বাফুফের নয়-ছয়ের প্রকল্পে অর্থ মন্ত্রণালয়ের না!
jugantor
বাফুফের নয়-ছয়ের প্রকল্পে অর্থ মন্ত্রণালয়ের না!

  মোজাম্মেল হক চঞ্চল  

১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

ফুটবল উন্নয়নের নামে ৫৮৭ কোটি টাকার প্রকল্প বানিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি এঁটেছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। কিন্তু তাদের সেই ফন্দি-ফিকির অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে গেছে। দেশের টাকা লুটপাট হওয়ার আশঙ্কা ছিল ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের। এখন আর সেটা হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় সাফ না করে দিয়েছে এই প্রকল্পের অর্থায়নে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি যুব ও ক্রীড়া সচিবের কাছে লেখা অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব নাছরিন আক্তার স্বাক্ষরিত এক পত্রে (স্মারক নং- ০৭.০০.০০০০.১২৩.১৪.১০৬.২২-৩৮২) এই অসম্মতি জানানো হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মাধ্যমে ১ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ৩০ জানুয়ারি ২০২৭ মেয়াদে বাস্তবায়িতব্য শক্তিশালী জাতীয় ফুটবল দল গঠনের লক্ষ্যে বছরব্যাপী ফুটবল প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রতিযোগিতাসমূহ আয়োজন এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ক্ষমতায়ন শীর্ষক প্রস্তাবিত প্রকল্পটির অর্থায়নে নির্দেশক্রমে আপাতত অর্থ বিভাগের অসম্মতি প্রদান করা হলো।’ ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান ও সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিকই এই প্রকল্পের সব কিছু করেছেন। সঙ্গে ছিলেন বাফুফের বেতনভুক্ত সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ। এখন প্রকল্পে অর্থায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অসম্মতি পত্র আসায় মুখে কুলুপ এঁটেছেন বাফুফের কর্তারা।

দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত বাফুফে ৫৮৭ কোটি টাকার প্রকল্প বানিয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জমা দিয়েছিল। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সেই প্রকল্প পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এই প্রকল্পে চারটি একাডেমির জন্য খরচ ধরা হয় ৩৫৭ কোটি টাকা। বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজনে ৯৭ কোটি টাকা, ছেলে ও মেয়েদের কোচিং স্টাফের বেতন বাবদ ৯৩ কোটি টাকা। ফুটবল উন্নয়নের নামে কোনো তদারকি নেই, অথচ সরকারের কাছে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে বাফুফের আবদার। আগে ১০ থেকে ২০ কোটি টাকার আবদার ছিল বাফুফের। সরকারের বর্তমান মেয়াদের শুরুতে ফুটবল উন্নয়নের জন্য আলাদা ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বাফুফেকে। সেই অর্থের প্রথম কিস্তির ১০ কোটির হিসাব ঠিকমতো দিতে পারেনি বাফুফে। ফলে দীর্ঘদিন আটকে ছিল দ্বিতীয় কিস্তির বাকি ১০ কোটি টাকা।

ফুটবল একাডেমি করার জন্য সিলেটে বিকেএসপি পেয়েছিল বাফুফে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ করে একাডেমির জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে দিয়েছিল। ফিফাও অনুদান দিয়েছিল সাত লাখ ডলার। কিন্তু সেই সাত লাখ ডলার হাপিস করে দিয়েছিল বাফুফে। কয়েকমাস নামকাওয়াস্তে চালিয়ে একাডেমিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অর্থনৈতিক ভাবমূর্তিতে বাফুফে অস্বচ্ছ বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফাতেও। বাফুফের কেনাকাটার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল ফিফা। শোনা যায়, নিজেরাই বেনামী প্রতিষ্ঠান বানিয়ে কোটেশন নেয় এবং নিজেদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা করে বাফুফের অনেক কর্মচারী লাভবান হন। সাবেক ফুটবলার ও সংগঠক প্রয়াত গোলাম রব্বানী হেলালের মাধ্যমে দেশের ফুটবলে বেশ কিছু স্পন্সর এসেছিল। কিন্তু ফেডারেশনের আর্থিক বিভাগের অস্বচ্ছতায় পৃষ্ঠপোষকতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একেক সময় একেক তত্ত্ব বের করে বাফুফে। কয়েক বছর আগে ছিল এলিট তত্ত্ব। ১০ লাখ বা এর বেশি টাকা স্পন্সর করলে বাফুফে এলিট স্পন্সর হিসাবে স্বীকৃতি দিত। অনেক কোম্পানি ও বিত্তবানদের কাছ থেকে এলিট স্পন্সর বাবদ কোটি কোটি টাকা তোলার অভিযোগ ছিল বাফুফের বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালে বাফুফের ব্যাপক দুর্নীতি, নেতৃত্বে ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের কাছে রিপোর্ট দিয়েছিল। অদৃশ্য কারণে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বাফুফের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি নিয়ে দুদকের তদন্ত চলমান রয়েছে। সম্প্রতি কাতার বিশ্বকাপের টেলিভিশন সম্প্রচার নিয়ে বাফুফের শীর্ষ কর্মকর্তারা ব্যাপক আর্থিক কেলেংকারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।

নির্বাহী কমিটিতে আলোচনা ছাড়াই প্রায় ছয়শ’ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চেয়েছিল বাফুফে। এখন প্রকল্পে অর্থায়নে মন্ত্রণালয়ের অসম্মতিতে নড়েচড়ে বসেছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বাফুফের নির্বাহী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘আমরা নির্বাহী কমিটিতে থাকলেও এই প্রকল্পের কিছুই জানি না। আসলে বাফুফে চলে তিন কর্মকর্তা ও এক বেতনভুক্ত কর্মচারীর নির্দেশনায়। এত বড় প্রকল্প কেন তৈরি করা হলো এবং এখন কেনই বা ফেরত আসলো-সব কিছুই আমাদের কাছে ধোঁয়াশার মতো মনে হচ্ছে।’ কাজে নয়, কথার ফুলঝুড়ি ফোটাতে ওস্তাদ বাফুফে কর্তারা। ফুটবল উন্নয়নের নামে বার বার সরকারের কাছে অর্থ চান কর্তারা। কিন্তু দেশের ফুটবলে খরচ হয় না সেই অর্থ। ফলে দেশের ফুটবল আজ মৃতপ্রায়। ফিফা র‌্যাংকিংয়ে অবস্থান ১৯২ নম্বরে। ফিফা, এএফসি, স্পন্সর এবং সরকার-নানা পক্ষ থেকে বাফুফে অর্থ পাচ্ছে। তবে সেই অর্থের সঠিক ব্যবহার কতটুকু হচ্ছে তা নিয়ে সন্দিহান ফুটবলপ্রেমীরা।

বাফুফের নয়-ছয়ের প্রকল্পে অর্থ মন্ত্রণালয়ের না!

 মোজাম্মেল হক চঞ্চল 
১৯ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

ফুটবল উন্নয়নের নামে ৫৮৭ কোটি টাকার প্রকল্প বানিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি এঁটেছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। কিন্তু তাদের সেই ফন্দি-ফিকির অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে গেছে। দেশের টাকা লুটপাট হওয়ার আশঙ্কা ছিল ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের। এখন আর সেটা হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় সাফ না করে দিয়েছে এই প্রকল্পের অর্থায়নে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি যুব ও ক্রীড়া সচিবের কাছে লেখা অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব নাছরিন আক্তার স্বাক্ষরিত এক পত্রে (স্মারক নং- ০৭.০০.০০০০.১২৩.১৪.১০৬.২২-৩৮২) এই অসম্মতি জানানো হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মাধ্যমে ১ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ৩০ জানুয়ারি ২০২৭ মেয়াদে বাস্তবায়িতব্য শক্তিশালী জাতীয় ফুটবল দল গঠনের লক্ষ্যে বছরব্যাপী ফুটবল প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রতিযোগিতাসমূহ আয়োজন এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ক্ষমতায়ন শীর্ষক প্রস্তাবিত প্রকল্পটির অর্থায়নে নির্দেশক্রমে আপাতত অর্থ বিভাগের অসম্মতি প্রদান করা হলো।’ ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান ও সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিকই এই প্রকল্পের সব কিছু করেছেন। সঙ্গে ছিলেন বাফুফের বেতনভুক্ত সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ। এখন প্রকল্পে অর্থায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অসম্মতি পত্র আসায় মুখে কুলুপ এঁটেছেন বাফুফের কর্তারা।

দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত বাফুফে ৫৮৭ কোটি টাকার প্রকল্প বানিয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জমা দিয়েছিল। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সেই প্রকল্প পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এই প্রকল্পে চারটি একাডেমির জন্য খরচ ধরা হয় ৩৫৭ কোটি টাকা। বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজনে ৯৭ কোটি টাকা, ছেলে ও মেয়েদের কোচিং স্টাফের বেতন বাবদ ৯৩ কোটি টাকা। ফুটবল উন্নয়নের নামে কোনো তদারকি নেই, অথচ সরকারের কাছে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে বাফুফের আবদার। আগে ১০ থেকে ২০ কোটি টাকার আবদার ছিল বাফুফের। সরকারের বর্তমান মেয়াদের শুরুতে ফুটবল উন্নয়নের জন্য আলাদা ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বাফুফেকে। সেই অর্থের প্রথম কিস্তির ১০ কোটির হিসাব ঠিকমতো দিতে পারেনি বাফুফে। ফলে দীর্ঘদিন আটকে ছিল দ্বিতীয় কিস্তির বাকি ১০ কোটি টাকা।

ফুটবল একাডেমি করার জন্য সিলেটে বিকেএসপি পেয়েছিল বাফুফে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ করে একাডেমির জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে দিয়েছিল। ফিফাও অনুদান দিয়েছিল সাত লাখ ডলার। কিন্তু সেই সাত লাখ ডলার হাপিস করে দিয়েছিল বাফুফে। কয়েকমাস নামকাওয়াস্তে চালিয়ে একাডেমিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অর্থনৈতিক ভাবমূর্তিতে বাফুফে অস্বচ্ছ বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফাতেও। বাফুফের কেনাকাটার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল ফিফা। শোনা যায়, নিজেরাই বেনামী প্রতিষ্ঠান বানিয়ে কোটেশন নেয় এবং নিজেদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা করে বাফুফের অনেক কর্মচারী লাভবান হন। সাবেক ফুটবলার ও সংগঠক প্রয়াত গোলাম রব্বানী হেলালের মাধ্যমে দেশের ফুটবলে বেশ কিছু স্পন্সর এসেছিল। কিন্তু ফেডারেশনের আর্থিক বিভাগের অস্বচ্ছতায় পৃষ্ঠপোষকতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একেক সময় একেক তত্ত্ব বের করে বাফুফে। কয়েক বছর আগে ছিল এলিট তত্ত্ব। ১০ লাখ বা এর বেশি টাকা স্পন্সর করলে বাফুফে এলিট স্পন্সর হিসাবে স্বীকৃতি দিত। অনেক কোম্পানি ও বিত্তবানদের কাছ থেকে এলিট স্পন্সর বাবদ কোটি কোটি টাকা তোলার অভিযোগ ছিল বাফুফের বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালে বাফুফের ব্যাপক দুর্নীতি, নেতৃত্বে ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের কাছে রিপোর্ট দিয়েছিল। অদৃশ্য কারণে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বাফুফের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি নিয়ে দুদকের তদন্ত চলমান রয়েছে। সম্প্রতি কাতার বিশ্বকাপের টেলিভিশন সম্প্রচার নিয়ে বাফুফের শীর্ষ কর্মকর্তারা ব্যাপক আর্থিক কেলেংকারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।

নির্বাহী কমিটিতে আলোচনা ছাড়াই প্রায় ছয়শ’ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চেয়েছিল বাফুফে। এখন প্রকল্পে অর্থায়নে মন্ত্রণালয়ের অসম্মতিতে নড়েচড়ে বসেছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বাফুফের নির্বাহী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘আমরা নির্বাহী কমিটিতে থাকলেও এই প্রকল্পের কিছুই জানি না। আসলে বাফুফে চলে তিন কর্মকর্তা ও এক বেতনভুক্ত কর্মচারীর নির্দেশনায়। এত বড় প্রকল্প কেন তৈরি করা হলো এবং এখন কেনই বা ফেরত আসলো-সব কিছুই আমাদের কাছে ধোঁয়াশার মতো মনে হচ্ছে।’ কাজে নয়, কথার ফুলঝুড়ি ফোটাতে ওস্তাদ বাফুফে কর্তারা। ফুটবল উন্নয়নের নামে বার বার সরকারের কাছে অর্থ চান কর্তারা। কিন্তু দেশের ফুটবলে খরচ হয় না সেই অর্থ। ফলে দেশের ফুটবল আজ মৃতপ্রায়। ফিফা র‌্যাংকিংয়ে অবস্থান ১৯২ নম্বরে। ফিফা, এএফসি, স্পন্সর এবং সরকার-নানা পক্ষ থেকে বাফুফে অর্থ পাচ্ছে। তবে সেই অর্থের সঠিক ব্যবহার কতটুকু হচ্ছে তা নিয়ে সন্দিহান ফুটবলপ্রেমীরা।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন