শুধুই কি হা-হুতাশ করব?
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের সমাজ এখন চরম অবক্ষয়ের পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। হেন সামাজিক অপরাধ নেই যা বাংলাদেশে হয় না। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, খুন, রাহাজানি, ঘুষ-দুর্নীতি, মিথ্যাচার, মাদক ব্যবসা ও মাদকাসক্তি, বিবাহবিচ্ছেদ বৃদ্ধি, দুর্বিনীত আচরণ, ধন-সম্পদের নোংরা প্রদর্শনী, পরীক্ষায় নকল করা, পেশাজীবীদের দায়িত্বে অবহেলা, কর্মক্ষেত্রের শৃঙ্খলা মেনে না চলা, রাষ্ট্রের প্রাপ্য পরিশোধে অবহেলা, দেশ দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও সম্পদের অপচয়, কাজ সম্পন্ন না করে ঠিকাদারদের বিলের অর্থ নিয়ে নেয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃক এ অর্থ পরিশোধ, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালন না করা।
সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য, প্রতিপক্ষকে হয়রানির জন্য মিথ্যা মামলার আশ্রয় নেয়া, কোনো কোনো ধর্মীয় নেতার অধার্মিক আচরণ, রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের জন্য বেহিসাবি ব্যয়, সম্পদশালীদের তোষামোদ, জ্ঞানী ও বিদ্বান ব্যক্তিদের প্রতি বিরাগ, রাষ্ট্র পরিচালনায় নৈতিকতার প্রতি অবজ্ঞা এবং অনৈতিকতাকে সব কাজের চালিকাশক্তিতে পরিণত করা, নদী-খাল ও বনসহ অভিন্ন মালিকানাধীন সম্পদগুলো দখল, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা।
জনগণকে ভোট প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং ভোটের মাধ্যমে ম্যানডেট না পেয়েও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়া, রাষ্ট্রের আমলাদের নিয়ম-বিধির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন এবং ওপরওয়ালাদের মর্জিমাফিক আচরণ ইত্যাদিসহ বহু দৃষ্টান্ত দেয়া যায়, যা বলে দেয় সমাজ আর সমাজ নেই। সমাজ ডুবে গেছে অনৈতিকতা ও অসামাজিকতার নোংরা আবর্জনার মধ্যে।
এমন একটি সমাজে সাধারণ নাগরিকের অবস্থা কী দাঁড়াবে? সে কি কোনোরকম ভালো কাজে উদ্যোগী হবে? নাকি অনৈতিক ও অবাঞ্ছিত কাজের প্রতি আকৃষ্ট হবে? অনৈতিকতা, অসততা, বর্বরতা এবং অধার্মিকতা যখন একটি সমাজের সামাজিক রীতিতে পরিণত হয় তখন সেই সমাজ শুধু বন্ধ্যা হয়ে যায় না, সমাজটি ক্রমান্বয়ে ধ্বংস ও চরম বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে আমাদের সমাজের সবকিছুই কি এতই খারাপ যে আমরা শুধু এর মধ্যে পচন ও দুর্গন্ধ দেখতে পাব? এত অবক্ষয়ের মধ্যেও কিছু কিছু ভালো কাজ হয় না তা হয়তো বলা যাবে না।
কিন্তু যতটুকু ভালো কাজ হয়, সমাজ যদি সুস্থ থাকত তাহলে তার শতসহস গুণ ভালো কাজ হতে পারত। কারণ তখন গোটা সমাজের প্রতি যে সিগনালটি যেত সেটা হল, ভালো কাজ করো, ভালো কাজ করলে মানুষের প্রশংসা ও শ্রদ্ধা পাবে। সমাজ তোমাকে আদর্শ নাগরিকরূপে বিবেচনা করবে এবং তোমার মতো ভালো কাজ করতে আরও শতসহস জন অনুপ্রাণিত হবে। আমরা কথায় কথায় বলি, সুশাসন মানে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন।
সুশাসন, সুকর্ম ও সৎ কর্মে নিরন্তর উৎসাহ জোগায় এবং দুষ্কর্ম ও দুর্বৃত্তপনাকে প্রতিনিয়ত বারিত করে। সুশাসন সমাজে শিষ্ট চক্রকে (virtuous cycle) গতিময় করে এবং দুষ্ট চক্রের (vicious cycle) গতিরোধ করে দেয়। এভাবেই সম্ভব হয় সুন্দর সমাজ গঠন, এভাবে পৃথিবীতে গড়ে ওঠে স্বর্গের মতো সুখময়, শান্তিময়, গ্লানিহীন, পাপহীন পরিবেশ।
