কিউএস র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশকে আরও ভালো করতে হবে

 ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু 
২৯ নভেম্বর ২০২০, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাবিষয়ক যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) প্রতি বছর মোট ১১টি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে। এ ১১টি মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য; কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাফল্য; শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাফল্য; আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক; গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশন; পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সংখ্যা; আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপাত; আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী বিনিময়ের হার ইত্যাদি।

বলা বাহুল্য, টাইমস হায়ার এডুকেশনের (টিএইচই) পাশাপাশি কিউএসের র‌্যাংকিংও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, জনপ্রিয় ও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। প্রতি বছরের মতো প্রতিষ্ঠানটি ২৩ নভেম্বর তাদের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের এশিয়ার সেরা ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং তালিকা প্রকাশ করে। তালিকায় তিন হাজার আটশ’র বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৮১টি দেশের প্রায় এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নিয়েছে।

কিউএসের ওই তালিকায় দেখা যায়, বাংলাদেশে পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে মোট ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ৩টি পাবলিক ও বাকি ৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে কিউএস র‌্যাংকিংয়ে জায়গা পেলেও দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এশিয়া অঞ্চলের সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পায়নি বা জায়গা করে নিতে পারেনি। কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ে (এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে) প্রতিবারের মতো এবারও সবার ওপরে আছে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর।

আর এবারের র‌্যাংকিংয়ের আন্তর্জাতিক তালিকায় সেরা তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় হল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি। কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং-২০২১-এ স্থান পাওয়া আমাদের দেশের ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ), ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), আহ্ছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি)। তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ে এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১৩৪তম; গত বছর যা ছিল ১৩৫তম অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবার এক ধাপ ওপরে উঠেছে। র‌্যাংকিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), যার অবস্থান ১৯৯তম। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ), র‌্যাংকিংয়ে যার অবস্থান ২২৮তম। দেশের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির র‌্যাংকিং ২৭১-২৮০তম। পঞ্চম অবস্থানে থাকা ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) র‌্যাংকিংয়ে অবস্থান ৩৫১-৪০০তম। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ)।

র‌্যাংকিংটিতে ডিআইইউর অবস্থান ৪০১-৪৫০তম। একই অবস্থানে রয়েছে ইস্ট ওয়েস্ট ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিও। এছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) র‌্যাংকিংয়ে ৪৫১-৫০০তম, আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ৫৫১-৬০০তম ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি) ৫৫১-৬০০তম স্থান পেয়েছে। গত বছর চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৭টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছিল এ র‌্যাংকিংয়ে। এবার সেটি বেড়ে ১১-তে দাঁড়িয়েছে; যা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক বিষয়।

এবারের র‌্যাংকিং পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অবস্থান চতুর্থ; যা একটি নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক বিরাট ও অনন্য অর্জনই বটে। যা হোক, কিউএস র‌্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়া আমাদের দেশের ৩টি পাবলিক ও ৮টি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ ও প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। এখন থেকে এ ১১টি বিশ্বদ্যিালয়সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমাজে নিশ্চয়ই একটু হলেও বিশেষ মর্যাদায় দেখা হবে। তাছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কারও কাছে তাদের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম-পরিচয় দিতে গিয়ে একটু হলেও গর্ব অনুভব করবেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গৌরবময় অর্জন সম্ভব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর সার্বিক সহযোগিতার ফলে। কিউএসের র‌্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়া দেশের ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে, সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর আন্তরিকতা থাকলে এগিয়ে যাওয়া যায় অনেক দূর, সগৌরবে দাঁড়ানো যায় মাথা উঁচু করে। তবে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে, এ প্রাপ্তি ও অর্জন এক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্ব আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিল।

কারণ, ভালোর কোনো শেষ নেই এবং স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে মাথায় রাখতে হবে, এখানেই শেষ নয়, যেতে হবে বহুদূর। এ যেন আমেরিকান বিখ্যাত কবি Robert Frost রচিত Stopping by Woods on a Snowy Evening শীর্ষক কবিতার বিখ্যাত সেই লাইন ‘And miles to go before I sleep, And miles to go before I sleep’ কে স্মরণ করিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১০৭টি প্রাইভেট এবং ৪৬টি পাবলিক ইউনিভার্সিটি রয়েছে। এসব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রয়েছে তিনটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করা শিক্ষার্থীর তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসন সংখ্যা অনেক কম। ফলে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল নিয়ে পাস করাও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুয়োগ থেকে বঞ্চিত হন। দীর্ঘকাল থেকেই দেশে এ অবস্থা চলে আসছে।

এ অবস্থার কারণে অতীতে দেশের অনেক শিক্ষার্থী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাতেন। এতে করে দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং মেধা উভয়ই বিদেশে পাচার হতো। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং দেশে মানসম্মত শিক্ষার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে দেশে প্রথমবারের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করা হয়। সর্বশেষ ২০১০ সালে আগের আইনের স্থলে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০’ প্রণয়ন করা হয়।

এ কথা সবারই জানা আছে, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) হচ্ছে দেশের পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা। দেশের পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পৃথকভাবে নিয়ে ইউজিসি যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রকৃত ও সমসাময়িক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কিউএসের মতো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে এ ধরনের র‌্যাংকিং করার উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে তা দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের ইতিবাচক পরিবর্তন তথা উন্নয়ন ঘটাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৮ জুন অনুষ্ঠিত ইউজিসির এক সভায় দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং (অবস্থান নির্ধারণ) করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিংবিষয়ক ওই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটাতে ইউজিসির দ্রুত এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে এ ধরনের র‌্যাংকিং করার প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিউএস কিংবা টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) কর্তৃক পরিচালিত ও প্রকাশিত র‌্যাংকিং নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও সর্বজনগ্রাহ্য। কিউএস কিংবা টিএইচই-এর র‌্যাংকিং যেহেতু সমসাময়িক, বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ, তাই কিউএসের এ ধরনের র‌্যাংকিং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং তা আন্তর্জাতিক মানেরও বটে।

এ ধরনের র‌্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিটি প্রাইভেট এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তার অবস্থান বুঝে র‌্যাংকিংয়ে উঠে আসার চেষ্টা করতে পারে এবং র‌্যাংকিংয়ের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হয়; যা উচ্চশিক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সর্বোপরি এ ধরনের র‌্যাংকিং অব্যাহত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ভালো করার চাপ থাকে।

মূলত এভাবেই সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং শুরু হয়েছে এবং তা মানসম্মত অবস্থায় পৌঁছেছে। সুতরাং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুণগত ও মানসম্মত আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে এ জাতীয় র‌্যাংকিংয়ের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

কিউএস র‌্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়া দেশের ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যদি নোংরা রাজনীতি, দলবাজি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিহার করে একযোগে দেশ ও জাতি গঠনে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসে, তাহলে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত জ্ঞানকে দেশ ও জাতি বিনির্মাণে ভালোভাবে কাজে লাগানো যাবে। ফলে তখন খুব দ্রুত এবং খুব সহজেই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে; যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমি, আপনি, সবাই দেখি।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব গ্লোবাল হিউম্যান মুভমেন্টের সহযোগী সদস্য

kekbabu@yahoo.com

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন