Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সাকিবের পাশেই থাকবে বাংলাদেশ

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাকিবের পাশেই থাকবে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার ক্রিকেট সিরিজ আজ থেকেই শুরু। একটি বড় দুর্ঘটনাকে সঙ্গে করেই তিন দিন আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম ঢাকা ছেড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) একটি ভুলের মাশুল হিসেবে এক বছরের জন্য সাকিবকে সব ধরনের ম্যাচ খেলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা কিনা ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে। স্বাভাবিক কারণেই সাকিব দলের সঙ্গে ভারতে যেতে পারেননি। এটি বাংলাদেশ দলের জন্য, সাকিবের জন্য এবং বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য হতাশাজনক। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে, হয়েছে মর্মাহত এবং ভদ্রোচিত ক্ষোভ প্রকাশ করেছে, তুলেছে নানা প্রশ্ন।

প্রাথমিকভাবে যে কোনো খেলাকে যে কোনো মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ও সুস্থতার একটি পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এর ভেতর দিয়েই কেউ কেউ অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে এবং অতিশয় নিপুণতার সঙ্গে খেলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। এ খেলাই যখন আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে তখন তার একটি ভিন্ন চরিত্র গড়ে ওঠে। সেখানে ব্যক্তিগত দক্ষতার বাইরেও একটি জাতীয় মর্যাদার অনুভূতি জাগে। মাতৃভূমির কথা মাথায় রেখে অসাধ্যকে জয় করাও সম্ভব হয়ে ওঠে।

এ বিষয়ে ঢাকার বিক্রমপুরের হীরকসন্তান ব্রজেন দাশকে স্মরণে আনা যায়। তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত সাঁতারু। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১- এ তিন বছরে ৬ বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ এবং ফ্রান্সের উত্তর অংশের সংযোগকারী এ চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ৫৬০ কিলোমিটার, প্রস্থ স্থানভেদে ২৪০ থেকে ৩৩.৫ কিলোমিটার, গভীরতা ২০৭ ফুট এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তার তাপমাত্রা, যা কিনা সর্বনিু ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একবার সেই চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে মাঝপথে তার শরীর ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিল, তিনি নিশ্চিত ছিলেন এ যাত্রায় তার চ্যানেল পাড়ি দেয়া হবে না। কিন্তু পরক্ষণেই ব্রজেন দাশের মনে হল এ জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দেশমাতার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ-ক্ষুণ্ণ হওয়ার বিষয়টি জড়িত।

এ অনুভূতি তাকে বাড়তি শক্তি জোগায় এবং তিনি জয় করেন। আজকেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার আসরে যখন আমাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় এবং জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়, তখন তামাম জনতার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ প্রমাণ দেয় আমরা কতটা শিহরিত। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট দল আমাদের সেই শিহরণের মাত্রায় নিতে সক্ষম হয়েছে। আর বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হয়ে সাকিব আল হাসান আমাদের পরম তৃপ্তির জায়গায় নিয়ে গেছেন- এ নিয়ে কারও দ্বিধা থাকার কথা নয়।

কিন্তু বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন বর্তমানে আগের তুলনায় অনেক বেশি কলুষিত। নানা ধরনের লোভ-লালসা তাকে ঘিরে ধরেছে, ঘটছে বাণিজ্যিকীকরণ। ১৬শ’ শতাব্দীর মধ্যভাগে থমাস মান (১৫৭১-১৬৪১) এবং এন্টনিও সেরার মতো অর্থনীতিবিদরা ‘বণিকবাদী’ চিন্তার অবতারণা করেন। বণিকবাদ ব্যবসা-বাণিজ্যকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিত, ম্যানুফ্যাকচারিংকে দ্বিতীয় এবং কৃষিকে সর্বনিু গুরুত্বের জায়গায় স্থান দিয়েছিল। প্রায় ৪০০ বছর পর আজকের খেলাতেও আমরা বণিকবাদী সংস্কৃতির উপাদান লক্ষ করছি।

টেস্ট, ওয়ানডে, টি ২০, আইপিএল, বিপিএল- হেন কোনো প্রতিযোগিতা নেই যেখানে কর্পোরেট প্রভাব ও মুনাফার ছোঁয়া নেই। খেলোয়াড় কেনাবেচা থেকে শুরু করে ম্যাচ ফিক্সিং সবই এখন মামুলি বিষয়। খেলা নিয়ে অলিগলিতে বাজিখেলা হয়। দিন দিন খেলা তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে হারাচ্ছে, খেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে বৈধ-অবৈধ টাকার পাহাড়। আমাদের সাকিব এ কুসংস্কৃতির শিকার। নিজেকে মুক্ত রাখলেও অন্যের নিরাপত্তায় নিয়োজিত হতে পারেননি কিংবা ভূমিকা রাখতে পারেননি।

আমরা যারা সাধারণ ভক্ত-সমর্থক, তারা অনেকেই আন্তর্জাতিক নিয়মরীতি সম্পর্কে খুব বেশি ওয়াকিবহাল নই, যে কারণে কোনো ধরনের দুর্যোগ দেখা দিলে নিজের মতো করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে অভ্যস্ত। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এখন সাকিব ভক্তদের কাঠগড়ায়। তাদের অনেকেই তাকে খলনায়ক হিসেবে বিবেচনা করছে। সবার ধারণা, এ মুহূর্তে সাকিবের নিষেধাজ্ঞা আরোপে পাপন সাহেবের হাত রয়েছে। ভক্তকুল ক্ষোভে-দুঃখে ফেসবুক ও যোগাযোগ মাধ্যমে পাপনের ক্যাসিনোসংশ্লিষ্ট ছবিও প্রচার করছে। পাপন সাহেব আদৌ এর সঙ্গে জড়িত কিনা তা আমি জানি না।

তবে ক্রিকেটারদের সঙ্গে তার অপ্রত্যাশিত আচরণ ভক্তদের এমনটি ভাবাতে বাধ্য করেছে হয়তো। দিন পনের আগে ১১ দফা দাবিতে ক্রিকেটাররা আন্দোলনে মাঠে নামে। তাদের সব দাবিই ছিল যৌক্তিক এবং বিসিবি সে দাবির বেশিরভাই মেনে নেয়। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে পাপন সাহেব যে ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা আমাদের প্রত্যাশার মধ্যে ছিল না। সন্তানতুল্য ক্রিকেটারদের প্রতি তিনি অনেকটাই অসহিষ্ণু ছিলেন, এমনকি ওই আন্দোলনে তিনি ‘ষড়যন্ত্রের’ গন্ধও খুঁজে পান। ঠিক এ সময়েই সাকিবের এ দুঃসংবাদে অনেকে পাপন সাহেবকে দায়ী করছেন। এটা দেশবাসীর অন্যায় আচরণ নয়, পাপন সাহেবকেই প্রমাণ করতে হবে তিনি জড়িত ছিলেন না। সেক্ষেত্রে সাকিবই হতে পারেন তার একমাত্র সহায়ক ব্যক্তি।

আমরা জানি ঘটনাটি একদিনে ঘটেনি। ২০১৮ সালের ১৯ ও ২৩ জানুয়ারি এবং ২৬ এপ্রিল বাজিকরদের কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাবের কথা সাকিব আইসিসি বা বিসিবিকে জানাননি, গোপন করেছেন। এর বছরখানেক পর ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি এবং ২৭ আগস্ট আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটের জিজ্ঞাসাবাদে সব দোষ স্বীকার করে নেন সাকিব; আর তার ফলেই ২৯ অক্টোবর এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যান তিনি। সাকিব নিজেও হয়তো জানতেন, যে কোনো সময় একটি খারাপ খবর আসতে পারে।

সাকিব আল হাসান খোলাখুলিভাবেই বলেছেন, ‘যে খেলাটাকে আমি ভালোবাসি, সেটা থেকে নিষিদ্ধ হওয়ায় আমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। তবে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাবের বিষয় না জানানোর কারণে আমাকে দেয়া নিষেধাজ্ঞা আমি পুরোপুরি মেনে নিচ্ছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মুখ্য ভূমিকা পালনে আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ইউনিট খেলোয়াড়দের ওপর আস্থা রাখে এবং এ ক্ষেত্রে আমি আমার দায়িত্ব পালন করিনি। বেশিরভাগ খেলোয়াড় ও ভক্তদের মতো আমিও ক্রিকেটকে একটি দুর্নীতিমুক্ত খেলা হিসেবে পেতে চাই। আমি আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ইউনিটের সঙ্গে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হতে চাই এবং কোনো তরুণ ক্রিকেটার যেন আমার মতো ভুল না করে, সেটা নিশ্চিত করতে চাই’ (যুগান্তর; ৩০.১০.২০১৯)।

সাকিবের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে আইসিসির মহাব্যবস্থাপক আলেক্স মার্শাল বলেছেন, ‘সাকিব আল হাসান খুবই অভিজ্ঞ একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। তিনি আইসিসির অনেক শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন এবং ধারা অনুযায়ী বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে অবগত আছেন। ফিক্সিংয়ের প্রতিটি প্রস্তাবই তার জানানো উচিত ছিল। সাকিব তার ভুল স্বীকার করেছেন এবং তদন্তে পুরোপুরি সহায়তা করেছেন। ইন্টিগ্রিটি ইউনিটকে ভবিষ্যৎ শিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি, যাতে করে তরুণ ক্রিকেটাররা তার ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। আমি তার কাছ থেকে এ আশ্বাস পেয়ে খুশি।’ এখানে বৈরী আচরণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

এতখানি আলোচনার একটাই কারণ হল, সাকিব যেন কোনোভাবেই মানসিকভাবে ভেঙে না পড়েন। একজন খেলোয়াড় যত দক্ষই হোন না কেন, যদি মানসিক শক্তি দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে তার পক্ষে পারফরম করা সম্ভব হয় না। আমরা চাই না সাকিবকে নিয়ে কোনো টানাহেঁচড়া হোক। সাকিবকে কারও মনগড়া প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা আমাদের ক্রিকেটকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সবার মানসিক স্তরকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে।

যেহেতু আমাদের সাকিব কোনো অন্যায় করেননি, করেছেন ভুল; তাই একটা টোকেন শাস্তি হতেই পারে। তবে মনে রাখতে হবে ভুলের মাশুল যেন অন্যায়ের মাশুলের সমান না হয়। ২০১০ সালে ইংল্যান্ড সফরকালে স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে পাকিস্তানের ক্রিকেটার আমির, সালমান বাট ও মোহাম্মদ আসিফ ৫ বছরের জন্য ক্রিকেট থেকে বহিষ্কৃত হন। পরবর্তী সময়ে তাদের শাস্তির মেয়াদ ৬ মাস কমিয়ে আনা হয়। আমাদের সাকিব সে অর্থে কোনো অপরাধই করেননি বরং আইসিসিকে তদন্তে সহায়তা করেছেন, নিজের সততার প্রমাণ রেখেছেন। সুতরাং একটা ভুলের খেসারত হিসেবে তার শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে আনার নিবেদন তো আমরা করতেই পারি। সেক্ষেত্রে বিসিবির যদি কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে, তাহলে তা আন্তরিকভাবেই করা উচিত।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

সাকিব

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম