Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বোরো ধান সংগ্রহের পরিমাণ আরও বাড়ানো উচিত

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বোরো ধান সংগ্রহের পরিমাণ আরও বাড়ানো উচিত

২০ এপ্রিল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকার চলতি অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত বোরো থেকে ২০ লাখ ২০ হাজার টন ধান-চাল সংগ্রহ করবে।

এর মধ্যে রয়েছে ৮ লাখ টন ধান, ১২ লাখ ২০ হাজার টন চাল (সিদ্ধ চাল ১০ লাখ টন এবং আতপ চাল ২ লাখ ২০ হাজার টন)। এর আগে ৮ এপ্রিল সরকার চলতি মৌসুমে উৎপাদিত বোরো থেকে ছয় লাখ টন ধান, সাড়ে ১১ লাখ টন চাল অর্থাৎ মোট সাড়ে ১৭ লাখ টন বোরো ধান-চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়।

কেজিপ্রতি ধানের দাম ২৬ টাকা, সিদ্ধ চালের দাম ৩৬ টাকা এবং আতপ চালের দাম ৩৫ টাকা নির্ধারিত হয়েছে। ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে চাল সংগ্রহ শুরু হওয়ার কথা। চাল সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

যেসব বিষয় সরকারকে অনেক বছর ধরে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে ধান-চাল সংগ্রহ এবং দাম নির্ধারণে প্রভাবিত করে আসছে সেগুলো হল- এক. ধান কাটা ও ঘরে তোলার মৌসুমে বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখা; যাতে ধানচাষী, বিশেষ করে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন চাষীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন এবং অধিক পরিমাণে ধান উৎপাদনে উৎসাহী হন।

দুই. খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ গড়ে তোলা। তিন. বাজারে চালের দাম বাড়লে সরকারি মজুদ থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস) ও ন্যায্যমূল্যের দোকানে চাল বিক্রির মাধ্যমে দাম স্থিতিশীল রাখা। চার. সরকারের লক্ষ্যমুখী খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন। পাঁচ. কৃষক পর্যায়ে ধান উৎপাদন ও চালকল মালিক পর্যায়ে চাল তৈরির খরচ বিবেচনায় নিয়ে সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ।

চলতি বছরে ঘোষিত বোরো সংগ্রহ নীতিমালার বৈশিষ্ট্যাবলির মধ্যে রয়েছে- ক. গত বোরো মৌসুমের তুলনায় ধান সংগ্রহের পরিমাণ বাড়লেও ৫ মার্চ সমাপ্ত আমনের তুলনায় কম পরিমাণ ধান সংগ্রহ করা; খ. সংগ্রহতব্য ধান-চালের দাম গত বোরো মৌসুমের পর্যায়ে রাখা; গ. আগের মতো চাল সংগ্রহে মিলারদের ওপর নির্ভর করা; ঘ. গত আমন মৌসুমের মতো খাদ্য অধিদফতরে তালিকাভুক্ত কৃষকদের কাছ থেকে লটারির মাধ্যমে বোরো ধান সংগ্রহ করা; ঙ. চলমান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধান-চাল সংগ্রহ করা।

উপর্যুক্ত নীতিমালার একাধিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক. সরকারি তথ্য মোতাবেক, চলতি বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবাদি জমির লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর। বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে বলে আশা করা যায়।

বোরোর সম্ভাব্য উৎপাদনের তুলনায় কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহের পরিমাণ আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। সরকার চাষীদের কাছ থেকে সংগৃহীত ধান খাদ্য অধিদফতরে তালিকাভুক্ত মিলমালিকদের দিলে তারা চুক্তিতে নির্ধারিত মূল্যে সরকারকে চাল সরবরাহ করবে।

দুই. একাধিক কারণে এবার ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ বেড়ে যাবে। করোনা মহামারীর জন্য কৃষি শ্রমিক সংকটের কারণে এবার শ্রমিকের মজুরি অন্য বছরে তুলনায় অনেকটা বেড়ে গেছে। তাছাড়া, দীর্ঘায়িত খরার কারণে বোরো ধানচাষীদের, বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের সেচ বাবদ ব্যয় বেড়েছে।

তাই এ বছর বোরো ধান আবাদ ও কেটে ঘরে তুলতে কৃষকদের আর্থিক ব্যয় অনেকটা বেড়ে যাবে। ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষী পরিবারগুলো ফসল উৎপাদন কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি। এরা ধারদেনা করে ফসল ফলান। এদের সংসারে নানা অভাব-অনটন লেগেই আছে।

এরা চাল বিক্রি করেন না। ধারদেনা পরিশোধ এবং সংসারের নানা অভাব-অনটন মেটাতে তাদের মৌসুমের শুরুতেই ধান বিক্রি করতে হয়। তাই কেজিপ্রতি ধানের দাম গত বছরের ২৬ টাকা থেকে এক টাকা বাড়িয়ে এবার ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হলে ধানচাষীরা, বিশেষ করে ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র ধানচাষীরা কিছুটা উপকৃত হতেন এবং ধানচাষে উৎসাহ পেতেন।

প্রচলিত অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ নীতিমালায় সরকার চাল সংগ্রহের জন্য চালকল মালিকদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ২০০৬ সালের জাতীয় খাদ্যনীতিতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য কেনার বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন চালকল মালিকরা।

তারা অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। তারা অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহে চালের উচ্চমূল্য দাবি করেন এবং ধান কেনায় সরকারকে নিরুৎসাহিত করেন অথবা ধানের দাম কম রাখার জন্য সরকারকে চাপ দেন। কারণ সরকার ধান না কিনলে বা স্বল্প পরিমাণে কিনলে ধানের দাম কম থাকে এবং তারা কম দামে ধান কিনে বিপুল মজুদ গড়তে পারেন।

ধান কাটার মৌসুম শেষে যখন ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের কাছে ধান মজুদ থাকে না, তখন চালকল মালিকরা মজুদ ধান চালে রূপান্তর করে চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে সরবরাহ করেন এবং সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অবশিষ্ট চাল উচ্চমূল্যে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করেন।

এতে ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র ধানচাষীরা শুধু ধানের ন্যায্য দাম পাওয়া থেকেই বঞ্চিত হন না, ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুম শেষের কিছুদিনের মধ্যে ক্রেতায় রূপান্তরিত অধিকাংশ ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র ধানচাষী উচ্চদামে চাল কিনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

দেশবাসী কবে নাগাদ তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে- এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এই মুহূর্তে কারও জানা নেই। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের কয়েকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, আগামী মে মাসে দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বেশ বড় আকার ধারণ করতে পারে।

আর বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছেন সিঙ্গাপুর ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের ডেটা ড্রাইভেন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকরা। তারা বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ভাইরাসটির পুরোপুরি বিদায় নিতে জুন পর্যন্ত সময় গড়াতে পারে।

এদিকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বড় আকারের দুর্ভিক্ষ হতে পারে এবং এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাতে পারে। এর পেছনে কৃষি উৎপাদন হ্রাস এবং অনেক দেশ খাদ্যশস্য রফতানি বন্ধ করে দেয়ার আশঙ্কাকে কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে।

প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলেও তা বাহ্যিক আঘাত (এক্সটার্নাল শক) সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। চাল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আমন ফসলটির উৎপাদন অনেকটা প্রকৃতিনির্ভর।

প্রলয়ঙ্করী বন্যা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ ফসলটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নজিরের অভাব নেই। ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যা, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরের একাধিক প্রলয়ঙ্করী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় সিডর কীভাবে আমন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করেছিল, তা আমরা ভুলিনি।

আগামী আমন ফসল যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাছাড়া, হাওরাঞ্চলের চলতি বোরো ফসল কেটে নিরাপদে ঘরে তোলা নিয়ে এখনও শঙ্কা কাটেনি।

খাদ্য চাহিদায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গম। পণ্যটির বার্ষিক চাহিদা কম-বেশি ৭০ লাখ টন। আমরা উৎপাদন করি ১২ থেকে ১৩ লাখ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ২৩ মার্চ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি খাতে ৫১ লাখ ৭৪ হাজার টন গম আমদানি করা হয়েছে। করোনার কারণে রফতানিকারক দেশগুলো থেকে খাদ্যশস্যের রফতানি বন্ধ বা সীমিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা, বড় বড় আমদানিকারক দেশগুলোর বাড়তি খাদ্যশস্যের চাহিদা এবং আগামী আমন চাষে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শস্যটির উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে সরকারি-বেসরকারি খাতে কমপক্ষে দুই লাখ টন চাল এবং প্রয়োজনীয় অবশিষ্ট গম আমদানির দ্রুত ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শুধু বেসরকারি খাতে চাল আমদানি করতে হলে তাদের কিছুটা শুল্ক সুবিধা দিতে হতে পারে।

সবশেষে বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রী অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে ২০ লাখ টন বোরো ধান-চাল সংগ্রহের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সরকারের গুদামে চালের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলে দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী চালকল মালিক ও বড় চাল ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের দাম বাড়াতে পারবে না। চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকবে। কষ্ট ও পরিশ্রম করে যে ধানচাষীরা ধান উৎপাদন করে, সবার আগে তাদের স্বার্থ দেখতে হবে। এর ফলে তারা আরও বেশি ধান উৎপাদনে উৎসাহী হবেন।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

ধান

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম