নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
ব্যক্তি করদাতাদের রেয়াত দিলে তাদের টাকা বাজারে যেত
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নতুন অর্থবছর ২০২১-২২-এর বাজেট সংসদে যখন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পেশ করছিলেন, তখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখলাম মূল্যবৃদ্ধি, মূল্য হ্রাসের খবর-তথ্য দেখানো হচ্ছে। পাশাপাশি বাজেটের আকার, রাজস্বের পরিমাণ, উন্নয়ন বাজেট, বাজেট ঘাটতির খবরও দেখানো হচ্ছে। এর দ্বারা কী বোঝা যায়? বোঝা যায়, বাজেটের তথ্য ও পরিসংখ্যানের চেয়ে জিনিসপত্রের মূল্যের খবর সাধারণ শ্রোতা-দর্শকদের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এ নিরিখে বাজেটকে দেখলে মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্য হ্রাসের সমগ্র চিত্র দরকার হয়। তবে বলাই যায়, বাজেট ঘোষণার এক সপ্তাহ আগেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সয়াবিন তেলের মূল্য লিটারপ্রতি ১২ টাকা করে বৃদ্ধি করেছে। এখন এক লিটার বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য হবে ১৫৩ টাকা। বলাই বাহুল্য, দু’দিন আগে সয়াবিনের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছিল। শুধু সয়াবিন তেল নয়, বাজেট ঘোষণার দু’দিন আগে পেঁয়াজের মূল্য কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। অন্যান্য জিনিসপত্রের মূল্যে তো তেজিভাব আছেই- আছে সেই পবিত্র রমজান মাস থেকে। এ থেকে সাধারণ মানুষের নিস্তার নেই। এর ওপর বাজেটে জিনিসপত্রের ওপর অনেক ক্ষেত্রে করারোপ করা হয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে কর হ্রাস করা হয়েছে। বিষয়টি দৃশ্যত খুব দুঃসংবাদ নয়। মনে হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত দেশীয় শিল্পের উৎপাদিত পণ্যকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য অনেক দেশীয় পণ্যের ওপর থেকে কর হ্রাস করেছেন। আবার বিদেশি অনেক পণ্যের ওপর করারোপ করেছেন। এতে দেখা যায়, বিদেশি ল্যাপটপ, ফলমূল, মাংস, শাকসবজির দাম বাড়বে। বিদেশি প্যাকেটজাত দ্রব্য, বিদেশি মদ, সিগারেট ইত্যাদির দামও বাড়বে। আবার পিপিই, মাস্ক, স্যানিটাইজার, চিকিৎসাসামগ্রী, দেশীয় এয়ারকন্ডিশনার, মাছের খাবার, পোলট্রি ফিড, ক্যানসারের ওষুধ, মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ, দেশে তৈরি টিভি, কৃষি উপকরণ ইত্যাদির দামও কমবে। দৃশ্যত বড় ধরনের আপত্তির কোনো কারণ দেখি না। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। বাজেটের সময় দেখা যায়, সরকার যেসব জিনিসের দাম কমায়; সেসবের দাম কমে না এবং যেসব জিনিসের দাম বাড়ায়, ব্যবসায়ীরা এদের দাম ঠিকই বাড়ায়। সয়াবিন তেল, পেঁয়াজের পর সরকারি বাজেটের পদক্ষেপের ফলে কি বাজারে আবার মূল্যস্ফীতি ঘটবে? এ দুশ্চিন্তার কথা অর্থমন্ত্রীকে জানিয়ে রেখে বাজেটের কাঠামোগত আলোচনায় যেতে চাই। বিস্তারিত নয়, শুধু কাঠামোগত আলোচনাই করব।
বাজেটের বিস্তারিত পাঠ না করে এর মূল্যায়ন করা কঠিন। তবে মোটা দাগে কিছু আলোচনার সূত্রপাত করাই যায়। আমাদের দেশে বাজেটের পরিচয় খরচ-ব্যয় দিয়ে। আমাদের কাছে রাজস্ব আয় পরে, আগে খরচ, যা পারিবারিক বাজেটের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্যয়ের আঙ্গিকে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকেই; বরং আরও আগে থেকেই আমাদের ব্যয় প্রতিবছর রেকর্ড করছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ব্যয় হবে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এত বিশাল পরিমাণ ব্যয়ের টাকা আসবে কোত্থেকে? এখানেই যত প্রশ্ন। ব্যয়ের টাকা মেটানোর মতো টাকা আমাদের কখনো ছিল না, আগামী বছরও থাকবে না। যেখানে মোট রাজস্ব আয় হবে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা, সেখানে ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ঘাটতি ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। জিডিপির হিসাবে খুব বেশি নয়, মাত্র ৬ দশমিক ১ শতাংশ। বহুদিন তা ছিল আমাদের সাড়ে চার, পাঁচ শতাংশ। বর্তমানে করোনা-১৯-এর কারণে খরচ বাড়তে পারে, আর তেমন নাও বাড়তে পারে। অতএব বাজেট ঘাটতিকে আমরা মেনে নিতে পারি। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। আমরা যদি ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির’ আকারের সঙ্গে বাজেট ঘাটতির (দুই লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি) তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে ঘাটতি থেকে সামান্য বেশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পরিমাণ (দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি)। এর অর্থ কী? উন্নয়নের জন্য আমাদের টাকা নেই। উন্নয়নের জন্য দেশে ধার করতে হয়, বিদেশেও ধার করতে হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরের পরও এ লজ্জা আমাদের কাটেনি। রাজস্বের অভাবের কারণে আবার আমরা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারও বড় করতে পারি না। প্রতিবছর ‘এডিপির’ আকার বরং বছর শেষে কাটছাঁট করা হয়। আবার এডিপিতে যেসব প্রকল্প থাকে, সেসবের নাম শুনলে অনেক সময় হাসি পায়। দেশের প্রয়োজনের চেয়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনই প্রাধান্য পায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা ব্যয়ের গুণগত দিক। দেখা যায়- কী সেতু করি, কী রাস্তা করি অথবা কী অন্য অবকাঠামো করি, এদের প্রতিটির খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় হয় দ্বিগুণ, তিনগুণ। আমরা এক টাকার কাজ দুই টাকায় করি, তিন টাকায় করি। এ সমস্যা আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। এর থেকে আমাদের রাজস্ব বাজেটও মুক্ত নয়। স্কুল নেই, অথচ শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিতে হয়। বাজেটের গুণগত এ সমস্যার সমাধান কী- তার উত্তর কোনো বাজেটেই পাইনি; এবারও না। অথচ এর উত্তর দরকার। নতুবা খরচের বাজেট দিন দিন অহেতুক স্ফীতই হবে।
যে টাকা খরচ হবে, তা ২০২১-২২ অর্থবছরে আসবে কোত্থেকে? বাজেট বক্তৃতা থেকে দেখা যাচ্ছে, এবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বেশি বোঝা দেওয়া হয়নি। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের জন্য যে টাকা লাগবে, তার মাত্র ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ দেবে এনবিআর। অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ছিল ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ‘করবহির্ভূত রাজস্ব’ এবং বিদেশি ঋণ দিয়েই বেশি বেশি অর্থায়ন করা হবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের বাজেট ছিল সামগ্রিক বাজেটের ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা হবে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। বিদেশি ঋণ মানেই নানা শর্ত। আবার বেসরকারি খাতের ঋণ হলে সুদের হার হবে বেশি। দেখা যাচ্ছে, দেশীয়ভাবে ঋণের পরিকল্পনা ২০২১-২২ অর্থবছরে কম ধরা হয়েছে। তা হবে সামগ্রিক বাজেটের মাত্র ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ছিল ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এদিকে ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ (এনবিআর) পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের জন্য প্রয়োজনীয় টাকার মধ্যে যে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা দেবে, তাতে ‘ভ্যাট ও আয়করের’ অবদান ২০২১-২২ অর্থবছরে বাড়বে। আমদানি শুল্ক, সম্পূরক কর এবং অন্যান্য খাতের অবদান হ্রাস পাবে।
