Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সাধারণ ছুটির ফাঁদে

Icon

মো. ফিরোজ মিয়া

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাধারণ ছুটির ফাঁদে

অস্বীকার করার উপায় নেই, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, হংকংসহ যেসব দেশ করোনা সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে, ওইসব দেশের নাগরিকদের মতো আমাদের দেশের নাগরিকরা সচেতন নয়। এছাড়া ওইসব দেশের প্রশাসনের মতো দক্ষতা আমাদের প্রশাসন দাবি করতে পারে না।

যার কারণে ওইসব দেশের মতো করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আমরা তাদের মতো সফল হতে পারব এটা আশা করা যায় না। এছাড়া ওইসব দেশ মহামারী প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের উহানের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসে যেসব দেশ বা শহর অতীতে মহামারী প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের সফলতা লাভ করেছে, তাদের কর্মকৌশল পর্যালোচনা করে করোনা মোকাবেলার সুসংগঠিত ও সমন্বিত কর্মকৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও রোডম্যাপ প্রণয়ন করে কাজে নেমেছে এবং সফলতাও পেয়েছে আশানুরূপ। তাদের অর্থনীতিতেও খুব বড় ধাক্কা লাগেনি। কিন্তু তাদের মতো আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সুসংগঠিত ও সমন্বিত কোনোরূপ কর্মকৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও রোডম্যাপ প্রণয়ন করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেবল একের পর এক এডহক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এবং এসব সিদ্ধান্তও বাস্তবতার নিরিখে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এরূপ এডহক সিদ্ধান্তের একটা বড় উদাহরণ হল কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ মোকাবেলা ও এর ব্যাপক বিস্তার প্রতিরোধকল্পে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ২৪ মার্চ এক প্রজ্ঞাপন দ্বারা ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি অর্থাৎ পাবলিক হলিডে ঘোষণা করা। যদিও ওই প্রজ্ঞাপনে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসকে সরকারি ছুটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা যথাযথ হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে এ সাধারণ ছুটিকে পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং এ ছুটি কতদিন বহাল রাখতে হবে এবং এ থেকে বেরুনোরই বা উপায় কী, তা-ও হয়তো চিন্তা না করেই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে বলে মনে হয়। যার কারণে দেশ এখন সাধারণ ছুটির ফাঁদে আটকা পড়েছে। এ উভয় সংকটের ফাঁদ থেকে বেরুনো খুব একটা সহজ হবে না।

সরকারি ছুটি এবং সাধারণ ছুটির মধ্যে অনেক পার্থক্য। সরকারি ছুটি কেবল সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য। অপরদিকে সাধারণ ছুটি বা পাবলিক হলিডে দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের জন্য প্রযোজ্য। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় যেন তা দেশের জনসাধারণ উপভোগ করতে পারে, যেমন- ঈদের দিনের, স্বাধীনতা দিবসের ছুটিসহ সরকারি পঞ্জিকায় উল্লিখিত অন্যান্য সাধারণ ছুটির দিন। সাধারণ ছুটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি সেবা ছাড়া অন্যসব অফিস-আদালত, দোকানপাট, কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু অতীতের মতোই বন্ধ হয়ে গেছে এবং জনগণও অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে দলে দলে সাধারণ ছুটি উপভোগের আনন্দ নিয়ে যার যার গন্তব্যে ছুটে গেছে এবং সারা দেশে করোনার বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এতে জনগণকে দোষ দেয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। অতীতে ও বর্তমানে কোনো দেশ সাধারণ ছুটি (পাবলিক হলিডে) ঘোষণার দ্বারা কোনো মহামারী প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বা সফলতা লাভ করেছে বলে জানা নেই।

মহামারী সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব। বাস্তবতা ও সক্ষমতা এবং বাংলাদেশের নাগরিকের মনমানসিকতা বিবেচনা করলে চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, নেপাল, ভুটানের মতো করোনা মোকাবেলার অনুরূপ কার্যক্রম গ্রহণ হয়তো আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না বা সম্ভবও নয়। তবে তাদের অনুসরণে কিছু কিছু কার্যক্রম গ্রহণ একেবারে যে অসম্ভব ছিল, তাও নয়। এছাড়া আমরা আমলে নিইনি বিভিন্ন যুগে মহামারী মোকাবেলার ইতিহাসকেও। স্প্যানিশ ফ্লুর সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসেবে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার মাত্র দু’দিনের মধ্যে সেন্ট লুইস শহর দুই সপ্তাহের জন্য লকডাউনে যায়, অপরদিকে ফিলাডেলফিয়া শহর সাতদিন দেরিতে ওইরূপ লকডাউনে যায়। ফলাফল ফিলাডেলফিয়ার মৃত্যুহার হয়েছিল লুইস শহরের চেয়ে আটগুণ বেশি। আমরা এসব বিবেচনা না করে এলাকাভিত্তিক লকডাউনে না গিয়ে সমগ্র দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলাম, যা কোনোক্রমেই স্মার্ট সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই। অধিক সংক্রমিত এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে ওইসব এলাকাকে পুরোপুরি লকডাউন করা অসম্ভব ছিল না। এতে হয়তো সংক্রমণের গতি ধীর হতো এবং এতে সুচিন্তিত ও সুসংগঠিত কার্যব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্মপরিকল্পনা, কর্মকৌশল ও রোডম্যাপ প্রণয়নের সুযোগ পাওয়া যেত। কিন্তু তা না করে এডহক সিদ্ধান্ত হিসেবে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হল। সাধারণ ছুটি ঘোষণার ফলে সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে গেল। দেশ পড়ে গেল সাধারণ ছুটির ফাঁদে।

এ সাধারণ ছুটি এখন উভয় সংকট সৃষ্টি করেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা যেমন কঠিন, অপরদিকে একে দীর্ঘায়িত করাও কঠিন। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির প্রেক্ষাপটে করোনা নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য সাধারণ ছুটির ফাঁদ থেকে বেরুতে আর কোনো এডহক সিদ্ধান্ত গ্রহণ যথাযথ হবে বলে মনে হয় না। অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সুসংগঠিত সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমেই সাধারণ ছুটির ফাঁদ থেকে বেরুনোর পদক্ষেপ নিতে হবে ধাপে ধাপে।

স্বীকার করি বা না করি, সাধারণ ছুটি ঘোষণার কারণে মাঠ প্রশাসনের সরকারি, আধা-সরকারি ও অত্যাবশ্যকীয় অফিসগুলো সাধারণ মানুষের জরুরি সেবা, ত্রাণ বিতরণ, সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। ভবিষ্যৎ কৃষি উৎপাদনেও হয়তো এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

ঈদ-পরবর্তী পর্যায়ে খাতভিত্তিক ধাপে ধাপে সাধারণ ছুটি প্রত্যাহারের কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। ধাপে ধাপে সাধারণ ছুটি প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ও আধাসরকারি অফিসের কর্মচারীদের কর্মে উপস্থিতিও ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। এছাড়া বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানা, দোকানপাট ইত্যাদিও গুরুত্বানুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় স্বল্পসংখ্যক কর্মচারী নিয়ে ধাপে ধাপে খোলার নির্দেশনা প্রদানের প্রয়োজন হবে।

এছাড়া সব সরকারি ও বিধিবদ্ধ সরকারি অফিসগুলোয় একই সময়ে সব কর্মচারীর উপস্থিতির প্রয়োজন হবে না। যারা কেবল অত্যাবশ্যকীয় তাদেরই অফিসে উপস্থিতির নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার ধারণা, জরুরি বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগের ষোলোতম থেকে বিশতম গ্রেডের শতকরা পাঁচ থেকে দশ ভাগ, দশম থেকে পনেরোতম গ্রেডের দশ থেকে পনেরো ভাগ, নবম থেকে পঞ্চম গ্রেডের চল্লিশ থেকে ষাট ভাগ এবং তদূর্ধ্ব গ্রেডের নব্বই ভাগ কর্মচারীর উপস্থিতিই বর্তমান প্রেক্ষাপটে অফিসের অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা, জনসেবা নিশ্চিত করা, আর্থিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার ব্যাপারে সহায়ক হবে। তবে এক্ষেত্রে কর্মঠ ও দক্ষ কর্মচারীদের বাছাই করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত হবে। তাদের জন্য প্রণোদনারও সুযোগ রাখতে হবে।

এছাড়া ডিজিটাল কার্যক্রম অধিকভাবে চালু করা যেতে পারে। ই-ফাইলিংয়ের কার্যক্রম অধিক পরিমাণে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে করার বাধ্যবাধকতা জারি করা যেতে পারে। এছাড়া অধস্তনদের সহায়তা ছাড়াই পত্রের খসড়া প্রণয়ন এবং তা পরিমার্জন করে নিজেই জারি করা, নিজের অফিস ফাইল নিজে বহন করার মতো কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।

মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইন সংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক

সাধারণ ছুটি মহামারী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম