ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের রূপান্তরকালীন চ্যালেঞ্জ
সাজ্জাদ আলম খান
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্ষুদ্রঋণ। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রায় চার দশক ধরে ক্ষুদ্রঋণের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চলছে। টেকসই উত্তরণও হচ্ছে। সমালোচনা-পর্যালোচনা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই গতি পেয়ে আজ ক্ষুদ্র অর্থায়ন জগতে প্রবেশ করেছে। বছরে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা হাতবদল হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা, এমআরএ’র সনদ পেয়েছে সাতশ’ প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের মডেল বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। অনুসরণ করা হচ্ছে অনেকে দেশে। কিন্তু আঁতুড়ঘরেই যেন অনেকটাই অনাদৃত ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রম। এ নিয়ে হীনম্মন্যতাও কাজ করে এ খাতের নীতিনির্ধারকদের। গবেষণার মাধ্যমে জানান দিতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে ক্ষুদ্র অর্থায়নের অভিঘাত কী?
উন্নয়ন অর্থনীতির অন্তপ্রাণ ড. আতিউর রহমানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষণা কর্ম তুলে এনেছে সম্ভাবনাময় এ খাতের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের বিষয়টিও। তবে বোদ্ধা মহলে জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্ন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, এটাকে ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে/আমরা তখনো বসে/বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি/ফিকাহ ও হাদিস চষে।’- এভাবে দেখা যেতে পারে।
দারিদ্র্য হচ্ছে বহুমাত্রিক সমস্যার উর্বর ভূমি। শুধু ক্ষুদ্র অর্থায়ন দিয়ে এখান থেকে উত্তরণ ঘটানো যাবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি-প্রশিক্ষণ দিয়ে অগ্রগতি করতে হবে। এ নিয়ে সামাজিক গবেষণাগারে কাজ চলছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন সংগঠকদের মধ্যেও যেন দুটি ধারা। এক পক্ষ মনে করে থাকে, দারিদ্র্য উত্তরণে ম্যাজিক বুলেট হচ্ছে ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রম।
আর এক পক্ষ মনে করছে, এ ধরনের অর্থায়নের সফলতা খুব একটা নেই। মধ্যবর্তী অবস্থান ধারণ করেন এমন ধারা বেশ দুর্বল। কারও কারও মতে সমাজ বিদ্রোহের রাশ টানতে এ উদ্যোগ। আর কেউ কেউ বলছেন, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে বেঁধে, কর্তাব্যক্তিদের আখের গোছানোর কর্মযজ্ঞ এটি। কিন্তু এসব সমালোচনায় তেমন পাত্তা না দিলেও ক্ষমতাহীন মানুষকে বেড়ে ওঠার স্বপ্ন সঞ্চারিত করেছে। তাদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি, বাজার তৈরিতে রেখেছে বড় ভূমিকা।
বাংলাদেশে এমএফআইয়ের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রভাব মূল্যায়ন করেছে উন্নয়ন সমন্বয়। ১৬টি জেলার ৩২টি উপজেলা থেকে প্রায় ২ হাজার সদস্যের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল সময়কে জরিপের আওতাভুক্ত করা হয়। সদস্যদের তিন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়। আয়, ব্যয়, খাবার গ্রহণ সক্ষমতা ও দরিদ্রতা বিবেচনায় নেয়া হয় গবেষণা কর্মে।
পরিবারের গড় মাসিক আয় ২৩ শতাংশ উন্নীত হয়েছে। নন সদস্যদের তুলনায় আড়াই শতাংশ বেশি। পরিবারে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত খরচের ক্ষেত্রে সদস্য নয় তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবারে খাদ্য বাবদ খরচ বেড়েছে ৫ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত খরচ কমেছে ৫ শতাংশ। স্বল্পমেয়াদি ঋণী সদস্যদের ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবারে খাদ্য বাবদ খরচ বেড়েছে ৬ শতাংশ।
সদস্য নয় তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সপ্তাহে মাছ ও মাংস খাওয়া বেড়েছে। পরিবারে তবে স্বল্পমেয়াদি ঋণী সদস্যদের ক্ষেত্রে বাড়ার হারটা বেশি। পরিবারে সপ্তাহে ডিম, দুধ ও ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সদস্য নয় তাদের ক্ষেত্রে খাওয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণী সদস্যদের ক্ষেত্রে বাড়ার হার বেশি। জরিপে দু’ধরনের দরিদ্রতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, উচ্চ ও নিম্নমাত্রার দরিদ্রতা। স্বল্পমেয়াদি ঋণগ্রহীতা সদস্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উচ্চ মাত্রার দরিদ্রতা কমেছে দেড় ভাগের বেশি।
