বাঙালি গর্জে ওঠো

 পবিত্র সরকার 
০৮ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

অবিশ্বাস্য, অভাবনীয়, অকল্পনীয়, অভূতপূর্ব- অভিধান আর থিসরাস মন্থন করে আরও বেশকিছু বিশেষণ এভাবে পরপর সাজানো যায়- একদিনে দুই বাঙালির কীর্তি অর্জন সম্বন্ধে- অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

পাঠকরা আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি নোবেল পুরস্কার আর ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হওয়াকে এক করে দেখছি না। কিন্তু আপামর, বিশ্বব্যাপী বাঙালির পক্ষে দুটোই খুব আনন্দ আর গর্বের ঘটনা।

এ দুই ব্যক্তি কেউ আমার ঘনিষ্ঠ বা পরিচিত নন; কিন্তু আমি বাঙালি। আমি অর্থনীতি বুঝি না, ক্রিকেট তার চেয়েও কম বুঝি; কিন্তু আমি বাঙালি। এদের কাজের আর জিজ্ঞাসার জায়গার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু আমি বাঙালি। এদের কীর্তির থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে আমার অবস্থান; কিন্তু আমি বাঙালি।

যদিও আমি মনে করি, নোবেল পুরস্কার মানুষের মনীষার একটা অর্জন এবং ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য কাজ করবে, শুধু বাংলার জন্য নয়; তবুও আমি বাঙালি। অভিজিতের স্ত্রী সহ-প্রাপক এস্তার দুফ্লো আর মাইকেল ক্রেমারকেও অভিনন্দন।

কিন্তু অভিজিৎ বিনায়ক আর সৌরভ- এ দু’জন মূল্যবান মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন, বাংলার সংস্কৃতি আর জীবন বা যাপন উৎসের সঙ্গে যোগ ছিন্ন করেননি, তাই আমি, সব বাঙালির মতোই, গর্বিত।

আমি এ-ও যোগ করি যে, সৌরভের বিষয়টি ভারতীয় বাঙালিদের পক্ষে যত গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশের জন্য তত নয়। এটিও আপামর, বিশ্বব্যাপী বাঙালির অহঙ্কারের বিষয় যে, বাংলাদেশ এক স্বাধীন দেশ, তার নিজস্ব ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আছে, এবং আছে দুরন্ত, টগবগে বাঙালিদের এক ক্রিকেট দল, যাদের এগারোজন মাঠে নেমে পৃথিবীর যে কোনো শক্তিশালী দেশকে হারিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, এই সেদিন টি-টোয়েন্টিতে শক্তিশালী দেশ ভারতকে করুণভাবে হারিয়ে যেমন দেখাল।

কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ সংস্থায় কোনো বাঙালি তো এতদিন অধ্যক্ষ হয়নি। নানা কারণে শোনা যায়, এই ভারতে ক্রিকেটে বাঙালিদের প্রতি নানাভাবে অবিচার হয়েছে, বা পশ্চিম ভারত একটু বেশি সুযোগ পায়। প্রাদেশিক না হয়েও বলা যায়, ‘দাদা’র এই সম্মানে পুব ভারতের গুরুত্ব কিছুটা বাড়ল।

অভিজিতের বাবা, প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি বিখ্যাত অধ্যাপক হিসেবে শুধু নয়, চমৎকার সেতারবাদক হিসেবেও জানতাম।

তার মায়ের সঙ্গেও আমার দু’-একবার নানা সভা-সমিতিতে দেখা হয়েছে। সৌরভের সঙ্গেও দেখা হয়েছে, অর্থাৎ আমিই তাকে বেশি দেখেছি। এরা সবাই আমাকে আদৌ জানতেন বা দেখেছেন কিনা তা নিয়ে কড়া প্রশ্ন তোলাই যায়। কিন্তু ওই যে বলেছি- আমি বাঙালি।

তাই একবার শ্রীযুক্ত অমিত শাহকে খুশি করে আমার হিন্দিতে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘একবার গরবসে কহো, হম্? বঙ্গালি হ্যায়।’

এদের কৃতিত্বে আমার কোনো দান নেই, কোনো ভূমিকা নেই। বস্তুতপক্ষে রামমোহনের সতীদাহ-নিরোধ থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ, সত্যজিৎ রায়ের গোল্ডেন লায়ন ইত্যাদি কোনো কিছুতেই আমার কোনো অংশ ছিল না, থাকলে সেটা ফলাও করে সবাইকে বলে বেড়াতাম। এ রকম বেশিরভাগ কীর্তিমান বাঙালির কৃতিত্বে আমার কোনো ভূমিকাই ছিল না বা নেই। আমার মতো বেশিরভাগ বাঙালিরই নেই। কিন্তু আমি বাঙালি, এক ভাষায় কথা বলি, কাজেই তাদের গৌরব থেকে ধার করা গৌরবে আমি গর্বিত হই, এতে আমারে আটকায় কেডা?

আমি এমন কথাও বলছি না যে, এই দুটি সংবাদে অন্য ভারতীয়দের খুশি হওয়ার সম্ভাবনা বা অধিকার নেই। তাদের দুটিই আছে। অধিকার আছে অভিজিতের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মস্থলের সঙ্গত গৌরববোধ করার, দেশেরও।

কেউ যদি খুশি না হন, যেমন আজকের কাগজে দেখলাম অভিজিতের খবরে কেউ কেউ হননি, সেটি তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা, তার সমাধান তাদেরই করতে হবে- দরকার হলে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার পরামর্শ নিয়ে, আর তাতে সুবিধা না হলে মনোবিদের সাহায্য নিতে পারেন। আমার সে ধরনের কোনো সমস্যা নেই।

সৌরভের ব্যাপারে কেউ কেউ রাজনীতির কথা তুলেছেন, আমি সে কথাও তুলব না। যে ছেলেটিকে ভারতীয় ক্রিকেটে এক সময় চূড়ান্ত অবিচারের শিকার হতে হয়েছিল (আমিও পশ্চিমবঙ্গের একটি পত্রিকায় লিখেছিলাম ‘ওই ছেলেটাকে দ্যাখো’ বলে একটি লেখা), আজ সে দেশের ক্রিকেট প্রশাসনের শীর্ষে বসেছে।

এ বড় মধুর প্রতিশোধ। ‘প্রতিশোধ’ কথাটা লেখার আগে দ্বিধা করছিলাম; কিন্তু কম্পিউটারে কি-বোর্ড এটাকেই তুলে সাজিয়ে দিল, আমাকে দাবড়ানি দিয়ে বলল, খবরদার! অন্য কোনো শব্দ দিয়ে এটাকে বহিষ্কার করার চেষ্টা করবে না। ‘প্রতিশোধ’ই থাকবে, বহাল তবিয়তে। আমার কিচ্ছু করার ছিল না। এই কি-বোর্ডের চাবি টিপেই আমাকে বেঁচে থাকতে হয়।

কয়েক বছর আগে আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পেয়েছি নোবেল গৌরবের মধ্যে। সৌরভ আগে থেকেই বাঙালির ‘আইকন’ ছিল, আমরা আরেকটি আইকন পেয়ে গেলাম, অভিজিৎ বিনায়ক।

এমন নয় যে বাঙালির আইকনের অভাব আছে, বা ‘এখন কম পড়িতেছে’। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে অজস্র আইকন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে বাঙালির ময়দানে, তাতে এক অসময় বাঙালি খুব তল্লাই পেয়েছে।

আমরা এখনও ‘রেনেসাঁস’, ‘রেনেসাঁস’ করে বুক চাপড়াই, আর ভারতের অন্যদের অকারণে একটু অনুকম্পার চোখে দেখি, কলকাতাকে ‘ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী’ বলে ছেঁদো গর্ব করি এটা না বুঝে যে, ভারতের অন্যরাও এখন যথেষ্ট এগিয়ে গেছে।

বাংলাদেশও এগিয়ে গেছে- সংস্কৃতি, এমনকি ক্রীড়া-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে অসামান্য কৃতিত্ব দেখাচ্ছে তারা। বিদ্যাবত্তায় হোক, খেলাধুলায় হোক, সমাজসেবায় হোক, সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে হোক, অন্য ভারতীয়রা বা বাংলাদেশের বাঙালিরা পিছিয়ে নেই। কাজেই ফালতু অহঙ্কারের কোনো জায়গা নেই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের জন্য। এই করে আমরা নানান জায়গায়

মারও খাচ্ছি।

কিন্তু অভিজিৎ বিনায়ক ও সৌরভের এই দৃষ্টান্ত আমাদের এ মুহূর্তে খুব জরুরি ছিল বলেই মনে হয়। এতদিন বাঙালি ছেলেমেয়েদের কাছে আমরা ‘রোল মডেল’ হিসেবে বেশিরভাগ সময় ঊনবিংশ শতাব্দীর মনীষীদের কথাই তুলে ধরেছি, এখনও ধরি।

সেটা নিশ্চয়ই দরকার, সেই শতাব্দীর পরোপকারের আদর্শ, সামাজিক আর নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দুর্জয় লড়াই, লোকের চাপানো সত্যের বাইরে নিজের অন্তরের সত্যের জন্য প্রাণপণ সন্ধান- এ সবই আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে শিক্ষণীয়, তাদের কথা নিশ্চয়ই তারা পড়বে, তাদের আদর্শের সার কথাটা বোঝার আর অনুসরণ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমার কখনও কখনও মনে হয়, তারা একটু দূরবর্তী, ইতিহাস তাদের একটু পুরাণবদ্ধ করে দিয়েছে, যদিও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন।

অভিজিৎ বিনায়ক আর সৌরভরা সে তুলনায় আমাদের ঘরের কাছের, চেনা সময়ের দৃষ্টান্ত। তারা প্রায় আমাদের প্রতিবেশী হতে পারত। তারা দেখিয়েছে যে, মেধা আর প্রতিভার সঙ্গে অসম্ভব নিষ্ঠা আর পরিশ্রম যদি মেলে, সেই সঙ্গে একটা কিছুতেই না-হারার জেদ যদি থাকে কোথাও পৌঁছানোর জন্য, তাহলে সেই লক্ষ্যটা ক্রমশ অভ্রান্তভাবে কাছে আসতে থাকে। অনেক সময় ওই জেদ আর পরিশ্রম মেধারও ক্ষতিপূরণ করে। আমি তাই মনে করি,

আমাদের পরের প্রজন্ম, যারা একটা কঠিন সময় জীবনের জন্য তৈরি হচ্ছে, তাদের জন্য, বিশেষত বাঙালি ছেলেমেয়েদের জন্য, সময় আর পৃথিবী এ দুটি চমৎকার উপহার সাজিয়ে দিল।

অবশ্য ওরা দুজনই সচ্ছল ঘরের সন্তান, ওরা পরিবার ও প্রতিবেশের যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু সেটাই সব নয়।

সেখানে অখ্যাত গ্রামের গরিব বালক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বা পরে কাজী নজরুল ইসলামের দৃষ্টান্তও তো আছে। এসব দেখে যেন আমাদের ছেলেমেয়েরা বোঝে, বড় স্বপ্ন দেখার জন্য সাহস আর জেদটা দরকার। ইতিহাস আর বর্তমান দুই-ই তাদের উদ্বুদ্ধ করুক।

পবিত্র সরকার : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন