বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে কতবার ও কী শর্তে ঋণ নিয়েছে?
এর আগে ১০ বার ঋণ চাওয়া হয়
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হওয়া বাংলাদেশের এবারই প্রথম নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার সর্বোচ্চ ঋণ চাওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের মুখে বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। এ ঋণ নিয়ে আইএমএফ ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে আলোচনা চলছে। খবর বিবিসির।
গণমাধ্যমে খবর এসেছে-জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার জন্য আইএমএফ বাংলাদেশকে শর্ত দিয়েছে। অতীতেও ঋণ দেওয়ার সময় ভর্তুকি তুলে নেওয়া এবং নানা ধরনের সংস্কারের শর্ত বাংলাদেশকে মানতে হয়েছিল। এবার সরকার এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
ঋণের ইতিহাস : এর আগে আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ ১০ বার ঋণ চেয়েছে। ১৯৭৪ সালে প্রথমবার ঋণ নেয়। আইএমএফের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়-ঋণের জন্য সংস্থাটির কাছে বাংলাদেশ ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সালে সবচেয়ে বেশি গেছে। এ ১০ বছরে বাংলাদেশ পাঁচবার ঋণ নিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না সেজন্য বিভিন্ন সময় ঋণ চাইতে হয়েছিল। এছাড়া ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় দেশটিতে (বাংলাদেশ) সামরিক শাসন থাকায় তেমন কোনো অর্থনৈতিক সংস্কারও হয়নি। ফলে যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
আইএমএফ যখনই বাংলাদেশকে কোনো ঋণ দিয়েছে তখনই তারা কিছু শর্ত বা পরামর্শ দিয়েছে। এসব শর্তের কিছু বাংলাদেশে মেনে নিয়েছে আবার কিছু মেনে নেয়নি। ঋণের ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে আইএমএফের বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। সেসব শর্তের আলোকে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করা হয়। এছাড়া বাণিজ্য উদারীকরণ, ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের শর্তও এসেছিল। এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকও জড়িত ছিল। তখন আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের হয়ে বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি নিজেও এক সময় আইএমএফে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ভ্যাট চালু করার পর প্রথম সাত থেকে আট বছর বেশ ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। এছাড়া বাণিজ্য উদারীকরণের মাধ্যমে আমদানি শুল্ক ব্যাপকভাবে কমানো হয়।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে। এর ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের আমদানি পরিস্থিতির উন্নতি হয় এবং রপ্তানি বাণিজ্যেও সেটির ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। অর্থাৎ আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি করার সক্ষমতা সম্ভব হয়েছে। বাণিজ্য উদারীকরণে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর পর বাংলাদেশে ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগও এসেছিল। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তিও ব্যাপকভাবে যাওয়া শুরু হয়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার তেমন একটা ঘাটতি ছিল না। এসব কারণে ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশের ঋণ সহায়তার প্রয়োজন ছিল না।
আইএমএফের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়-১৯৯১ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশ কোনো ঋণ নেয়নি। ২০০৩ সালে আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশ ঋণ নেয়। সেবার বড় শর্ত ছিল-রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনতে হবে। তখন আইএমএফের শর্ত মেনে আদমজী পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। এ নিয়ে তখন তীব্র বিতর্ক হলেও অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সে সময় আদমজী জুটমিল বন্ধের সিদ্ধান্ত যৌক্তিক ছিল। আদমজী জুট মিলের জায়গায় এখন আদমজী ইপিজেড হয়েছে। সেখান থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে এবং যে পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে সেটি আমাদের অনুমান আদমজী জুট মিল থেকে পাওয়া যেত না। আইএমএফের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়-২০১২ সালে সর্বশেষ ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ। যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১০০ কোটি ডলার। ২০১২ সালে ট্যাক্স পলিসির ক্ষেত্রে কিছু সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। সে সময় নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা হয়। এছাড়া মুদ্রার বিনিময় হার এবং সুদের হার নির্দিষ্ট করে তা কৃত্রিমভাবে ধরে না রেখে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ।
কেন আইএমএফের দ্বারস্থ হয় : সাধারণত যখন কোনো দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে (সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের হিসাবে) বড় রকমের ঘাটতি তৈরি হয় তখন তারা আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যখন কোনো দেশ ঘাটতিতে পড়ে, যখন বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষত ডলারের ঘাটতি তৈরি হয় তখন আইএমএফ ঋণ দিয়ে থাকে। একটা দেশের যখন আর কোনো উপায় থেকে না তখন তারা আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। এ বিষয়কে দুর্ভাগ্যজনক হিসাবে বর্ণনা করেছেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি মনে করেন, আরও আগে থেকে আইএমএফের সাহায্য নেওয়া উচিত ছিল। সর্বোত্তম হচ্ছে তাদের কাছে না যাওয়া। আর সংস্কার যদি করতেই হয় তা নিজেই করে ফেলা উচিত। আইএমএফের শর্ত সব সময় খারাপ-এমন কথা মানতে রাজি নন অনেক অর্থনীতিবিদ। তারা মনে করেন, আইএমএফ চায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভালো হোক। যাতে ঋণ গ্রহণকারী দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা থাকে। আহসান এইচ মনসুর বলেন, ভর্তুকির বিষয়টি যদি এমন একটি পর্যায়ে চলে যায় যখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে তখন আইএমএফ কেন টাকা দেবে? তারা তো ঋণের অর্থ ফেরত চায়।
