করোনার কাছে ‘উন্নয়ন’-এর পরীক্ষা
ডা. জাহেদ উর রহমান
প্রকাশ: ১৮ মে ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘মিথ্যা তিন প্রকার- মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান’, পরিসংখ্যান নিয়ে জানা এ রসিকতাটা সরিয়ে রেখেও এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, অর্থনীতিতে সার্বিকভাবে সবদিকের ডেটা না নিয়ে পছন্দের কিছু ডেটা নিয়ে (চেরি পিকিং) নিজস্ব ন্যারেটিভ তৈরির প্রবণতা সারা পৃথিবীতেই আছে। তবে আমাদের দেশে এ প্রবণতা নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি।
বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে ভীষণ দ্রুতগতিতে ধাবমান এক ‘উন্নয়নের রোলমডেল’, এটা প্রমাণের জন্য ক্ষমতাসীন দল কিছু ডেটা ব্যবহার করে। এ কারণেই বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি কত শতাংশ হল, মাথাপিছু আয় কত, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে কত টাকা ব্যয় করা হল, সম্পূর্ণ নিজেদের ব্যয়ে কত বড় সেতু বানানো গেল, সেই তথ্যগুলো ক্রমাগত আমাদের সামনে আসে। যেহেতু আমাদের মতো দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ এখন জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বোঝে, তাই এ তথ্যগুলো ম্যানিপুলেট করা হয়। ভারতের বিজেপি সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান কিছুদিন আগেই ভারতে এ বিতর্ক খুব সিরিয়াসলি উসকে দিয়েছেন। আমাদের দেশেও এ প্রশ্ন গুরুত্ব দিয়েই উঠতে শুরু করেছে; সানেম, সিপিডি’র মতো প্রতিষ্ঠান এটা নিয়ে কথা বলছে।
ক্ষমতাসীনদের প্রদর্শিত এসব তথ্যের বিপরীত দিকও আছে। বিভিন্ন থিংকট্যাংক, বেসরকারি সংস্থা এবং নাগরিক সমাজ দেখানোর চেষ্টা করেছে সরকারের দাবিকৃত জিডিপির সঙ্গে অর্থনীতির অনেক সূচক মেলে না; দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ বেকার, বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে বছরের পর বছর। ওদিকে উন্নতি যতটুকু হয়েছে সেটা হাতেগোনা কিছু মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে, যেটা প্রমাণিত হয়েছে গত ১০ বছরে আমাদের জিনি সূচক এবং পা’মা অনুপাত আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে, যা উচ্চ বৈষম্যের নির্দেশক। এদিকে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকা (বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা) পাচার হয়ে যাওয়ার তথ্য গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির মতো প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে। নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯-এর এ সময়টা সরকারকে সত্যিকার অর্থেই তার দাবির পক্ষে পরীক্ষা নিয়েছে। সেই পরীক্ষায় সরকার কেমন করল? লেখার পরিসর খুব কম, তাই শুধু দুটি ক্ষেত্র নিয়ে কথা বলছি।
করোনার শুরু থেকেই আমরা জানি এ রোগ মোকাবেলায় মূল কৌশলই হচ্ছে ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা’; কথাটা বারবার বলা হয়েছে ডব্লিউএইচও-এর পক্ষ থেকে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের সঙ্গে দুটি দেশের তুলনা করা যাক। না, সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা যেভাবে করোনা নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা দেখান, আমি সেটা দেখাচ্ছি না, দেখাচ্ছি দুর্বল দুটি দেশ। আফ্রিকার দেশ উগান্ডা নিয়ে আমরা ফেসবুকে খুব হাসাহাসি করি ইদানীং। সেই দেশে প্রতি ১০ লাখে আক্রান্তের সংখ্যা ৫ (মোট ২২৭), মৃত্যু সংখ্যা ০। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে প্রতি ১০ লাখে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ (মোট ২৯৫), মৃত্যুসংখ্যা ২। আমাদের দেশে প্রতি ১০ লাখে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩৫ (মোট ২২,২৬৮), মৃত্যুসংখ্যা ৩২৮। বাংলাদেশ পরীক্ষা করেছে প্রতি ১০ লাখে ১০৬৫, অথচ বাংলাদেশের তুলনায় অতি নগণ্য আক্রান্ত আর মৃত্যু নিয়েও প্রতি ১০ লাখে উগান্ডা আর নেপাল পরীক্ষা করেছে যথাক্রমে ১৫৮৪ এবং ৩১৮০। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, বাংলাদেশের প্রায় ২০০০ ডলার মাথাপিছু আয়ের বিপরীতে উগান্ডা এবং নেপালের মাথাপিছু আয় যথাক্রমে ৭৬৯ এবং ১০৪৮ ডলার। এর সঙ্গে ডাক্তারসহ চিকিৎসা কর্মীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব, আইসিইউ দূরেই থাকুক, করোনা-ডেডিকেটেড হাসপাতালে দেখা গেছে ন্যূনতম অক্সিজেনের অভাব, এমনকি পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে কর্তব্যরত নার্সের কান্না এসব আমরা দেখলাম।
বেশ কিছুদিন থেকে প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা আগের দিনের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আইইডিসিআরসহ দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা আক্রান্তের পিক সময় হবে মে মাসের শেষের দিকে। কিন্তু এর মধ্যেই সরকার গার্মেন্টসহ অন্য কলকারখানা, শপিংমলসহ সব রকম দোকান খুলে দিয়েছে অর্থনীতি চালু রাখার নামে। এমনকি ২৬ মার্চ থেকে যা চালু আছে, সেটাকে সাধারণ ছুটি বলা হয়েছে, কিন্তু কখনোই লকডাউন বলা হয়নি। সবকিছু খুলে দেয়ার আগে অন্তত এ লকডাউনটা শক্তভাবে নিশ্চিত করা হলে পরিস্থিতি আরও অনেক ভালো হতে পারত। সরকার সেটা করতে পারেনি কারণ সাধারণ ছুটির ১৫ দিন না যেতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাজার হাজার মানুষ খাদ্য এবং ত্রাণের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছে, খাদ্য বহনকারী গাড়ি থামিয়ে সেখান থেকে খাবার নিয়ে গেছে।
অঘোষিত লকডাউন শুরু হওয়ার দেড় মাস পর থেকে সরকার সমাজের ভালনারেবল মানুষের জন্য যে খাদ্য এবং অর্থ সহায়তা ঘোষণা করেছে সেটা ভীষণ অপ্রতুল। পরিবারপ্রতি ২০ কেজি চাল একটা পাঁচ সদস্যের পরিবারের মাসের এক চতুর্থাংশ বেশি যাবে না; এর সঙ্গে প্রয়োজন আরও কিছু জরুরি খাদ্য। পরিবারকে মাসে আড়াই হাজার টাকা দেয়া হচ্ছে, সেটাও এমন একটা পরিবারের জন্য খুবই তুচ্ছ পরিমাণ অর্থ। ওদিকে আগে যারা কোনো রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা প্রকল্পে সুরক্ষাভোগী ছিলেন, তাদের নতুন করে কিছু দেয়া হবে না। করোনা তাদের অন্য উপার্জন যখন কেড়ে নিল, তখন ওই সামান্য সাহায্য দিয়ে তাদের চলবে কীভাবে?
অথচ বর্তমান অর্থবছরের প্রাক্কলিত জিডিপি’র মাত্র এক শতাংশ ব্যয় করলে এদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষকে তিন মাস ভালোভাবে মোটামুটি পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো যেত। সেটা করা গেলে মানুষকে বাসায় আটকে রাখার জন্য খুব শক্ত পদক্ষেপ (প্রয়োজনে কারফিউ) নিয়ে করোনাকে প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যেত। এক্ষেত্রে ব্যর্থতা দেখলাম আমরা।
বরাদ্দই একমাত্র বিষয় না। বাংলাদেশের বরাবরের মতো ভয়ংকর দুর্নীতি এ ত্রাণ বণ্টনের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। এত ভয়ংকর একটা মহামারীতে মানুষের এ ভয়ংকর দুর্দশাও দুর্নীতিকে থামিয়ে রাখতে পারিনি। পত্রিকায় সরকারি দলের সদস্য বিভিন্ন চেয়ারম্যান-মেম্বার ত্রাণের শত শত টন চাল চুরি করেছে, ত্রাণের তালিকায় অসংখ্য ভুয়া নাম থাকার কথা এমন সংবাদ পত্রিকায় এসেছে।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