দীর্ঘমেয়াদি ঋণী সদস্যের ক্ষেত্রে দরিদ্রতা কমেছে দেড় ভাগ। বার্ষিক অতি দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নন সদস্যদের ক্ষেত্রে অতি দরিদ্রতা হ্রাস পেয়েছে দশমিক ২ শতাংশ। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণী সদস্যের ক্ষেত্রে দশমিক ৮ ভাগ এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণী সদস্যদের ক্ষেত্রে দশমিক ৯ ভাগ। প্রাণিসম্পদ, শস্য উৎপাদন, সম্পদ ক্রয়, ব্যবসা সম্প্রসারণ, বৃক্ষরোপণ, নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগ ও মোটরসাইকেল ক্রয় খাতে বিনিয়োগের হার জরিপে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে মোটরসাইকেল ক্রয়ে। স্বল্পমেয়াদি ঋণী সদস্যদের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদি সদস্যদের সব পর্যায়ে সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন একটি মইয়ের মতো, যার কতগুলো স্তর থাকে। এতে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা যায়। সময়ের আবর্তে ঋণ চাহিদা বাড়ে এবং ধীরগতিতে দারিদ্র্যবিমোচন হয়। সম্পদ সৃষ্টি হলেই তো হবে না, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় অনেক সময় ধরে স্থিতিশীল হবে। তাহলে দারিদ্র্যবিমোচনের একটি পর্যায় হতে পারে। এর একটি সামাজিক দিকও রয়েছে।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্রঋণ সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার কিনা সে প্রশ্নটি নানা সময়ে উচ্চারিত হয়। এ গবেষণায় সেসব বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রায় ৫ কোটি মানুষের সম্পৃক্তায় এ খাত এখন বিকশিত হচ্ছে। বছরে হাতবদল করছে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা; কিন্তু এখানে কী পরিমাণ উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
কর্মসংস্থান তৈরিতে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব কী, তা-ও স্পষ্ট হতে পারত এ গবেষণার ভেতর দিয়ে। এখন ক্ষুদ্রঋণ থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে রূপান্তর ঘটছে। ঋণ আয়বর্ধনের অর্থনৈতিক উপাদান মাত্র। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, পুষ্টি, সামাজিক ন্যায়বিচার, সহমর্মিতার অনুশীলনেও কাজ করছে বিভিন্ন এমএফআই। ইন্সটিটিউট অব মাইক্রো ফাইন্যান্সের গবেষণা বলছে, গ্রামীণ অর্থনীতিভিত্তিক জিডিপিতে ক্ষুদ্রঋণের অবদান সোয়া আট থেকে ১১ শতাংশ।
বাংলাদেশের জাতীয় সরকারের প্রায় ১৪টি মন্ত্রণালয় ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে বিভিন্ন মডেলে বা বিভিন্ন ক্রেডিট লাইনে। এমনকি এক মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিভিন্ন দফতর, অধিদফতর ও পরিদফতর বিভিন্ন ক্রেডিট লাইন অনুশীলন করে থাকে। সরকারের ভেতরেও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নিয়ে আছে ধোঁয়াশা। নীতিনির্ধারকদের অনেকেই এর কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তবে পুরোপুরি এ আর্থিক কার্যক্রমকে এড়িয়ে যান না। ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহার সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সরকার।
২০২৫ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি গ্রামে সমন্বিত সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০৩০ সালে দারিদ্র্য ও ভিক্ষুকমুক্ত গ্রাম করতে নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রাম থেকে শহর এলাকাকে সুসংগঠিত টেকসই, আত্মনির্ভরশীল দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, ভিক্ষুকমুক্ত এলাকায় রূপান্তরের জন্য দ্বৈততা পরিহার করা প্রয়োজন।
দারিদ্র্য ও ভিক্ষুকমুক্ত গ্রাম বাস্তবায়নের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য মন্ত্রণালয় দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এতে করে একই ব্যক্তি একাধিক মন্ত্রণালয়ের ঋণ সুবিধা গ্রহণ করছেন।
আবার ঋণ পাওয়ার যোগ্য অনেকেই ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক করে সুবিধাভোগী পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করার কথা ভাবছে সরকার। প্রতি পরিবার থেকে ১ জন করে সদস্য নিয়ে ২০ থেকে ২৫ জনের কর্মদল গঠন করা হতে পারে। যারা দলভিত্তিক ঋণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে স্বাবলম্বী হবে।
এ ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়েও ঋণ দেয়া হবে। সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা ঋণ পাবেন। বার্ষিক গড় আয়ের ভিত্তিতে পরিবারগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হচ্ছে। বার্ষিক আয় ১ লাখ টাকা ‘ক’ শ্রেণিতে, ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় ‘খ’ শ্রেণি এবং আড়াই লাখ টাকা যাদের বার্ষিক আয় তাদের ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। এরপর যারা তুলনামূলক বেশি দরিদ্র বা অসচ্ছল তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ দেয়া হবে।
কমার্শিয়াল মাইক্রোফাইন্যান্স- বাংলাদেশেও কড়া নাড়ছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ আছে। এর কী ধরনের অভিঘাত সমাজ ও অর্থনীতির পড়বে তা বিশ্লেষণও বেশ জরুরি। ক্ষুদ্রঋণের বাজারও গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান আগলে রেখেছে। ৫৫ শতাংশ বাজার ধরে রেখেছে মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান। ১০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে ৯০ শতাংশের বেশি বাজার। কিন্তু সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সাতশ’র বেশি। এ অসম অবস্থারও রূপান্তর প্রয়োজন।
সাজ্জাদ আলম খান : অর্থনীতি বিশ্লেষক
sirajgonjbd@gmail.com
