবন্দর নয়। ফলে ডিপ ড্রাফটের ভেসেল এসব বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না।
তাই ডিপ ড্রাফট ভেসেলের জেটি সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য মাতারবাড়ীতে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বিষয়ে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প নেয়া হয়। একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক কনটেইনারবাহী জাহাজ, খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারের জেটিতে ভেড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি চাহিদা পূরণ এবং মাতারবাড়ী ও মহেশখালী অঞ্চলে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চলগুলোয় পণ্য পরিবহনে সহায়তা করাই এ বন্দর প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য।
জাইকার সার্ভে অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ সর্বোচ্চ ২ হাজার টিইইউএস কনটেইনার নিয়ে ভিড়তে পারে। অথচ পার্শ্ববর্তী কলম্বো, জহরলাল নেহেরু, করাচি ও চেন্নাই বন্দরে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ ভিড়তে পারে।
মাতারবাড়ীতে অধিক ড্রাফটের জাহাজের সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কনটেইনার পরিবহনে বাংলাদেশের জন্য উত্তম বিকল্প। মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যরে দুটি টার্মিনাল থাকবে।
এসব টার্মিনালে ১৬ মিটার ড্রাফটের ৮ হাজার টিইইউএস কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ ভিড়তে পারে না।
যার ফলে মাদার ভেসেলগুলো বন্দরের জেটিতে আসতে পারে না। ফলে ফিডার জাহাজে করে কনটেইনার আনানেয়া করতে হয়। প্রতিদিন ৩৫০০ থেকে ৩৮০০ টিইইউএস আমদানি পণ্য কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে।
মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের ১৬ মিটার গভীরতার জন্য মাদার ভেসেল ভেড়ার সুযোগ থাকায় একসঙ্গে ৮ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। ফলে এখান থেকে ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের আমদানি-রফতানির হার বাড়ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণও দ্রুত বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর ধারণক্ষমতার বাইরে গিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম করছে। ব্যাপক সংখ্যক জাহাজ এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য আরও একটি সমুদ্রবন্দরের বিকল্প নেই। মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে একদিকে দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি পণ্যের হ্যান্ডলিং বাড়বে, অন্যদিকে চাপ কমবে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর।
