বড় অভিমান নিয়ে চলে গেলেন তারামন বিবি
এ কে এম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি শুক্রবার রাত ১টা ২৭ মিনিটে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুর উপজেলার শঙ্কর মাধবপুরে তার বাড়ি। তিনি দীর্ঘদিন ফুসফুস, ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।
তিনি সবার কাছে তারামন বিবি নামে পরিচিত। তারামন বিবির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত একটি অধ্যায়ের অবসান হল।
কারণ তারামন বিবি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অসীম সাহসিকতার যে পরিচয় দিয়েছিলেন তা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
১৯৭১ সালে ১৩ থেকে ১৪ বছরের এক কিশোরী, যাকে কিনা মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করা ও ফুট-ফরমায়েশ খাটার জন্য ক্যাম্পে আনা হয়েছিল, তখন কে জানত একদিন এই কিশোরীই হয়ে উঠবে বাংলাদেশের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ‘প্রতীক মুক্তিযোদ্ধা’।
তারামন বিবির এই বিরল সম্মান অতি সহজেই আসেনি। তার কর্ম, তার সাহস এবং দেশের প্রতি ওই কচি বয়সেই দেশপ্রেমের যে উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন তারই উপযুক্ত পুরস্কার তিনি পেয়েছেন।
‘তারামন বিবি’ এমনই এক প্রতীকী নাম যে, বাংলাদেশের অন্যান্য মহীয়সী নারীর নামের পাশে আজ তার নামটিও উচ্চারিত হয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর এ মহীয়সী নারী দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবির অবদানের কথা নতুন করে এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
সম্মুখ সমরে পুরুষের পাশাপাশি যে ক’জন নারী মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন তারামন বিবি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য এবং সবচেয়ে কম বয়সী মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের যে গ্রাম্যকিশোরী রান্নার সময় নরম হাতের আঙুলে ভাত টিপে পরখ করে দেখত সিদ্ধ হয়েছে কিনা, দেশের প্রয়োজনে সেই কিশোরীই একদিন শক্তহাতে শত্র“ মোকাবেলায় সেই আঙুলেই মারণাস্ত্রের ট্রিগার চেপে ধরেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে তার এই অবদানের জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়ার এই শুভ সংবাদটি সেদিন তারামন বিবির কাছে কেউ পৌঁছাল না। ফলে যা হওয়ার তাই হল।
তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞাতই রয়ে গেলেন এ খেতাবপ্রাপ্তির বিষয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পরও কেউ তার কোনো খবর রাখেনি। তিনি রয়ে গেলেন লোকচক্ষুর সম্পূর্ণ আড়ালে।
ময়মনসিংহ জেলার আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিমল কান্তি দে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি একদিন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দেখতে গিয়ে তারামন বিবির নাম দেখতে পান।
ইতিপূর্বে তিনি তারামন বিবি নামে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত কোনো নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা শোনেননি বা কোনো মিডিয়াতেও দেখেননি। এরপর তিনি তারামন বিবি সম্পর্কে আরও আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং তার খোঁজখবর নিতে শুরু করেন।
অবশেষে ১৯৯৫ সালে কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুরে তারামন বিবিকে আবিষ্কার করেন। এ ব্যাপারে অবশ্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান আলী ও রাজিবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী তাকে সাহায্য করেন।
তারামন বিবিকে খুঁজে পাওয়ার পর চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। সে সময় তাকে নিয়ে পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি শুরু হয়ে যায়। নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে।
অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবির হাতে বীরপ্রতীক খেতাবের স্মারক তুলে দেন।
কর্মস্থলের কারণে তারামন বিবির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে রংপুর সেনানিবাসের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন। তবে তার সঙ্গে আমার বেশি দেখা হয়েছে রংপুর সিএমএইচে।
অসুস্থ হয়ে সিএমএইচে ভর্তি হলে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ত। তার ছেলেমেয়ে এবং ছেলের স্ত্রী ও মেয়ের জামাইও সঙ্গে আসতেন। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আমাদের করতে হতো।
যখন তারামন বিবিকে সিএমএইচে দেখতে যেতাম, স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেয়া ছাড়াও তার সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে অনেক কথা হতো। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই ‘এখন আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালো আছি’ বলতেন। এটা তার বরাবরের উত্তর ছিল।
যেদিন কিছুটা ভালো অনুভব করতেন সেদিন তিনি অনেক কথা বলতেন। দেশবাসীর কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞ ছিলেন তারামন বিবি। প্রায়ই বলতেন, ‘জীবনে এতকিছু পাব আমি কোনোদিনও আশা করিনি। যে সম্মান আমি পেয়েছি সেজন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞ।’
তিনি কয়েকটি সংগঠনের কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা আমাকে ঢাকা নিয়ে গিয়ে যে আদর-আপ্যায়ন করেছেন তাতে অনেক খুশি। এরাই আমাকে দেশজুড়ে এত পরিচিত করেছে। সেসব সংগঠনের সদস্য এখনও কি আপনার খোঁজ নেন, কোনো ফোন কল কিংবা ন্যূনতমপক্ষে কোনো চিঠি? আমি তাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহত দৃষ্টিতে নীরবে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকেন।
তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যান, তিনি তার সহযোদ্ধাদের কথা বলেন। তিনি একাত্তরের অগ্নিঝরা উত্তাল দিনে তার ওস্তাদ মুহিব হাবিলদারের গল্প করেন। আমি লক্ষ করেছি, সহমুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গ উঠলে তিনি কেমন বিষণ্ণ হয়ে যেতেন। ‘দিন আনতে পান্তা ফুরায়’ জীবন নিয়ে তারামন বিবি বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন।
পাল্টা প্রশ্ন করে জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘সবাই না দেশজুড়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলে চিল্লা চিল্লি করে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে... তাহলে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এত বৈষম্য কেন? যুদ্ধের সময় তো আমরা সবাই এক ছিলাম। এখন কেন এমন হল?’’ সরল প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর দেয়া কঠিন ছিল।
উত্তর জানা থাকলেও জবাব দেয়ার সুযোগ ছিল না। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এত সম্মান পাব, বড় বড় নেতাদের পাশে চেয়ারে বসার সুযোগ পাব, দেশের লোকে আমাকে চিনবে, জানবে, এতকিছু চিন্তা করে মুক্তিযুদ্ধে যাইনি।
একসঙ্গে সবাই মরণপণ যুদ্ধ করেছি দেশ থেকে শত্র“দের তাড়ানোর জন্য। দেশ স্বাধীন হল, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক কিছু পেল অথচ আমার সহযোদ্ধারা সেখানেই পড়ে রইল...!’
তারামন বিবির গলা ধরে আসে, ধীরে ধীরে তার কণ্ঠস্বরে যেন আফসোসের সুর শোনা যায়।
তারামন বিবির কথা শুনে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার সতীশ কড়া এবং মিশন রোডের জর্জ দাসের কথা মনে পড়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে অভিমানী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সতীশ কড়া।
সতীশ কড়া সেই উপজাতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ যে সম্প্রদায়টি নীরবেই হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলাদেশ থেকে। মাত্র ১৯টি পরিবার কোনোরকমে টিকে আছে এখনও। সম্প্রদায়টির নাম ‘কড়া’ সম্প্রদায়।
সতীশ কড়াকে সবাই ‘সাতান কড়া’ নামেই ডাকে। তিনি দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার বৈরাগীপাড়ার মানুষ। হাতেগোনা দশ থেকে পনেরটি বসতভিটা নিয়ে এই গ্রাম।
১৯৭১ সালের মার্চে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে মুক্তিযুদ্ধে যেতে অনুপ্রাণিত হন সাতান কড়া। যুদ্ধ শুরু হলে স্থানীয় ইদ্রিস আলী, মজিবর, নূরুল, দেবেন ও জোসেফসহ প্রায় ১১ জনের এক দলের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং শিববাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্প, শিলিগুড়ির পানিঘাটা থানায় প্রশিক্ষণ নিয়ে ৭ নম্বর সেক্টরে ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে হিলি অঞ্চলে যুদ্ধ করেন এবং দেশ স্বাধীন হলে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন।
কিসের জন্য আপনি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, ‘দেশ থেতুর হাম স্বাধীন করোইয়ে, হামার নিজের থেতুল স্বাধীন নাহি করোইয়ে,’ অর্থাৎ নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য স্বাধীনতা এনেছি। সাতানের মুক্তিযাদ্ধার কোনো সার্টিফিকেট নেই।
১৯৮৮-এর বন্যায় স্বাধীনতার পরপর জেনারেল ওসমানীর স্বাক্ষরযুক্ত সনদসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পানিতে ভেসে যায়। এরপর তিনি আর মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেয়ার চেষ্টাও করেননি।
কাগজ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবেন কীভাবে? জিজ্ঞেস করতেই তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘কী হবে ওই কাগুজে সনদ দিয়ে। যুদ্ধ করেছি বঙ্গবন্ধুর ডাকে, দেশ স্বাধীন করেছি- মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এর থেকে বড় কী পাওয়ার আছে! কাগজের সনদ দেখিয়ে সুবিধা লাভের জন্য তো মুক্তিযুদ্ধে যাইনি।’
মহান এই মুক্তিযোদ্ধা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি। একসময় সাতান কড়ার সীমান্তবর্তী চক ফসল গ্রামে ভিটেবাড়িসহ বেশ কয়েক একর জমি ছিল।
ক্ষমতাভোগী কিছু ভূমিদস্যু সাতান কড়ার পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করে জবরদখল করে জমিসহ বসতবাড়িটি নিয়ে নেয়। সমাজের মাথাদের কাছে গিয়ে মাথা খুঁটে এর প্রতিকার চেয়েছিলেন সাতান; কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।
মুক্তিযোদ্ধা সাতান হয়ে যান সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ছেলেমেয়েসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য এদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়।
যাওয়ার সময় পরিবারের সদস্যরা ভারতে চলে যাওয়ার জন্য জোর করলেও বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে রাজি হননি সাতান। এত দুর্বিষহ অত্যাচারের পরও তিনি মাটি কামড়ে পড়ে রইলেন এদেশে।
জর্জ দাস এমনই এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য ছিলেন যার অপর আরও চার ভাই- জেমস এম দাস, রবার্ট আর এন দাস, জন এসকে দাস ও এ্যান্টনি এনএন দাসও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আগে জর্জ তৎকালীন ইপিআরের ল্যান্স নায়েক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জর্জ দাস মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সীমান্ত সংলগ্ন হামজাপুর-শিবপুর এলাকায় প্রায় ৪০০ যুবকের সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গঠন করেন।
ইপিআরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জর্জ দাসের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এই দলটি দিনাজপুরের রামসাগর, ঘুঘুডাঙ্গা, মোহনপুর, বিরলসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন যে, অল্পদিনের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটির নাম হয়ে যায় ‘জর্জ বাহিনী’।
জর্জ বাহিনী উত্তরবঙ্গের পাকিস্তানি সেনাদের অন্যতম ঘাঁটি কুঠিবাড়ি ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার দখলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই অসীম সাহসী অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা জর্জের জীবনের শেষ পরিণতি ছিল করুন।
জর্জ দাস জীবনের বেশিরভাগই অভাব-অনটনে জর্জরিত ছিলেন। বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন।
চার কন্যা এবং এক পুত্র নিয়ে জর্জের বিধবা স্ত্রী ডরথী ঝরনা রানী দাস দুঃখ করে বলেন, ‘জর্জ মারা যাওয়ার পর সবাই কেমন করে যেন তাকে ভুলে গেছে।
এত মুক্তিযুদ্ধের অনুষ্ঠান হয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বড় বড় নেতারা আসেন, তারা কেউ একবারের জন্যও জর্জের নাম মুখে আনেন না!’
বিজয়ের মাসের প্রথম দিনেই আমরা এমন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হারালাম যিনি তার নিজ গুণেই নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীকরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
মারাত্মক রোগে আক্রান্ত এ মহান মুক্তিযোদ্ধা জীবনের শেষ সময়ে এসেও সমাজে অবহেলিত ও নিপীড়িত সহযোদ্ধাদের কথা ভেবে কষ্ট পেতেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর এত বৈষম্য দেখে দুঃখ পেতেন। অথচ আমাদের চোখের সামনেই মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুকে ব্যবহার করে অর্থবৈভবে ফুলে-ফেঁপে সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কিছু লোক।
তারামন বিবি, সতীশ কড়া কিংবা জর্জ দাস এদের কাছে নিমিত্ত মাত্র। খোঁজ নিলে জানা যাবে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্লোগানে’ বিশ্বাসী অনেকেই হয়তো সতীশ কড়া কিংবা জর্জ দাসের মতো মহান মুক্তিযোদ্ধাদের নামও শোনেননি।
যে মহান নেতার উদাত্ত আহ্বানে হাজারও তাজা তরুণ জীবনবাজি রেখে জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আজ তারই স্বাধীন দেশে সতীশ, জর্জ দাসরা হয় নিগৃহীত, অপমানিত।
যে চেতনার ঝড় তুলে নেতারা সমাজের বৈষম্য দূর করবে বলে কথা দিয়েছিল, মানুষের মানবিক মর্যাদা রক্ষা করা হবে বলেছিল কিংবা সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল, তার কোনো প্রতিফলন না দেখে তারামন বিবির মতো সরল মানুষরা দুঃখ পান।
প্রতিবাদে, একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর মতো ঝলসে উঠতে পারেন না বলে কষ্ট পান। হয়তো এতসব ভেবে, কষ্ট পেয়ে, বড় অভিমান নিয়ে তারামন বিবি চলে গেছেন। সতীশ কড়া এবং জর্জ দাসের মতো মহান মানুষরাও বুঝি এমনই করে চলে যান।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা