Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বের পঞ্চাশ বছর

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বের পঞ্চাশ বছর

গত ৫ মার্চ ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় একটি সংবাদ শিরোনাম দেখে আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। শিরোনামটি ছিল, ‘সীমান্ত হত্যার মূল কারণ অপরাধ’।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সম্প্রতি ১১ ঘণ্টার বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। সীমান্ত হত্যার মূল কারণ অপরাধ।

আমরা উভয় দেশই চাই অপরাধহীন ও মৃত্যুহীন সীমান্ত।’ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন নরম ও মার্জিত ভাষার কথা শুনে কার না ভালো লাগে। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশ সফরে এসে দুদেশের বন্ধুত্ব সম্পর্ক নিয়ে ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে ভাষায় কথা বলেন তা ভালো না লেগে পারে না। আর সেই ব্যক্তিত্বটি যদি কোনো সাবেক আমলা হন, তাহলে তো কথাই নেই।

তবে জয়শঙ্করের মতো সাবেক আমলা বর্তমানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অথচ অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে কূটনৈতিক ভাষায় সুন্দর করে কথা বললেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভারতের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়নে অধিক সময়ক্ষেপণ লক্ষ করা যায়। জয়শঙ্করের এমন বক্তব্য শোনার পর ভারত প্রকৃত অর্থেই সীমান্ত হত্যা বন্ধে আন্তরিক হবে, এটাই কাম্য।

পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে আন্তর্জাতিক সীমানা আইন ভঙ্গের কারণে অপরাধীকে গুলি করে হত্যা করার বিধিবিধান আছে। মাঝে মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে গুলি করে হত্যার সংবাদ খবরের কাগজে দেখি; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মতো নয়। মনে রাখতে হবে, স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক বিরাজমান।

মাঝে কয়েক বছর এ সম্পর্কে ভাটা পড়লেও তা ছিল সাময়িক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে ভারতের সমর্থন কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। এ বছর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ৫০ বছরে গিয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকে, এমন সম্পর্কের পরও ভারতের বিএসএফ সদস্যরা বাংলাদেশিদের নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করছে না কেন? পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এত বৈরী সম্পর্কের পরও সীমান্তে কোনো পাকিস্তানি বেসামরিক মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটে না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই না, সীমান্ত আইন ভঙ্গ করার জন্য বেসামরিক মানুষকে, তা সে যত বিপজ্জনক স্মাগলারই হোক না কেন, তাকে গুলি করে হত্যা করার কোনো আইন ভারতের সংবিধানে আছে।

আত্মরক্ষার্থে গুলি করার অনুমোদন হয়তো থাকতে পারে। তবে সে অনুমোদন থাকলেও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রাথমিক সতর্কীকরণ পদক্ষেপ নিতে হয়, যা অবশ্যই পালনীয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সফরকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, এসব হত্যার বেশিরভাগ ঘটনাই ভারতের সীমানার ভেতরে ঘটছে।

কিন্তু এযাবৎ ভারতের সীমানার ভেতরে কতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তিনি তার বক্তব্যে সে কথা উল্লেখ করেননি। তবে ভারত ভূখণ্ডের ভেতর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জয়শঙ্কর সীমান্ত হত্যাকাণ্ডকে কিছুটা জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন কিনা সে প্রশ্ন তো রয়েই গেছে! আমার বিশ্বাস, তিনি হয়তো সে অর্থে এ কথা বলেননি। তিনি কূটনীতির ভাষায় বাংলাদেশি সাংবাদিকদের মোকাবিলা করেছেন মাত্র।

ভারতের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বা ব্যক্তির সফরের আগের বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে সফরসূচি নিয়ে সংবাদ হয়। সফরকালে কী কী বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হবে, অমীমাংসিত বিষয়ে অগ্রগতি হবে কিনা ইত্যাদি বিষয় থাকে সেসব খবরে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। জয়শঙ্করের এবারের সফরের মূল কারণ ছিল নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নিয়ে চূড়ান্ত সমন্বয় করা। সফরের আগে আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, জয়শঙ্করের ওই সফরকালে বাণিজ্য, সংযুক্তি ও পানিবণ্টন ইস্যু গুরুত্ব পাবে। স্বাভাবিক কারণেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রশ্নও ছিল উল্লেখিত বিষয়বস্তু নিয়ে। অনেক বিষয়ের মধ্যে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে সাংবাদিকদের জানার আগ্রহ ছিল বেশি। প্রতি উত্তরে জয়শঙ্কর জানালেন, ‘তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের অবস্থান আগের মতোই।’ তার এ বক্তব্যের মাধ্যম তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি যে সহসাই হচ্ছে না, তা আরও স্পষ্ট হলো মনে হয়।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে বরাবরই সততার পরিচয় দিয়ে এসেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় না দিয়ে বরং তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার করে হস্তান্তরের মাধ্যমে ভারতের অখণ্ডতা রক্ষায় সাহায্য করে বাংলাদেশ যে অকৃত্রিম বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে তা ১৯৭১ সালে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে সাহায্য করার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

তাছাড়া, ট্রান্সশিপমেন্ট, ট্রানজিট, রোড ও রেল যোগাযোগ, নদীপথ ব্যবহার, মোংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অবাধ ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের বাণিজ্যিক লেনদেনকে সহজতর করে দিয়ে বাংলাদেশ ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে যে সুবিধা করে দিয়েছে, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ৯ মার্চ বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে ফেনী নদীর উপর নির্মিত ‘মৈত্রী সেতু’ উদ্বোধন এর সর্বশেষ উদাহরণ। এ সেতুর এক প্রান্ত বাংলাদেশের রামগড় ও অপর প্রান্ত ত্রিপুরার সাব্রুম। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এ মৈত্রী সেতুর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবস্যা-বাণিজ্যের ছবির আমূল পরিবর্তন ঘটবে। এ বিষয়ে ভারতে দিল্লির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের অধ্যাপক ও আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির বিশেষজ্ঞ প্রবীর দের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘আমার মতে ব্রিজটা একটা গেমচেঞ্জার, কারণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পণ্য চলাচল যেমন সহজ হবে, তেমনি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে মাত্র ৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পৌঁছে যাবে। অথচ আগে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হতো। এখন থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কার্গোও চট্টগ্রাম দিয়ে সারা ভারতে আনা-নেওয়া করাটা অনেক অনেক সহজ হবে। ফলে পরিবহণের খরচ অনেক কমবে, সময়ও কম লাগবে। এ দুটো ফ্যাক্টর এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এতদিন প্রধান প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করছিল।’

বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক চমৎকার। বিশেষ করে দুদেশের সরকারের মধ্যে তো বটেই। সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুদেশের মন্ত্রী-আমলাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে প্রায়ই এ সম্পর্ক নিয়ে বক্তব্য দিতে শোনা যায়। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসেও এ সম্পর্ক নিয়ে আরও বেশি কথা হয়। বাংলাদেশ সবসময়েই ভারতের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। অতঃপর, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের এ দুদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে যে বেশি বেশি কথা হবে, এটাই স্বাভাবিক।

দুদেশের সরকারপ্রধান যখন কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে যান তখন দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পায়। বিশেষ করে অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে সবার ভেতর আগ্রহ থাকে। নরেন্দ্র মোদির এবারের সফরে বাংলাদেশিদের ভেতর সে আশার সঞ্চার হয়েছে। আমরা আশাবাদী। এবারের সফরে না হলেও খুব শিগ্গির এসবের সমাধান হবে সে প্রত্যাশা করতেই পারি; কিন্তু খারাপ লাগে, ভারত বাংলাদেশকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম বন্ধুরাষ্ট্র বিবেচনা করলেও সীমান্ত হত্যা যখন বন্ধ হয় না।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জটিলতার কারণে তিস্তা পানিবণ্টনের যখন কোনো সুরাহা হয় না, অথচ বাংলাদেশ বিকল্প ব্যবস্থার উদ্যোগ নিলেও যখন তাদের দিক থেকেই বাধা আসে, তখন একজন বাংলাদেশি হিসাবে পীড়িত না হয়ে পারি না।

স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বাস্তবায়নে একমুখী নীতি ত্যাগ করে উভয়মুখী হওয়াটাই কাম্য। এসব অমীমাংসিত বিষয়ে যত তাড়াতাড়ি সমাধান হবে, দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ততই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে; তাতে শুধু রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যেই নয়, দুদেশের নাগরিকদের মধ্যেও বন্ধুত্বের সমান হিস্যা নিশ্চিত হবে।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

বাংলাদেশ ও ভারতের. পঞ্চাশ বছর.

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম