Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জানি আলো আসবেই

Icon

ডা. ফেরদৌস খন্দকার

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জানি আলো আসবেই

ছবি: সংগৃহীত

পরপর দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রথম ঘটনায় বলব, ফারুক নামে ২২ বছর বয়সী এক তরুণের কথা। নিউইয়র্কে জেএফকে এয়ারপোর্টে একটি রেস্টুরেন্টের কিচেনে কাজ করতেন। ফলে তাকে খুব বেশি বাইরের মানুষের সংস্পর্শে আসতে হতো না।

তিন সপ্তাহ আগের কথা বলছি। তখনও সেই অর্থে লকডাউন হয়নি। একদিন ফারুক নিজের কাজের বিরতির সময় কিছুটা ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাইরে বের হয়ে করিডরে বসে ছিলেন। এর দুই দিন পর তিনি আমার চেম্বারে এলেন। শরীর খুব খারাপ।

হাঁচি, কাশি এবং জ্বর নিয়ে। দেখেই বুঝতে পারলাম তার করোনা সংক্রমণ হয়েছে। কিন্তু ফারুক আমার কথাকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে চলে গেলেন। এমনকি পরের দিন তিনি আবারও কাজে গেলেন। এরও তিন দিন পর খবর পেলাম তরতাজা তরুণটি হাসপাতালে, আইসিইউ’তে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।

দ্বিতীয় ঘটনাটি বলব, আমার একজন ডাক্তার সহকর্মীকে নিয়ে। তিনি খুব ধার্মিক মানুষ। একদিন তিনি নামাজে যাওয়ার জন্য অজু করেছেন।

সেদিনের জন্য শেষ রোগীটি দেখতে এলেন। বয়স্কমতো একজন এসেছেন জ্বর, কাশি এবং অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে। তাড়াহুড়ায় কেন জানি করোনা পরিস্থিতির কথা ভুলে গেলেন আমার ওই ডাক্তার বন্ধুটি। তিনি প্রথমে মাস্ক ছাড়াই রোগী দেখা শুরু করেছিলেন।

হঠাৎ বিষয়টি নজরে এলো তার। তখন মাস্ক পরলেন বটে, তবে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সেই ঘটনার তিন দিনের মাথায় বয়স্ক সেই রোগী মারা যান। আর চার দিনের মাথায় আমার ডাক্তার বন্ধুটি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নয় দিনের মাথায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় ভয়াবহ সেই পরিস্থিতির মুখ থেকে অবশ্য ডাক্তার বন্ধুটি শেষ পর্যন্ত ফিরতে সক্ষম হয়েছেন।

এ দুটো ঘটনা বলার কারণ রয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই অবহেলাজনিত বিষয় রয়েছে। প্রথম ঘটনাটির সেই তরুণ সতর্ক হলে, এতটা ভয়াবহ অবস্থায় হয়তো পড়তেন না। কিংবা ইতোমধ্যে তার মাধ্যমে আরও কেউ সংক্রমিত হয়েছে কিনা, তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।

অন্যদিকে ডাক্তার বন্ধুটি হয়তো সচেতন থাকতে পারতেন। হয়তো তাকে এমন জীবনমৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেতে হতো না। আরও অনেক মানুষ তার সেবা পেতেন।

এ লেখাটি আমি লিখছি বাংলাদেশের তরুণদের উদ্দেশ্য করে। কারণ এখনও খবর পাচ্ছি অনেকে বাড়িতে থাকার, নিজেদের আলাদা করে রাখার নিয়ম মেনে চলছেন না। অনেকে হয়তো মনে মনে ভাবছেন, এ ভাইরাস তাকে ধরবে না।

কিন্তু মনে রাখবেন কেউই করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা থেকে মুক্ত নয়। শহরে তো বটেই, গ্রামে দলবেঁধে মানুষ নাকি চায়ের স্টলে আড্ডা দিচ্ছেন এখনও। যুব সমাজ নাকি ইতোমধ্যেও মাঠে নেমে ক্রিকেট খেলছে।

জানি, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। খোলা ময়দানে মুক্ত বাতাসে সবার ঘুরে বেড়ানোরই তো কথা। কিন্তু সময় খারাপ। এসব এখন করা যাবে না। এ সময়ের জন্য এমনটাই বার্তা। কঠিন হলেও মানতে হবে।

