প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে ফোঁসফাঁসই সার!
বিমল সরকার
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কারও জন্য কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। একইভাবে সন্দেহ, অনাস্থা আর অবিশ্বাস যে কী ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে তাও অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না। অথচ দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী-পরীক্ষার্থী, শিক্ষকসহ মানুষকে সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, সন্দেহ-অনাস্থা আর অবিশ্বাসের মধ্য দিয়েই চলতে হয়। বছরের পর বছর। পরীক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গোটা জাতিকে এভাবে ভাবিয়ে তুলবে, দুর্ভাবনায় নিমজ্জিত করে রাখবে- এ ছিল কল্পনারও বাইরে। বিষয়টি খুবই অবাঞ্ছিত, অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক।
যে কোনো পরীক্ষা অনুষ্ঠানের পূর্বমুহূর্তে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুতর। আর তা যদি একটি পাবলিক পরীক্ষা হয় তাহলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে লাখ লাখ কিশোর-কিশোরী কিংবা তরুণ-তরুণী পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ যেখানে জড়িত থাকে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টিকে যদি গুরুতর বলা যায়, তাহলে ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টিকে বলতে হবে ভয়াবহ, মারাত্মক এবং একই সঙ্গে অপরিণামদর্শী ও আত্মঘাতীও। অপ্রিয় হলেও সত্য এবং কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, দুটি বিষয়ই দীর্ঘদিন ধরে পৌনঃপুনিকভাবে সংঘটিত হয়ে আসছে আমাদের দেশে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ডিগ্রি পাস, অনার্স ও মাস্টার্স এবং বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি, এইচএসসি, জেএসসি, জেডিসি, পিইসি- সব পরীক্ষার ক্ষেত্রে বলতে গেলে একই পরিস্থিতি। অত্যন্ত লজ্জার কথা, এ ক্ষেত্রে শিশুদের পরীক্ষাও আলাদা করা যাচ্ছে না। পিইসি, ইবতেদায়ি। একই সঙ্গে এখানে উল্লেখ করা যায় বিসিএসসহ বিভিন্ন ধরনের চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথাও। তবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে এমন পরিস্থিতিতেও ঘটনাটিকে আমলে না নেয়া বা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের দীর্ঘ নীরবতা, নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনার বিষয়টি। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর এ বিষয়ে দায়িত্বশীলদের ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি’, ‘এ সবকিছুই গুজব’, ‘উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন’, ‘তদন্ত করে দেখা হবে’, ‘দোষীদের শাস্তি দেয়া হবে’- টেপ রেকর্ডারের মতো মামুলি ধরনের এসব মন্তব্য শুনে সচেতন সবার লজ্জার মাত্রাটিই কেবল বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বেড়ে ওঠে হতাশার পরিধিও। চলমান এসএসসি পরীক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পর অতীতের মতো এবারও এমনটিই লক্ষ করা যাচ্ছে।
এখানে আজ থেকে দুই দশক আগের একটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক মনে করছি। ১৯৯৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের একে একে সব কটি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। স্বভাবতই পরীক্ষায় ব্যাপকহারে নকল, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা হয়। প্রথমদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি’, ‘এ সবকিছুই গুজব’ এবং ‘তদন্ত চলছে’ কিংবা ‘দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে’ ধরনের কথা বলা হয়। শেষ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি প্রমাণিত হল। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের খুঁজে বের করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। সে অনুযায়ী অপরাধীদের খুঁজে বের করার ‘কৃতিত্ব’ এবং একই সঙ্গে ঘোষিত পুরস্কারের টাকা এককভাবে দাবি করে বসে পৃথক দুটি সংস্থা। একটি হচ্ছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন, অপরটি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের এডিশনাল আইজি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে আলাদা আলাদা চিঠিতে ঘোষিত পুরস্কারের ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক তার চিঠিতে বলেন, চট্টগ্রামের একজন এডিসির নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করেছে। পুরস্কারের ৫ লাখ টাকা তাদেরই প্রাপ্য। অন্যদিকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের এডিশনাল আইজি তার চিঠিতে বলেন, এসবির একজন এসএসএ’র নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের গ্রেফতার করেছে। চিঠিতে তিনি পুরস্কারের ৫ লাখ টাকা এসবিকে দেয়ার অনুরোধ করেন। এদিকে একই সঙ্গে দুটি সংস্থা পুরস্কারের টাকার দাবিদার হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে পড়ে যায় মহাবিপাকে। এ মুসিবত থেকে রেহাই পাওয়া এবং বিষয়টি সুরাহা করার জন্য নানা দেনদরবার করতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। শেষ পর্যন্ত ‘ভাগ্যের শিকে’ ছিঁড়ে পড়ে পুলিশ বিভাগের অনুকূলে।
লক্ষ করার বিষয়, সারা দেশের মতো চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ধরার ‘কৃতিত্ব’ ও পুরস্কার দাবি করে দুটি পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয় একই বছরের (১৯৯৮) ডিসেম্বর মাসে। আর ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আড়াই বছর অর্থাৎ ২৯ মাস পর ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যেককে এক লাখ করে মোট পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কার গ্রহণকারী পুলিশ কর্মকর্তারা হলেন- ‘অতিরিক্ত ডিআইজি (অব.) গোলাম কিবরিয়া, অতিরিক্ত এসপি মুহাম্মদ আসগর আলী খান, এএসপি মো. খলিলুর রহমান (পিপিএম), এএসপি মো. খালেকুজ্জামান ও এএসপি মো. আবদুল কাদের খান’।
প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের দোষী সাব্যস্ত করে আইনের আওতায় আনা এবং বিচার করাটা সব সময় কঠিন, দুঃসাধ্য এবং বলতে গেলে অসম্ভব হলেও অভিযুক্ত দু-চারজনকে খুঁজে বের করার ‘কৃতিত্বের’ দাবিদারদের পুরস্কৃত করার জন্য কতিপয় ব্যক্তি সেদিন ব্যস্তত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কারও মনেই এ প্রশ্ন জাগেনি যে, সংশ্লিষ্ট কৃতিত্বের দাবিদারদের আসল কর্তব্য কিংবা দায়িত্বটি তাহলে কী? রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় মাইনে দিয়ে কেনই বা তাদের পোষা হয়? এমন করে ‘বকশিশ’ দিয়ে দিয়ে কাজ করাতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রকেই বা কতদিন সচল রাখা সম্ভব হবে? যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ধরেছিলেন, গ্রেফতার করেছিলেন, তাদের আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করা হয়। এ পুরস্কার গ্রহণ করায় সংশ্লিষ্টদের আমি একটুও দোষ দিই না। যারা পুরস্কার ঘোষণা করলেন এবং সে অনুযায়ী বণ্টনও করলেন কেবল তাদের মানসিকতাটি উপলব্ধি করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানাই। এ যেন অনেকটা ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোনোরকমে সময় পার করা।
এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায়ও অনেকটা অতীতের ধারাবাহিকতাই লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘যথা পূর্বং তথা পরং’। তদন্ত কমিটি গঠন, অপরাধীদের ধরে দিতে পারলে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা, কমিটি সুপারিশ করলে পরীক্ষা বাতিল। ২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষার আগে একে একে অধিকাংশ প্রশ্নপত্রই ফাঁস হয়ে গেলে এ ব্যাপারে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়ার আগে একটি পত্রিকা সম্পাদকীয় কলামে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলে যে, শেষ পর্যন্ত ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ না হয়! আমরা চাই সব সমালোচকের চোখে ধূলি দিয়ে এবার এমন কিছু করা হোক, যাতে একই দুষ্কর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে আর কোনোদিন কেউই সাহস না পায়। কেবল পুরস্কার ঘোষণা ও বিতরণ করলেই হবে না, যেভাবেই হোক সবার মন থেকে অবিশ্বাস, সন্দেহ, অনাস্থা এবং সব ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করতে হবে। এই আত্মঘাতী, অপরিণামদর্শী ও সর্বনাশা খেলা বন্ধ করতেই হবে। আমরা প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সব ধরনের দুর্ভাবনার অবসানে কর্তৃপক্ষের পরবর্তী পদক্ষেপ দেখার অপেক্ষায় আছি।
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক, বাজিতপুর কলেজ; কিশোরগঞ্জ