বাজেটের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে- এত সম্পদ অর্থাৎ ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা কোথায় খরচ করা হবে? এর হিসাব দুভাবে বাজেট ‘ডকুমেন্টে’ পাওয়া যায়। ‘একনজরে বাজেট’ বা ‘বাজেটের সংক্ষিপ্ত সারে’ এ সম্পর্কে তথ্য দেওয়া আছে। আবার মূল বাজেট বক্তৃতায় খরচের খাতওয়ারি একটা হিসাব দেওয়া আছে। আমরা মূল বাজেটের দিকেই তাকাই। এর সাত নম্বর সারণিতে বাজেটের খরচের যে কাঠামোগত পরিচয় দেওয়া হয়েছে, তাতে খরচকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে- সামাজিক অবকাঠামো, ভৌত কাঠামো, সাধারণ সেবা, সুদ পরিশোধ, পিপিপি ভর্তুকি ও দায় এবং নিট ঋণদান ও অন্যান্য। বলা বাহুল্য, এ ছয়টির ভেতরেই রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য বরাদ্দের হিসাব। খরচের কাঠামোগত আলোচনা করলে খুবই মজার তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে যেসব খাতে বরাদ্দ কমেছে, সেসব খাতে বরাদ্দ বাড়ার কথা। কিন্তু হয়েছে উল্টো। উদাহরণ দিই। সামাজিক অবকাঠামোর অধীন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমেছে। টাকার অঙ্কে নয়। সমগ্র বাজেটের খরচের শতাংশ হিসাবে। টাকার অঙ্কে অনেক সময় স্ফীত পরিমাণ দেখা যায়। কিন্তু শতাংশের হিসাবই প্রকৃত হিসাব। প্রশ্ন- শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, সর্বোপরি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণে বরাদ্দ হ্রাস পায় কীভাবে? অথচ বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বেড়েছে। অঙ্কে বা পরিমাণে হতে পারে; কিন্তু হিসাবটা তো হতে হবে শতকরা বা শতাংশে। করোনা-১৯-এর মতো ভয়ংকর অজানা এক শত্রুর বিরুদ্ধে যখন আমরা লড়ছি মরণপণ, তখন স্বাস্থ্য খাতে শতাংশের হিসাবে বরাদ্দ হ্রাস পায় কীভাবে? বিষয়টি কি অর্থমন্ত্রীর নজরে আছে? আমার জানা নেই। আবার দেখা যাচ্ছে, পানিসম্পদ ও স্থানীয় সরকার বিভাগেও বরাদ্দ শতাংশের হিসাবে কমেছে। কমেছে ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায়। এটা কী করে সম্ভব? কর্মসৃজনের জন্য আমাদের অগ্রাধিকার দরকার। কৃষির মতো কর্মসৃজনের সুযোগ বেশি পানিসম্পদ ও স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে। জানি না, কোন যুক্তিতে এসব ক্ষেত্রে বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে। সরকার বিষয়টি পরিষ্কার করলে আমরা উপকৃত হই। দেখা যাচ্ছে- বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, রেলপথ, সেতু বিভাগে শতাংশের হিসাবে বরাদ্দ বেড়েছে। অথচ খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতেও শতাংশের হিসাবে বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। এর কী যুক্তি আছে তাও পরিষ্কার করা দরকার। একমাত্র ভালো খবর হচ্ছে সুদব্যয়ের ক্ষেত্রে। সমগ্র বাজেটের (উন্নয়ন ও রাজস্ব) ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ খরচ হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। সেই জায়গায় ২০২১-২২ অর্থবছরে খরচ হবে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আমার ধারণা, সামগ্রিক বাজেটের কাঠামোগত এ দুর্বলতা থাকা উচিত ছিল না। আসলে বাজেটের কাঠামোগত তথ্য যথা- খরচ কোথায় হবে, আয় কোত্থেকে আসবে ইত্যাদি একটা নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা বলে মনে হয়। কয়েক বছরের তথ্য মিলিয়ে দেখলেই তা বোঝা যাবে।
পরিশেষে অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু রাজস্ব আহরণ ক্ষেত্রে দুটি ঘটনা আলোচনার অপেক্ষা রাখে। রাজস্বের প্রস্তাবে দেখা যাচ্ছে, ‘পাবলিকলি ট্রেডেড’ কোম্পানির কর আড়াই শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। ‘পাবলিকলি ট্রেডেড’ নয়, এরূপ কোম্পানির করও কমানো হয়েছে আড়াই শতাংশ। ‘এক ব্যক্তি কোম্পানি’র কর কমানো হয়েছে সাড়ে সাত শতাংশ। ‘ব্যক্তি সংঘের’ করহারও আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। করপোরেট সেক্টরে এসব হ্রাস যদি করা যায়, তাহলে ব্যক্তি করদাতাদের করযোগ্য আয় এবং করহারে কিছুটা ছাড় দিতে আপত্তি কোথায়? শত হোক এখন দরকার ‘চাহিদা’ (ডিমান্ড) সৃষ্টি করা। দেশীয় শিল্পের পণ্য কে কিনবে? করদাতাদের রেয়াত দিলে তাদের টাকা বাজারে যেত, এতে চাহিদা বৃদ্ধি পেত। জানি না, কী কারণে এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী অনুদার রয়ে গেলেন। পরিশেষে অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ১৯২ পৃষ্ঠার বিশাল একটা বাজেট প্রণয়নে মেধা ও শ্রম দেওয়ার জন্য।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