করোনার এ সময়টা বড়ই অদ্ভুত! বলা হয় স্যোশাল ডিসটেন্সিং বা সামাজিক দূরত্বই এ রোগ থেকে একে অন্যকে মুক্ত রাখতে পারে। ফলে প্রকৃতির এমন রহস্যময় আচরণের সময়ে নিজেদের আড়াল এবং ঘরবন্দি করে রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ নয়। তবুও সময়ের প্রয়োজনে এটা আমাদের করতে পারতেই হবে।

বয়স্ক এবং একেবারে শিশুরা হয়তো এ পরিস্থিতি একটু সহজেই মেনে নিতে পারছেন। কিন্তু বয়সে যারা তরুণ তাদের ঘরে রাখা একটু কঠিন। কিন্তু উপায় নেই। থাকতে হবে। আসলে সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ এবং যোদ্ধা বদলায়।

ফলে এখনকার যুদ্ধে তরুণদের অবশ্যই একটা বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। এটি সেই অর্থে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। ফলে দলে বলে সবাই মাঠে নেমে ত্রাণ বিতরণ কাজে অংশ নেবে, এমনটা সম্ভব নয়।

এ যুদ্ধের ধরনটা ভিন্ন। এতে অবশ্যই নিজেকে আড়ালে রাখতে হবে। সেই কঠিন কাজটা কিভাবে করবেন তার জন্য কিছু পরামর্শ আমি নিজের মতো করে তুলে ধরছি।

এক. প্রথমত গোটা পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। বিশেষ করে বেশ কিছুদিন বন্ধুদের ছাড়া ঘরের ভেতরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কাজটি করতে পারতে হবে।

দুই. এ সময়টায় আপনি নিজেকে সময় দিন। নিজের সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া করুন। হয়তো নিজেকে এমনভাবে অনেকদিন সময় দেয়া হয়নি আপনার। এখন সুন্দর আগামীর জন্য একটা প্ল্যান তৈরি করুন।

তিন. দিনের ২৪ ঘণ্টা এলোমেলো না থেকে, গোটা সময়টাকে বিভিন্ন সেগমেন্টে ভাগ করে নিন। ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার সময়টা নির্ধারিত হওয়া উচিত। এছাড়া খাবারের সময় থেকে শুরু করে অন্য কাজগুলোর জন্য রুটিন প্রস্তুত করাই ভালো হবে।

চার. প্রচুর বই পড়তে পারেন এ সময়টায়। তাছাড়া অনেকে হয়তো দূরশিক্ষণের মাধ্যমে ক্লাস করছেন। সেদিকে মনোযোগ দিতে পারেন।

পাঁচ. ভালো কিছু মুভি দেখা যেতে পারে। সেটিও করুন পরিকল্পনা অনুযায়ী। সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যমের যথেচ্ছ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কিছু সময় অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা যেতে পারে। সেটাও পরিকল্পনার অংশ হিসেবে।

ছয়. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সময়টায় প্রচুর গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ফলে গুজবে কান দেয়া এবং গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে আপনার যেন কোনো ভূমিকা না থাকে। তথ্য পেতে হলে অবশ্যই অথেনটিক সোর্স থেকে নিতে হবে।

সাত. বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে, ভিডিও ফোনে আড্ডা দেয়া যেতে পারে। এতে করে হয়তো আপনার মনটা প্রফুল্ল থাকবে।

আট. ভাইবোন কিংবা বাবা-মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়া, আড্ডা দেয়া যেতে পারে। কিছু ডমিস্টিক গেমস আছে, যেগুলো খেলা যেতে পারে। দাবা, লুডু, ক্যারম ইত্যাদি খেলায় মন দিতে পারেন। ভিডিও গেমও খেলা যেতে পারে। তবে যেন সেগুলো ধ্বংসাত্মক না হয়।

নয়. অবশ্যই বাড়ির কাজে সহায়তা করতে হবে। এতে পরিবারের সবার সঙ্গে এক ধরনের আত্মিক বন্ধন তৈরি হবে।

দশ. নিয়ম করে হালকা ব্যায়াম করতে হবে। বেশ কিছুদিন একটানা ঘরে থাকার কারণে নিজের মধ্যে এক ধরনের আড়ষ্টতা তৈরি হতে পারে। অবসাদ আসতে পারে। ব্যায়াম এক্ষেত্রে আপনাকে মুক্তি দিতে পারে।

ডা. ফেরদৌস খন্দকার : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ; এমডি, এফএসিপি মাউন্ট সিনাই হাসপাতাল, নিউইয়র্ক

 

করোনা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম