তৃতীয় মত
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিছু কথোপকথন
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিখ্যাত এক ইংরেজ কবি তার কবিতায় এপ্রিল মাসকে নিষ্ঠুরতম মাস বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে নিষ্ঠুরতম মাস আগস্ট মাস। এ মাসেই বঙ্গবন্ধুকে বর্বর ঘাতকরা তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। আগস্ট মাস সারা উপমহাদেশের কাছেও একটি শোকাবহ মাস। এ মাসে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল।
আগস্ট মাস আরও নানা কারণে গোটা বাঙালির কাছে একটি নিষ্ঠুর মাস। এ মাসে ১৯৪৬ সালের ষোল তারিখে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামের কলকাতার ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার নর-নারী-শিশুর মৃত্যু ঘটেছিল। তবে এ আগস্ট মাসে দুটি দিন উপমহাদেশের মানুষের কাছে স্মরণীয়। একটি ১৪ আগস্ট এবং অন্যটি ১৫ আগস্ট। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের সৃষ্টি হয় এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকদের বর্বর বাংলাদেশি অনুচরেরা ভারতবাসীর এ জাতীয় উৎসবের দিনটিকেই মলিন করার লক্ষ্যে বেছে নিয়েছিল স্বাধীন বাংলার স্থপতিকে হত্যার জন্য।
রবীন্দ্রনাথ তার একটি গানে লিখেছেন-
‘মুক্তিদাতা, তোমার দয়া, তোমার ক্ষমা
রবে চির পাথেয় চির যাত্রার।’
এ গানটি শুনলে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ তার গভীর অন্তর দৃষ্টি দ্বারা ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলার মানুষের জন্য তাদের মুক্তিদাতাকে হত্যার কথাটি আগেই জেনে এ গানটি লিখেছিলেন। এ গানে রয়েছে মুক্তিদাতার কাছে দয়া ভিক্ষা ও ক্ষমা প্রার্থনার আকুলতা।
গত বছর (২০২০) আমরা মুজিব জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছি। করোনার এ মৃত্যু বিভীষিকার মধ্যেও দেশ-বিদেশের মানুষ গোটা বছর ধরে এ মহানায়ককে স্মরণ করে অনুষ্ঠান করেছে। লিঙ্কন, গান্ধী, মুজিব-সারা বিশ্বজুড়ে এ নাম তিনটি বিশ্ব মানবতার জন্য আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তাদের মৃত্যু নেই। তারা চিরজীবীদের দলে চলে গেছেন। আমার সৌভাগ্য, আমি এ মুজিব যুগে জন্মেছি। তাকে নিজের চোখে দেখেছি। তার সান্নিধ্য পেয়েছি। এমন বিরল সুযোগ কজনের জীবনে ঘটে!
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্ত আলাপের সুযোগ আমার বহুবার ঘটেছে। একাধিকবার তার কাছে গেছি। তিনি একদিন নাপিতের কাছে চুল ছাঁটছিলেন। তবু আমাকে ফিরিয়ে দেননি। বলেছেন, একটি চেয়ার টেনে কাছে বোস। তার কাছে বসেছি। দেখলাম, যিনি বঙ্গবন্ধুর চুল কাটছেন তিনি একজন মধ্য বয়স্ক লোক। তার সঙ্গে মাঝারি সাইজের একটি কাঠের বাক্স। তার ওপর লেখা ‘রাষ্ট্রপতির নরসুন্দর’। বুঝলাম, বঙ্গবন্ধু তখন রাষ্ট্রপতি। আর এ ভদ্রলোক তার ব্যক্তিগত নরসুন্দর।
বঙ্গবন্ধু যে কাজের মধ্যেও তার দায়িত্ব পালন করেন, সেদিন তা দেখলাম। তার প্রিয় যুবনেতা আবদুর রাজ্জাক (এখন প্রয়াত) কী সব কাগজপত্র নিয়ে এলেন। বঙ্গবন্ধু চুল ছাঁটার চেয়ারে বসেই সেসব কাগজে চোখ বুলালেন। কোনো কোনো কাগজে সই করলেন। আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, তোফায়েল আর আবদুর রাজ্জাক, দুজনেই আপনার হাতেগড়া রাজনীতিক। আপনি কাকে বেশি পছন্দ করেন? বঙ্গবন্ধু বললেন, তোফায়েল এবং রাজ্জাক দুজনকেই আমি পছন্দ করি। তোফায়েল একটু বেশি বুদ্ধিমান, রাজ্জাক একটু বোকাসোকা। তবে আমার খুবই অনুগত।
উৎসাহ পেলাম; বললাম, আপনার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসাবে কি মনে মনে কাউকে ঠিক করেছেন? বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি রাজনীতিতে পারিবারিক উত্তরাধিকার পছন্দ করি না। জওয়াহেরলাল নেহেরু এটা করেছেন। তাতেই কংগ্রেসে ভাঙন ধরেছে। আমি চাই আমার পরে এমন একজন আওয়ামী বাকশালের হাল ধরবে, যিনি আমার রক্তের নয়, আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করবেন। জিজ্ঞাসা করলাম, এমন মানুষ কি আপনার দলের মধ্যে কাউকে খুঁজে পেয়েছেন?
বঙ্গবন্ধু আমার কথার জবাব না দিয়ে বললেন, আমি যে আমার দুই ছেলেকেই আর্মিতে ঢোকাতে চেয়েছিলাম, তার অর্থ কি বুঝতে পেরেছিলে?
সবিনয়ে স্বীকার করলাম, বুঝতে পারিনি। তিনি বললেন, আমি ফাঁসির আসামি হয়ে জঙ্গি শাসনের জেলে থাকতেই ঝটপট হাসিনার বিয়ে দিয়েছিলাম। তার কারণ কী জানো? আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ওরা আমাকে ফাঁসি দিতে পারে। আমি না থাকলে হাসুর মা ওর বিয়ে দিতে ঝামেলায় পড়বে।
আমি বললাম, কিন্তু ছেলেদের রাজনীতিতে না এনে আর্মিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন কেন? বঙ্গবন্ধু সে কথার জবাবও এড়িয়ে গেলেন; বললেন, চৌধুরী, আমার আরও একটি আশঙ্কা, আমার পর দেশে আর্মি টেকওভার হবে। আমাদের আর্মির হাইর্যাঙ্কিং অফিসাররা পাকিস্তানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তারা সাংঘাতিকভাবে পাকিস্তানমনা, পাকিস্তান তাদের সাহায্যে বাংলাদেশে একটা ক্যু ঘটাবার চেষ্টা করবেই। ভুট্টো তো ওদের পেছনে আছেনই। তাই দুছেলেকেই আর্মি অফিসার করতে চেয়েছিলাম, স্যান্ডহার্স্টে পাঠিয়েছিলাম। যদি ওরা সময়মতো আর্মিতে ঢুকে ক্যু ঠেকাতে পারে। কিন্তু ‘ওরা’ আমাকে সময় দিতে চায় মনে হয় না। এজন্য তাড়াতাড়ি বাকশালটা করে ফেলেছি। এটা আমার আদর্শ রক্ষার লাস্ট ব্যারিকেড। আমি যে ইতিহাস গড়েছি তা রক্ষা করার চেষ্টা করছি। যদি ব্যর্থ হই, তাহলে দীর্ঘদিনের জন্য বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাব।
নরসুন্দর বঙ্গবন্ধুর শরীর থেকে চুল ঝেড়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও শরীর থেকে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, আমার সঙ্গে দুপুরে খেয়ে যেও। আমি শাওয়ারটা সেরে আসি। তুমি ততক্ষণ হানিফের সঙ্গে বসে গল্প করো। বলেই বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন। আঘধণ্টা পর ফিরে এলেন। বললেন, আমার সঙ্গে চলো। আমার খাওয়ার ও শোয়ার ব্যবস্থা এখন এই বাড়িতে নয়, পেছনের বাড়িতে। হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু সিকিউরিটি আমাকে নিরাপত্তার জন্য গাড়িতে নিয়ে যায়। চলো গাড়িতে উঠবে।
বঙ্গবন্ধুর সিকিউরিটি চিফ হিসাবে খাকি ড্রেসের যে ব্যক্তি এসে বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট দিলেন, তাকে দেখে বিস্মিত হলাম। স্কুলে তিনি আমার সহপাঠী ছিলেন। এখন কর্নেল, নাম ফিরোজ। তিনি গভর্নর মোনায়েম খানেরও সিকিউরিটি অফিসার ছিলেন। তাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বললাম, ফিরোজ, তুই? বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি ওকে চেনো নাকি? বললাম, কর্নেল ফিরোজ স্কুলে আমার সহপাঠী ছিলো। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, শুনে খুশি হলাম। আমার নিরাপত্তা সম্পর্কে আরও নিশ্চিন্ত হলাম।
একটু হেঁটে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গাড়িতে তার পাশে বসলাম। দশ মিনিটেরও ড্রাইভ নয়। নতুন গণভবন। তার পেছনের লাল রঙের বাড়ি। বঙ্গবন্ধুর খাওয়ার এবং শোয়ার ব্যবস্থা সেখানে। প্রহরীবেষ্টিত। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ভেবেছি, এমন নিরাপদ জায়গা থাকতে বঙ্গবন্ধু কেন প্রতিরাতেই কম নিরাপত্তার বত্রিশ নম্বরে ফিরে যেতেন? কয়েকবার কথাটা আমি বলেছি। বিশেষ করে তখনকার খোকা নামের সন্ত্রাসী বলে পরিচিত যুবকটি গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে তার শয়নকক্ষের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনার পর আমি তাকে তার নিরাপত্তার কথাটা বলেছি। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, তোমরা মনে করো আমি একজন রাষ্ট্রনায়ক। আমি নিজেকে মনে করি টুঙ্গিপাড়ার এক সাধারণ গৃহস্থ, গৃহস্থ কি রাত্রে নিজের ঘরের বাইরে থকে?
সেদিনের ঘটনাটা আমার এখনো মনে আছে। বঙ্গবন্ধুর শয়ন ও খাওয়ার ঘর তখনো নতুন গণভবনেই ছিল। তার পেছনের বাড়িতে সরানো হয়নি। খোকার পরিচিতি তখন মোটামুটি সন্ত্রাসীর। সে এলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু তখন খাওয়া-দাওয়া সেরে শয়নকক্ষে গিয়ে শুয়েছেন। গায়ে সাদা চাদর মাত্র জড়িয়েছেন। খোকা দ্রুত বঙ্গবন্ধুর ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে তার দরজার খিল বন্ধ করে দিল। শয়নকক্ষে বঙ্গবন্ধু ও খোকা। রাষ্ট্রপতির সিকিউরিটি ফোর্সের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল। সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত বডিগার্ড শার্প শুটার মহিউদ্দিন আমার কাছে দৌড়ে এলো। আমিও তখন মাত্র বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গণভবনে এসেছি। মহিউদ্দিন দৌড়ে এসে আমাকে বললো, খোকা বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে। মতলব কী জানি না। আমরা প্রটোকল ভেঙে রাষ্ট্রপতির দরজায় গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে পারি না। আপনি দরজায় ধাক্কা দিন। তার কথা শুনে বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রপতি সে কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তাই দরজায় ধাক্কা দিয়ে চিৎকার শুরু করেছিলাম-মুজিব ভাই, ও মুজিব ভাই।
বেশ কিছুক্ষণ পর খোকা দরজা খুলে দিল। সিকিউরিটি ঘরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমরা এমন করে চেঁচাচ্ছিলে কেন? আমি বললাম, খোকা আপনার ঘরে ঢুকে দরজায় খিল বন্ধ করে দিয়েছিল। খোকা বলল, লিডারের সঙ্গে আমার গোপন কথা ছিল, সেজন্যই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু তাকে শাসানো দূরের কথা, হাসতে লাগলেন। এমন মানুষকে তার নিরাপত্তার কথা কী বলব? তবু সেদিনও বলেছিলাম। তার মুখে একটিই জবাব বাংলার মানুষ আমাকে মারবে না। মারতে পারে না।
বিশ্বাসহন্তা গুটিকয়েক বাঙালিই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। চুল কাটার দিন খাওয়া-দাওয়ার পর তার সঙ্গে আলাপ আর এগিয়ে নিতে পারিনি। এই মহামানুষটি আজ আর নেই। এই আগস্ট মাসেই তিনি চলে গেছেন। এখনো যেদিনই টুঙ্গিপাড়ায় তার সমাধিতে যাই, ফিরে আসার সময় মন হয় তিনি বলছেন-গাফ্ফার, তুমি এখনই যাবে? আরেকটু বসো, কথা আছে।
লন্ডন, ১ আগস্ট রবিবার, ২০২১
