তিন মাস ধরে শ্মশানে বসবাস
অন্তরালের ‘করোনা হিরো’ টনি ডোম
২৯৬টি লাশের সৎকার
রাজু আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকায় করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া একজনের সৎকারের জন্য লোক পাচ্ছিলেন না স্বজনরা। কারণ, করোনা তখন ‘ভয়ংকর’ এক নাম। শেষ পর্যন্ত তারা লাশটি নিয়ে আসেন নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর কেন্দ্রীয় শ্মশানে। লাশটি সৎকার (দাহ) করতে রাজি হন টনি সনাতন ওরফে টনি ডোম। লাশটির মুখাগ্নি করতে রাজি ছিলেন মৃত ব্যক্তির ছেলে। শেষ পর্যন্ত টনি মুখাগ্নি করেন। কিন্তু করোনায় মৃত ব্যক্তির সৎকার করায় সমাজ তাকে তার ঘরে প্রবেশ করতে দেয়নি। এ কারণে শ্মশানের মন্দিরে তাকে তিন মাস থাকতে হয়েছে।
২০২০ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত টনি একাই করোনায় মৃত ২৯৬ ব্যক্তির দেহ দাহ করেছেন। কিন্তু তিনি লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছেন। প্রচারবিমুখ ‘করোনা হিরো’ টনিকে নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো খবর প্রচারিত হয়নি। সরকার কিংবা উচ্চমহল থেকে তিনি ন্যূনতম ধন্যবাদটুকুও পাননি। নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শ্মশানে কাজ করলেও তাকে কোনো ‘সেফটি’ সরঞ্জামও সরবরাহ করেনি সিটি করপোরেশন। কোনো পিপিই কিংবা ন্যূনতম মাস্কও দেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, করোনা আক্রান্ত কিংবা উপসর্গে মৃত ব্যক্তিকে যখন স্ত্রী-সন্তানরা ধরতে ভয় পেতেন তখন থেকে সৎকার করে যাচ্ছেন লিটন টনি ওরফে টনি ডোম। তাকে সহায়তা করেছে তার তিন ভাই রিপন, নয়ন ও তপন। তবে মহিলা লাশের স্নান (গোসল) থেকে শুরু করে কাপড় পরিধানের কাজটি করেছেন টনির স্ত্রী রানী। করোনায় মৃতদের সৎকারে হাতেগোনা ১-২টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুরু থেকে কাজ করলেও সেসব টিমের সঙ্গেও কাজ করেছেন টনি, তার স্ত্রী ও তার ভাইরা। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে এমন মহৎ কাজটি করে এলেও টনি ও পরিবারের লোকজন রয়ে গেছেন সবার আড়ালে। অবশ্য মৃত অনেকের স্বজনদের কাছে টনি ও তার ভাইরা ‘হিরো’। এমন বেশ কয়েকজন স্বজন জানান, তাদের মনের কথা। অকপটে স্বীকার করেন তাদের অসহায়ত্বের কথা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন জানান, লাশ ধরা তো দূরের কথা, তার বিছানা, আসবাবপত্রও আমরা ছুঁয়ে দেখতে ভয় পেতাম। একজন জানান, হাসপাতালে বাবা করোনায় মারা যান। ভয়ে বাবার লাশও ধরিনি। কিন্তু টনি ডোম লাশের স্নান করিয়েছেন, চিতায় উঠিয়েছেন। আমি শুধু দূর থেকে মুখাগ্নি করেছি। আমার কাছে টনি একজন হিরো। আরেকজন জানান, করোনায় আপন বড় বোন মারা যান। বাড়ি থেকে লাশ নিয়ে শ্মশানে নিয়ে যান টনি ও তার ভাইয়েরা। তাকে স্নান করিয়েছিলেন টনির স্ত্রী রানী। আমাদের ভাই না থাকায় শেষ পর্যন্ত টনিই মুখাগ্নি করেন। যে ডোম বা সৎকারকারীদের আমরা উঁচু-নিচু জাতের দোহাই দিয়ে স্পর্শও করি না, সেই টনিই আমার বোনের মুখাগ্নি করেছেন। করোনা শিখিয়েছে, সবার উপরে মানুষ সত্য। আমার চোখে টনি একজন করোনা হিরো।
টনি জানান, এ পর্যন্ত ২৯৬টি করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মৃত মানুষের সৎকার করেছেন। বাসা থেকে আবার কখনও হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে এসেছি। আমার স্ত্রী রানী সনাতন ধর্মীয় আচাররীতি মেনে মহিলা লাশগুলো øানসহ নানা কাজ করেছেন। আক্ষেপ করে টনি বলেন, এখনো আমাদের কোনো নিরাপত্তা সামগ্রী দেওয়া হয়নি। মাস্ক বা স্যানিটাইজার পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তবে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো ধন্যবাদ পাননি বলে তার কোনো আক্ষেপ নেই। তিনি বলেন, আমি শ্মশান কালী মায়ের ভক্ত। মায়ের জায়গায় থাকি, তিনিই ভালো মন্দ দেখেন। আমি মানুষের জন্য কাজ করি। কে ধন্যবাদ দিল আর কে দিল না তা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই।
