যেসব কারণে কার্যকর হচ্ছে না লকডাউন
মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের করোনা পরিস্থিতি দিনকে দিন ভয়াবহ রূপ লাভ করছে; এ যেন অপ্রতিরোধ্য। করোনার প্রথম ঢেউ মোটামুটি ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওপর দিয়েই বেশিরভাগ প্রবাহিত হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ রাজধানীর বাইরের অঞ্চলগুলোতেই বেশি। শুধু বেশি বলার মধ্যেই সীমিত থাকলে হবে না, বরং বলা যায় তা অতি উদ্বেগ ও আশঙ্কাজনক। আমরা সাধারণত করোনার প্রকোপ অনুধাবনে শনাক্তের হার বিবেচনা করে থাকি।
তাই যদি হয় তাহলে চিত্রটি হলো, ২৪ জুন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চুয়াডাঙ্গায় এ শনাক্তের হার ছিল ১০০ শতাংশ, ৪১টি নমুনা পরীক্ষার সবই পজিটিভ। গাণিতিকভাবে যেহেতু শনাক্তের হার ১০০ শতাংশের বেশি হতে পারে না, তাই নিশ্চিত করেই বলা যায়, আমরা করোনার সর্বোচ্চ আঘাতে বিপর্যস্ত। আজ থেকে ১৫ মাস আগে, করোনা যখন দেশে প্রথম আঘাত হানে, তখন আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও এতখানি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়িনি। এখন দেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে করোনার ঝুঁকি নেই। তবে রকমফের আছে-মধ্যম ঝুঁকি, উচ্চঝুঁকি এবং অতি উচ্চ মাত্রার ঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪০টি জেলাই আছে অতি উচ্চ ঝুঁকিতে। সে হিসাবে আমাদের প্রায় ৬৩ শতাংশ জেলা ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। যেখানে ৬৩ শতাংশই অতি উচ্চ ঝুঁকিতে, সেখানে বাদবাকি ৩৪ শতাংশ জেলা সংক্রমিত হয়ে অতি উচ্চ ঝুঁকির মাত্রায় আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।
এখানে বিবেচ্য বিষয় দুটি। প্রথমত মৃত্যু, দ্বিতীয়ত সংক্রমণ। যদি আমরা যথাযথভাবে চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হই তাহলে মৃত্যুহার বাড়বে। সেটা নির্ভর করবে বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর। আমাদের দেশে করোনার বয়স প্রায় ১৫ মাস। প্রথম দিকে আমরা এর প্রকৃতি ও ভয়াবহতা নির্ণয়ে অপারগ ছিলাম। সেটা তেমন কোনো দোষের নয়। অনভিজ্ঞতার কারণে অনেক দেশই তা সামাল দিতে পারেনি। কিন্তু এতটা সময় পার করে আজকে এসে যদি সেই পুরোনো সমস্যাকেই দেখতে পাই, তাহলে তা অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য। আমরা প্রথম ঢেউয়ের আভাস না পেলেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের আভাস এক বছর আগেই পেয়েছি। অথচ আমরা হাসপাতালগুলোতে সামান্য অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারিনি। এটাকে ব্যর্থতা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, বরং অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। একটি জেলা শহরের হাসপাতালে অক্সিজেন পাওয়া যাবে না-এটা কোনো সচেতন নাগরিকের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব না। অন্যদিকে করোনা রোগীর চিকিৎসার্থে ঢাকা শহরে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ২ হাজার শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছিল, যা এক বছরের মাথায় বেমালুম উধাও হয়ে গেল। মহাবিপদে এমনটি কী করে মেনে নেওয়া যায়? আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার এই হলো সর্বশেষ হাল।
এবার আসা যাক সংক্রমণ রোধের বিষয়ে। করোনার মতো একটি অতিমারিতে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতামতই প্রাধান্য পাওয়া উচিত। কারণ এর ভয়াবহতার প্রকৃত রূপ তারাই চিত্রিত করতে পারেন। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ আমজনতা বিশেষজ্ঞদের কথাবার্তা থেকে যেটুকু বুঝেছি, তা হলো এ অতিমারিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এর সংক্রমণ রোধ করা। এ সংক্রমণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ হলো শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা (আমি সামাজিক দূরত্বের বিপরীতে শারীরিক দূরত্ব বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি) এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এ শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্যই ‘লকডাউন’ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা দেখে প্রকৃত লকডাউনের অর্থই ভুলে গেছি। সেখানে আবার শ্রেণিভেদ করা হয়েছে-লকডাউন, বিশেষ লকডাউন, আংশিক লকডাউন, কঠোর লকডাউন, সর্বাত্মক লকডাউন ইত্যাদি। লকডাউনকে যে নামেই বিশেষায়িত করা হোক না কেন, তা থেকে কার্যকর কিছুই মিলছে না। লকডাউন কার্যকর না হওয়ার ফলে আজ সারা দেশে করোনা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। অকার্যকর হওয়ার কারণগুলো অনুসন্ধান না করে অধিকতর কঠোর হলেও কোনো ফল মিলবে বলে মনে হয় না।
প্রথম কারণ হলো জীবিকা। অনেকেই মনে করেন, জীবন আগে জীবিকা পরে। আমার মনে হয় এটি একটি অতি গুরুতর বিষয়ের অতি সরলীকরণ। এর উলটো ব্যাখ্যাও হতে পারে। জীবিকার তাড়নায় ঘরের বাইরে গেলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, আর বিনা খাদ্যে বাড়িতে থাকলে নিশ্চিত মৃত্যু হবে। এ যুক্তিকে কি অগ্রাহ্য করা যায়? দেশে যে শ্রমবাজার আছে, এর ৮৬ শতাংশ মানুষই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। তাদের আবার একটি বড় অংশ হলো ‘দিন আনে দিন খায়’ কিংবা দিনমজুর। তাদের অবস্থা কী হবে? দুই-তিন সপ্তাহ ঘরে থাকা সম্ভব? সুতরাং লকডাউন কার্যকর করার প্রথম শর্তই হলো ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করা। এটা কঠিন কাজ কিন্তু অসম্ভব নয়। প্রয়োজন জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা। একজন ওয়ার্ড কমিশনার খুব ভালো করেই জানেন তার ওয়ার্ডে কোন কোন মানুষের লকডাউনকালীন খাবারের প্রয়োজন হবে। সেই খাদ্যের জোগানে প্রয়োজনীয় অর্থ নিজ নিজ এলাকা থেকেই সংগ্রহ করা সম্ভব। গত বছর আমাদের এলাকায় এমন দু-তিনটি দল ছিল, যারা রাতের আঁধারে মানুষের বাড়ি বাড়ি খাদ্যপণ্য সরবরাহ করেছে। কিন্তু এবারে তা পরিলক্ষিত হয়নি।
লকডাউন অকার্যকর হওয়ার দ্বিতীয় কারণটি হলো অসচেতনতা ও উদাসীনতা। করোনার মতো একটি ভয়াবহ পরিস্থিতিকে অনেকে আমলেই নিচ্ছেন না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষজনও এ কাজটি করছেন। বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলেছেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা। সেক্ষেত্রে একটি মামুলি মাস্ক পরিধান করা কি খুব কঠিন কাজ? একটু নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা কি একবারেই অসম্ভব? মোটেই না, তবে আমাদের মূর্খতা ও উদাসীনতা এখানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাসীনতাকে আমরা খুব বেশি আমলে নেই না, তবে কারও উদাসীনতার কারণে অন্য কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তা অপরাধ বটে। সেই অপরাধের ব্যবস্থা নিতে না পারা হলো লকডাউন অকার্যকর হওয়ার তৃতীয় কারণ। জীবিকার প্রয়োজনের বাইরেও প্রচুর মানুষ আছে যারা অকারণেই ঘুরে বেড়ায়। আমরা তাদের আইনের আওতায় আনতে পারিনি। আমরা জানি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করার উদ্যোগ ভালো কিছু নয়। তাই এখানেও জনসম্পৃক্ততার কথাই ঘুরেফিরে আসে। যদি এলাকাভিত্তিক, সমাজভিত্তিক মোটিভেশনের কাজটি করতে পারতাম, তাহলে মানুষকে অন্তত উদাসীনতা থেকে বিরত রাখতে পারতাম। সমস্যা নিরসনের ক্ষেত্রে একমাত্র প্রশাসননির্ভর সমাধানের চেষ্টা সবসময় সফলতা পায় না, যেমনটি পায়নি করোনা মোকাবিলায়। চতুর্থ দুর্বলতা হলো নীতিনির্ধারকদের নিজেদের মধ্যকার অস্পষ্টতা। লকডাউনে অফিস খোলা রাখলে যানবাহন খোলা রাখতে হবে। কিন্তু কার্যত যানবাহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অথচ অফিস চালু থাকছে। এটি এক ধরনের বৈপরীত্য।
লকডাউন যখন নানা কারণে তার কার্যকারিতা হারাল এবং করোনা পরিস্থিতিকে নাজুক অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল তখন তা অন্য নাম নিয়ে হাজির হয়েছে-নাম তার ‘শাটডাউন’। উদ্দেশ্য একটাই-সবাইকে ঘরের মধ্যে রাখা। যেহেতু করোনা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে; তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখন আর অঞ্চলভিত্তিক বিধিনিষেধ আরোপ করে কোনো ভালো ফল পাওয়া যাবে না। তাই গোটা দেশে কমপক্ষে ১৪ দিনের জন্য ‘শাটডাউন’ অবস্থা জারি করা জরুরি। করোনা প্রতিরোধে জাতীয় পরামর্শক কমিটি মনে করে লকডাউনের মতো কোনো ঢিলেঢালা কর্মসূচির দ্বারা করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাই এমনভাবে শাটডাউন দিতে হবে যাতে জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছুই বন্ধ থাকে। অফিস-আদালত-পরিবহণ-লোক চলাচল-সবছিুই ১৪ দিন কার্যকরভাবে বন্ধ রাখতে হবে। সেই সঙ্গে পরামর্শক কমিটি আরও মনে করে, দেশের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তারা হয়তো ভেবেছেন, অর্থনীতির চাকা তো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা যাবে না, তাই বেশিরভাগ মানুষকে টিকার আওতায় এনে একটি ন্যূনতম কর্মপরিবেশ তৈরি করা যাবে। কমিটি তাদের শাটডাউনকে ‘ক্লোজ টু কারফিউ’ বোঝাতে চাইছে। জাতীয় পরামর্শক কমিটির এ সময়োপযোগী সুপারিশকে আমলে নিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ‘যেহেতু করোনার সংক্রমণ বাড়ছে, সে জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয়ভাবেও কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। তা কার্যকরও হচ্ছে। এখন ঢাকার চারপাশের সাত জেলায়ও কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকার কিছুদিন ধরেই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এখন জাতীয় পরামর্শক কমিটি যে সুপারিশ করেছে, সেটি যৌক্তিক। সরকারও কঠোর বিধিনিষেধের চিন্তাভাবনা করছে। যে কোনো সময় সরকার তা ঘোষণা দেবে।’
বাস্তবেও হয়েছে তাই। সরকার শাটডাউনের মতো চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা চাই যে কোনো ধরনের কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার করোনা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনুক, সেক্ষেত্রে নাম তার ‘লকডাউন’ হোক বা ‘শাটডাউন’। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, যে কারণগুলোর জন্য লকডাউন সফলতা পায়নি, সে কারণগুলোর সুরাহা না করে শাটডাউনকে সফল করা যাবে কি? আমরা মনে করি, এখানে জনপ্রতিনিধিদের এবং সব মতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অধিকতর যুক্ত করতে পারলে কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া যাবে।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
