দেশে প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগের নীরব মহামারী
মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ৩১ মে ২০১৯, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বংশগত রক্তরোগ থ্যালাসেমিয়া দেশে নীরবে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের বিটা-থ্যালাসেমিয়া বেল্টে অবস্থিত হলেও অপ্রতুল গবেষণার কারণে এ রোগটি সাধারণ মানুষের কাছে অপরিচিত।
স্বনামধন্য অরফানেট জার্নাল অব রেয়্যার ডিজিজেস-এ প্রকাশিত (২০১৭) ‘থ্যালাসেমিয়া ইন সাউথ এশিয়া : ক্লিনিক্যাল লেসনস ল্যার্ন্ট ফ্রম বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ১০-১২ ভাগ মানুষ এ রোগের বাহক; অর্থাৎ প্রায় দেড় থেকে দুই কোটির মতো মানুষ তাদের অজান্তে এ রোগের বাহক।
দেশে কমপক্ষে ৬০-৭০ হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু-কিশোর রয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (বিআরএফ)-এর উদ্যোগে পরিচালিত একই গবেষণা নিবন্ধে এই তথ্য উঠে এসেছে। শুধু অসচেতনতার কারণে প্রতিবছর প্রায় ৭-১০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।
আক্রান্ত রোগীর পাশাপাশি পুরো পরিবার মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যের দান করা রক্তই হচ্ছে এই রোগীর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। রোগীকে প্রতি মাসে ১ থেকে ৪ ব্যাগ পর্যন্ত রক্ত নিতে হয়। থ্যালাসেমিয়া সাধারণত অনিরাময়যোগ্য ব্যাধি। রোগীকে নিয়মিত রক্ত দিলেও অনেক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয় যার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। সাধারণত ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে বেশিরভাগ রোগী মৃত্যুবরণ করে। আমাদের উপরোক্ত গবেষণা নিবন্ধ অনুযায়ী থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসা বাবদ প্রতি মাসে প্রায় ১০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয় যার ভার বহন করা বেশিরভাগ পরিবারের সাধ্যের বাইরে।
জিনগত ত্রুটির কারণে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে লোহিত রক্তকণিকা ঠিকমতো তৈরি হয় না। এর ফলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। শিশু জন্মের কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে এই রোগটির লক্ষণ প্রকাশ পায়। এর অন্যতম লক্ষণগুলো হচ্ছে- ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, প্রচণ্ড দুর্বলতা, বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, জন্ডিস, ঘন ঘন সংক্রামক ব্যাধি হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু থ্যালাসেমিয়ার বাহকরা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। বাহকদের কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের তুলনায় থ্যালাসেমিয়া খুব কম খরচে এবং নিশ্চিতভাবে প্রতিরোধ করা যায়। মাত্র কয়েকশ’ টাকা ব্যয় করে জানা যায় আপনি বাহক কিনা। শুধু দু’জন বাহক বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাদের সন্তানে এই রোগটি দেখা দিতে পারে। দু’জন বাহক বিয়ে না হলে কখনও সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হবে না। তাই সচেতনতাই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার।
সমস্যা হচ্ছে দেশের বেশিরভাগ মানুষ এই রোগের নাম-ই শোনেনি! সম্প্রতি বিআরএফের উদ্যোগে জামালপুর জেলার চারটি উপজেলার ১১টি কলেজে ১৫৭৮ জন ছাত্রছাত্রীর ওপর পরিচালিত আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৭.৫ ভাগ ছাত্রছাত্রী থ্যালাসেমিয়া নামক রোগের নাম-ই শোনেনি, যদিও এ জরিপের মাসখানেক আগে ডিজি হেলথ সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের সব মোবাইল ফোনে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে খুদেবার্তা পাঠিয়েছিল! যারা নাম শুনেছেন তাদের সিংহভাগ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রী (৮২.২ শতাংশ)।
অন্যদিকে মানবিক এবং কমার্স বিভাগের ছাত্রছাত্রীর সিংহভাগ নাম শোনেনি। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিজ্ঞান বিভাগের নবম শ্রেণীর বায়োলজির পাঠ্যক্রমে থ্যালাসেমিয়া বিষয়ে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হয়েছে যার ফলে তারা নাম শুনেছে। দেশে প্রায় ২০ ভাগ স্কুল ছাত্রছাত্রী সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করে যারা মূলত শহরকেন্দ্রিক।
দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করেন। যারা এ রোগের নাম শুনেছেন তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা এবং সামাজিক কুসংস্কারাচ্ছনতার কারণে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেন। বাহকরা সুস্থ হলেও সচেতনতার অভাবে প্রায় ৭০ ভাগ ছাত্রছাত্রী বাহকদের সুস্থ মনে করেন না অথবা এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
বিআরএফ এবং বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল (আক্রান্ত সন্তানের পিতামাতা দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান) সাম্প্রতিককালে ৩৬৫ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত পরিবার নিয়ে একটি গবেষণা করে, যেখানে ৬০টি পরিবারে কমপক্ষে দু’জন করে সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ছিল।
সন্তানের মাতা বা পিতাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- আপনারা যদি থ্যালাসেমিয়ার ভয়াবহতার কথা জানতেন, তবে কি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতেন? পূর্ব থেকে এই বিষয়ে জানা থাকলে ৯৭ ভাগ পিতামাতা কখনোই বিয়ে করতেন না যা আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে। প্রায় ৯০ ভাগ পিতামাতা সন্তানের এই রোগ হওয়ার জন্য নিজেদের দোষী ভাবেন। ৪০ ভাগ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত সন্তানের পিতামাতা সামাজিকভাবে অপবাদ বা বঞ্চনার শিকার এবং ৭৭ ভাগ পরিবার সন্তানের জন্য নিয়মিত রক্ত জোগাড় করতে সমস্যার মুখোমুখি হন যা আমাদের গবেষণায় জানা গেছে।
শুধু অবিবাহিত তরুণ-তরুণীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সরকারি উদ্যোগে থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়ের হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস টেস্ট সহজলভ্য করার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে (যখন কথাবার্তা শুরু বা প্রায় পাকাপাকি হয়) থ্যালাসেমিয়া বাহক বা স্ক্রিনিং টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হলে তা কার্যকর প্রমাণিত হয়নি।
বর-কনে দু’জন বাহকের অবস্থা জানার পরও বিয়ে করেছে কেননা শেষ সময়ে পারিবারিকভাবে বিয়ে ভেঙে দিতে চায়নি। প্রসঙ্গত, সৌদি আরবে বিয়ে রেজিস্ট্রির সময় থ্যালাসেমিয়াসহ অন্যান্য রক্তের টেস্ট রিপোর্ট জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সৌদি আরবে কলেজ স্টুডেন্টদের প্রায় ৫০ ভাগ থ্যালাসেমিয়া নামক রোগের নাম-ই শোনেনি! তাই যথাযথ সচেতনতা ছাড়া আইন করে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা দুরূহ ব্যাপার। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের সরকারি পলিসি গ্রহণের সময় এ বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি। সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে গুরুত্ব না দেয়া হলে আমাদের অজান্তে দিন দিন বাহক এবং রোগীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে, যখন সুখী পরিবার গড়ে তোলা চ্যালেঞ্জিং হবে।
মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন : নির্বাহী পরিচালক এবং গবেষক, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; সহকারী অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ (আইইউবি)