অন্যমত
বহুজাতিক কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে হবে
আবু আহমেদ
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গোড়ার দিকে অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকের আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সব সদস্য ছিলেন ব্যক্তি পর্যায়ের।
পরে এ মালিকানা বা সদস্যপদ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে এবং বিভিন্ন ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, মার্চেন্ট ব্যাংকাররা ক্রয় করে নেয়।
এর ফলে বর্তমানে ঢাকা ব্যাংক সিকিউরিটিজ, প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজ, প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজ, লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ, সাউথ ইস্ট ব্যাংক সিকিউরিটিজ এবং এনবিআর সিকিউরিটিজের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যের পর্যায়ে এসেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫০ সদস্যের মধ্যে ২৩০ জন সক্রিয় ছিলেন। বাকি ২০ সদস্যের কোনো হদিস না থাকায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে ছিল। আমার ধারণা, নিষ্ক্রিয় এ সদস্যপদগুলো ছিল পাকিস্তানিদের, যারা স্বাধীনতার পর এগুলো ফেলে রেখে চলে যায়। সক্রিয় সদস্যরা বা ব্রোকাররা বিভিন্ন সময়ে ৭ থেকে ১৫ লাখ টাকায় তাদের মেম্বারশিপ বিক্রি করে দেন। এ কারণে মেম্বারশিপ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে এবং ব্যক্তি থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চলে যায়। ফলে স্টক এক্সচেঞ্জ নতুন করে কোনো মেম্বারশিপ ইস্যু করেনি, শুধু সদস্যদের নামের পরিবর্তন করেছে মাত্র। নিষ্ক্রিয় বা হদিস না পাওয়া বাকি ২০টি সদস্যপদ সরকার অকশনে ৮৫ লাখ বা ১ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেয়। বিক্রি হওয়া নিস্ক্রিয় এ সদস্যপদও ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ক্রয় করে নেয়। পরে ধীরে ধীরে ব্যক্তি পর্যায়ের সদস্যপদ কমতে থাকে। ২৫০টি ব্যক্তি পর্যায়ের সদস্যপদ কমতে কমতে বর্তমানে মাত্র ১৫-২০টির মতো রয়েছে।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজারে তাদের টাকা লেনদেন করার জন্য ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। ব্যক্তি পর্যায়ের ব্রোকারেজ হাউজের মালিকরা বিনিয়োগকারীদের টাকা তুলে নিতে পারে। ১৫-২০টি ব্যক্তি পর্যায়ের ব্রোকারেজ হাউজের মধ্যে কিছু ব্রোকারেজ হাউজ অন্যায়ভাবে সেটিই করেছে। ফলে বিও অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের টাকা তছরুপ করায় শেয়ারবাজার নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা হতাশা সৃষ্টি হয়েছে, যেটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজারে লেনদেনকৃত টাকা ওই ব্যক্তি পর্যায়ের ব্রোকারদের অ্যাকাউন্টে থাকে। কিন্তু সে টাকা তারা নিজেদের ইচ্ছামতো তুলে নিতে পারে না, এটা অন্যায়। কিন্তু তারা এটা করেছে। এর ফলে শেয়ারবাজার নিয়ে একটা আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে, যেটি কাম্য হতে পারে না।
এ বিষয়টি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের নজরে আসে বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রির টাকা তুলতে যাওয়ার পর। কারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রির টাকা তুলতে গেলে অনেক চেকই ডিজঅনার হয়। নিয়ম হচ্ছে, শেয়ার বিক্রির টাকা দুই-তিন দিনের মধ্যেই বিনিয়োগকারীদের ফেরত দিতে হবে। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ের সদস্যরা টাকা তছরুপ করায় সেটি তারা দিতে পারেনি। প্রায় ১১ হাজার বিনিয়োগকারীকে এ সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শুধু ব্যক্তি পর্যায়েই ঘটেছে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ঘটেনি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এ সমস্যার কারণে ওইসব ব্রোকারেজ হাউজে শেয়ার কেনাবেচা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এতে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না। বিনিয়োগকারীদের টাকা তো ফেরত দিতে হবে। তবে এক ব্রোকার হাউজ থেকে অন্য ব্রোকার হাউজে শেয়ার ট্রান্সফার করার একটি সিস্টেম চালু আছে। ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীদের জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ হয়তো সেটাই করবে। এখন বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দিতে হলে তছরুপকারী ব্রোকারদের এগিয়ে আসতে হবে।
তাহলে বিষয়টি খুবই সহজ হবে। কয়েকটি ব্রোকার হাউজে বিনিয়োগকারীদের যে টাকা থাকা উচিত ছিল, তার চেয়ে কম পাওয়া গেছে। সেখানে দায়ীদের ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে, জরিমানা করা হয়েছে। আর যে ক্ষেত্রে অর্থ তছরুপের বিষয়টি বেশি ছিল, সেসব ব্রোকার হাউজে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। টাকা তছরুপকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়ে গেছে, বিদেশ যাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেছে এবং তাদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট সিজ করা হয়েছে। সুতরাং পালানোর পথ নেই। আর এসব কারণে তারা এখন একটা মীমাংসার পর্যায়ে আসতে বাধ্য হবে।
দায়ী ব্যক্তিরা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। সমাধানের একটা চেষ্টাও হচ্ছে। তবে এর সমাধানে কতদিন লাগবে সেটি বোঝা যাচ্ছে না। অর্থ তছরুপকারীদের ঘাটতি টাকা জমা করতে হবে। যেটি ঘাটতি আছে সেটি আংশিক হলেও দিতে হবে এবং বাকিটা মুচলেকা দিতে হবে। মোট কথা, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে কনভিন্সড করতে হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কনভিন্সড হলেই তারা বোর্ডের মাধ্যমে তাদের ব্রোকার হাউজগুলো আবার চালু করতে পারবেন। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বিষয়টি সহজ হবে।
এখন পুঁজিবাজারের অবস্থা মোটামুটি ভালো। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও চাচ্ছে পুঁজিবাজার ভালো করতে, আমরাও চাচ্ছি ভালো হোক। নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে। সরকারও চায় ভালো হোক, যদিও বাজেটে সরকারের তেমন কোনো প্রণোদনা নেই। তবে একটাই প্রণোদনা আছে, সেটি হলো, কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে তার করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স আরও ২.৫ পার্সেন্ট কমানোর প্রস্তাব রয়েছে। নন-লিস্টেড কোম্পানির ক্ষেত্রেও ২.৫ পার্সেন্ট কমানো হয়েছে। ফলে তাদের করপোরেট ইনকাম ট্যাক্সের পার্থক্যটি ১০ পার্সেন্ট থেকে কমে বর্তমানে ৭.৫ পার্সেন্ট হয়েছে।
গতবারও নন-লিস্টেড কোম্পানির ক্ষেত্রে তা-ই ছিল। সে হিসাবে পুঁজিবাজার এককভাবে কারও জন্য কিছু করেনি। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, স্টক এক্সচেঞ্জগুলো এবং বিনিয়োগকারীরাও চাচ্ছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স আরও কমানো হোক। বর্তমানে সর্বনিু করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স সাড়ে ২২ শতাংশ। তাও এটি কিছু কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমরা চাচ্ছি, করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স ২০ শতাংশে নিয়ে আসা হোক।
করোনা মহামারির কারণে মার্চের পর থেকে দুই মাসেরও অধিককাল স্টক মার্কেট বন্ধ ছিল। এ বন্ধ থাকার কারণে অনেকেই এর প্রতি ছিলেন অসন্তুষ্ট। কারণ করোনাকালে পৃথিবীর কোনো স্টক মার্কেটই বন্ধ ছিল না। তাহলে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট কেন বন্ধ রাখা হয়েছিল, এ নিয়ে সবার মাঝেই প্রশ্ন দেখা দেয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এর প্রতিবাদও করেছে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। অর্থমন্ত্রীও সে সময় মাত্র দায়িত্ব নিয়েছেন, তাই তিনি এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাননি। এর আগের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় স্টক মার্কেট খোলার ব্যাপারে তারা কোনো উদ্যোগ নেননি। তারা হয়তো মনে করেছেন নতুন কমিশন এসে যা করার করবে। ফলে বন্ধ থাকার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিল। পূর্বতন কমিশনের সময় ফ্লোর প্রাইস পড়ে গিয়েছিল। ফলে বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের ক্ষেত্রে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে টার্নওভার (প্রতিদিনের কেনা-বেচা) হয়ে পড়েছিল ১০০ কোটি টাকারও নিচে। নতুন কমিশন এসে শেয়ার মার্কেট খুলে দেয়। তারা সিদ্ধান্ত দেয়, ব্যাংক খোলা থাকলে শেয়ার মার্কেট খোলা থাকবে। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত।
ওই সময় ব্যাংক খোলা ছিল, কিন্তু শেয়ার মার্কেট খোলা ছিল না। এ কারণে অনেক বিনিয়োগকারী হতাশ হয়েছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও অনেক বিরক্ত হয়েছেন। তাদেরও অনেক বিনিয়োগ আছে আমাদের শেয়ারবাজারে।
তারপরও মানুষ এখন পুঁজিবাজারমুখী হচ্ছে। নতুন কমিশনও পুঁজিবাজার নিয়ে অনেকটা তৎপরতা দেখাচ্ছে। আশা করা যায় পুঁজিবাজার ভালো হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পুঁজিবাজার বড় না করলে এর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা যাবে না। এটি এখনো টোটাল স্টক মার্কেট ক্যাপিটাল জিডিপির ১৮-১৯ শতাংশ মাত্র। যেটি বিশ্বের অন্যান্য দেশে অনেক বেশি। সব মিলিয়ে শেয়ারবাজার নিয়ে খুব একটা এগোতে পারিনি আমরা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগোচ্ছি। যেমন করপোরেট গভর্ন্যান্সে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
শেয়ারবাজারের গভীরতা বাড়াতে হলে স্থানীয় ভালো কোম্পানি এবং বহুজাতিক কোম্পানিকে শেয়ারবাজারের আওতায় আনতে হবে। তাহলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাবে।
কারণ এ ধরনের কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করার যোগ্য। দেশে বহুজাতিক কোম্পানি তো অনেকই আছে, যার অনেকগুলোই আমাদের শেয়ারবাজারে আসেনি বা তালিকাভুক্ত হয়নি। যেমন ইউনিলিভার, নেসলে, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল, হেলথ কেয়ার, ইনসেপ্টা ইত্যাদি।
দুর্বল ভিত্তির ১০টি কোম্পানিকে তালিকায় না এনে একটি বহুজাতিক কোম্পানিকে তালিকায় আনা বেশি যৌক্তিক। কারণ যতগুলো বহুজাতিক কোম্পানি মার্কেটে আছে, তার সবগুলোর শেয়ারের দাম ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকারও উপরে। তারা বিনিয়োগকারীদের ভালো ডিভিডেন্ডও দিচ্ছে। সুতরাং শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে এ ধরনের কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। (অনুলিখন)
আবু আহমেদ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