ছোটবেলায় কবি ফজলুল করিমের লেখা একটি কবিতা পড়েছিলাম। এ কবিতার দুটি ছত্র ছিল : কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর/মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতেই সুরাসুর। কবির এই ছত্র দুটি আমাদের পরীক্ষায় ভাব সম্প্রসারণের জন্য বলা হতো। আমরা আমাদের সাধ্যমতো এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যগুলো সহজ ভাষায় বর্ণনা করার চেষ্টা করতাম। প্রায় সব ধর্মেই (একমাত্র বৌদ্ধ ধর্ম বাদে) স্বর্গ ও নরকের ধারণাটি আছে।
ইহজীবনে যারা ভালো কাজ করে, ধর্মের বিধানগুলো মেনে চলে, তারা পরকালে স্বর্গের অনন্তসুখে পুরস্কৃত হবে। অন্যদিকে যারা পৃথিবীর জীবনে খারাপ কাজ করে, পাপাচারের লিপ্ত হয়, লোকের অনিষ্ট করে তাদের জন্য রয়েছে পরকালের নরক যন্ত্রণা। কবি ফজলুল করিম বহু বছর আগে ভাবতে পেরেছিলেন ধর্মে বর্ণিত স্বর্গ ও নরকের ধারণার বাইরে গিয়েও আমরা এ পৃথিবীতে স্বর্গ কিংবা নরকের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি। সমাজবদ্ধ মানুষ যখন ভালো কাজ করে, মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকে, পরোপকারে ব্রতী হয়, সৎকাজ, সৎচিন্তা, সত্য উচ্চারণ এবং সৎসঙ্গের সন্ধানী হয় তখন এ সমাজ, এই পৃথিবী স্বর্গের মতোই আনন্দময়, সুখময় ও শান্তিময় হয়ে ওঠে।
আবার যখন সমজের মানুষ অপকর্ম, অনাচার, অত্যাচার, পরস্ব অপহরণ, ঘৃণা, মোহ, মদ ও মাৎসর্য ইত্যাদিতে মত্ত ও নিমগ্ন হয়ে পড়ে, তখন সমাজটাকে মনে হয় নরকতুল্য। কাজেই আমাদের এ পৃথিবী, এ ইহকাল কতটা স্বর্গ ও নরকের কাছাকাছি হবে সেটা নির্ভর করে আমরা আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে প্রস্ফুটিত করতে পারছি কিনা তার ওপর। অথবা মোহের বশবর্তী হয়ে এগুলোর বিনাশ সাধন করছি কিনা তার ওপর।
ছোটবেলায় এ ধরনের আরও কবিতা পড়তে হতো। যেমন, বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে, তবু একা রয়ে যাব কর্তব্য সাধিতে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় অতীতের সমাজ ব্যবস্থাগুলোর তুলনায় জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও সম্পদ সৃষ্টিতে যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে তার জন্য ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছে অন্তরপ্রেনরশিপ বা ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Entrepreneurship. এই অন্তরপ্রেনরের মধ্যে ফ্র্যাঙ্ক নাইটের ভাষায় নিহিত থাকে ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা এবং মুনাফা। অন্তরপ্রেনরদের ঝুঁকি গ্রহণের সাহস অনিশ্চয়তার পথে পাড়ি দেয়ার প্রবণতা পুঁজিবাদকে তার নিজস্ব অবয়বে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
পুঁজিবাদী সমাজের অনেক কিছুই নিন্দনীয় হলেও এ সমাজ যে অন্তরপ্রেনর শ্রেণি সৃষ্টি করেছে অথবা অন্তরপ্রেনর শ্রেণি এ সমাজ সৃষ্টিতে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্য দিয়েই পৃথিবী প্রবেশ করেছে নতুন এক যুগে। ষোড়শ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত পৃথিবীর যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তার চেয়েও বহুগুণ অগ্রগতি হয়েছে পুঁজিবাদ ও অন্তরপ্রেনরদের দুঃসাহসী উদ্যোগের ফলে। এরা সেই ধাতুতে গড়া মানুষ যা তাদের এমন কিছু করতে বা এমন কিছু গড়তে অধ্যবসায়ী করেছে যা অন্যরা করতে একেবারেই সাহসী হয়নি বরং ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
আবিষ্কার ও অভিযানের যুগে যখন উত্তর মেরু আবিষ্কৃত হয়, আফ্রিকার ভিক্টোরিয়া হ্রদ আবিষ্কৃত হয়, অস্ট্র্রেলিয়া আবিষ্কৃৃত হয় এবং নতুন বিশ্ব তথা আমেরিকা আবিষ্কৃত হয়- এসব আবিষ্কারের জন্য যারা চরম প্রতিকূলতার মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাদের দুঃসাহস পুঁজিবাদী দুনিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে।
সোজা কথায়, সাধারণরা যা করতে সাহস পায় না, অন্ততপ্রেনররা তা শুধু করেনই না বরং এর সুফল প্রদর্শন করে সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেন এবং নিরুদ্যমী নিরুৎসাহীদেরও উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহী করেন। বাংলাদেশে এমন দৃষ্টান্তের প্রয়োজন আছে। তবে এর ঘাটতি বিশাল। এ দেশে যে দুঃসাহসী মানুষ নেই এমন নয়।
দারিদ্র্যের কশাঘাতে পড়ে এ দেশের অনেক যুবক আফ্রিকার মরুভূমি পার হয়ে উত্তাল ভূ-মধ্যসাগরে নড়বড়ে নৌযানে চড়ে ইউরোপ যেতে চান ভাগ্য গড়তে তারা কি কোনো অংশে ভাস্কো দাগামা, ম্যাজিলান এবং কলম্বাসের তুলনায় কম দুঃসাহসী? জীবনটাকে তারা হাতের মুঠোয় নিয়ে অজানার পথে পাড়ি জমান।
এ রকম মানুষ যে দেশে আছে সে দেশে সঠিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে এবং সঠিক প্রেরণাদায়ী নেতৃত্ব থাকলে কী না করা সম্ভব? অথচ দেশটাতে এসব সম্ভব করার উপাদানই যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। সেটাই আমাদের বিপর্যয়ের কারণ। সেটাই সব সামাজিক অবক্ষয়ের উৎস।
সুশাসকের কাছে জনগণ সব দায়িত্ব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত থাকে। এ জন্য তার মধ্যে কোনো বেদনাবোধ থাকে না। এটাকেই টমাস হব্স (১৫৮৮-১৬৭৯) বলেছেন, এর অবস্থান সম্মতি অথবা সহমতের ঊর্ধ্বে। এটা সবার সত্যিকার একতার প্রতিফলন।
একজন মানুষকে অন্যসব মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে এমন দায়িত্ব দেয় এবং এমনভাবে দায়িত্ব দেয়, যাতে সব মানুষ সবাইকে বলতে পারে, I authorize and give up my right of governing myself, to this man, or to this assembly of men, on this condition, that thou give up thy right to him, and authorize all his action in like manner. This done, the multitude so united in one person, is called a COMMONWEALTH, in Latin CIVITAS, This is the generation of the great LEVIATHAN, or rather, to speak more reverently, of that mortal god, to which we owe under the immortal God, peace and defense.
আমরা তো আমাদের সমাজের মঙ্গল ও হিতের জন্য এমন একজন মানুষকে দায়িত্ব দিতে চাই এবং যার কাছে আমাদের সব স্বাধীনতা অর্পণ করতে চাই যিনি হবেন অবিনশ্বর ঈশ্বরের অধীন একজন নশ্বর ঈশ্বরের মতো যার কাছে সকল দায়দায়িত্ব আমরা আমাদের নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য হস্তান্তরিত করতে পারি। কিন্তু সমাজ কেন এমন মানুষ তৈরি করতে পারছে না? এর কারণ আমরা
এখন পুঁজিবাদের সবচেয়ে নষ্ট সময়ের মধ্যে বাস করছি, যাকে বলা হয় আদিম সঞ্চয়নের পুঁজিবাদ বা লুণ্ঠন ও দখলদারিত্বের পুঁজিবাদ। এ থেকে পরিত্রাণ পেলেই আমাদের এ দেশটি হয়তো একদিন স্বর্গতুল্য হবে। না হলে, মাঝখানের সময়টাতে সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিকতাহীনতায় দারুণভাবে ভুগতে হবে। আমরা শুধু হা-হুতাশ করব, এ রকম তো কখনও দেখিনি।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
