দেশপ্রেমের চশমা
ইসিতে নয়, মূল সমস্যা সরকারে
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নির্বাচন কমিশনকেন্দ্রিক আলোচনা নিয়ে রাজনীতি সরব হয়ে উঠেছে। এ সরবতার মধ্যে সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোর সক্রিয়তা লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব দলের ঘরোয়া সমাবেশ ছাড়াও সব দলের মধ্যেই দলীয় সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা দৃশ্যমান। কোনো দল করছে সিরিজ মিটিং, আবার কোনো দল নানা রকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজ নিজ দলীয় বক্তব্য নিয়ে নাগরিক সমাজকে রাজনীতিতে সক্রিয় করতে সচেষ্ট। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরাও থেমে নেই।
এরাও এদের দলীয় স্বার্থে উচ্চকণ্ঠে একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার বলে যাচ্ছেন। তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যের সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্যের বিস্তর ফারাক। আবার আমাদের মতো বর্ণহীন শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক সুশীল ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা গণতন্ত্র ও দেশের স্বার্থ মাথায় রেখে অব্যাহতভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তবে সরকার সে বক্তব্য সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করলেও তার বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে সরকারপ্রধান এবং সরকারের মন্ত্রীরা বক্তব্য রেখেছেন। তাদের সবার বক্তব্যে একই সুর ধ্বনিত হয়েছে।
তারা বলতে চান, সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করবেন। তার মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে অন্য মন্ত্রীরাও এ ব্যাপারে সরব হন। আইনমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সুর ধরে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে ইসি গঠনের প্রক্রিয়া সমর্থন করে বলেন, যখন সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তখন রাষ্ট্রপতি সবার অভিমত নিয়েছিলেন। সে জন্য তিনি সার্চ কমিটিকে আইন না বললেও ‘আইনের কাছাকাছি’ বলে উল্লেখ করেন।
সেতুমন্ত্রীর সুরও একই রকম। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না।’ নির্বাচনের সময় প্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসহ সব কিছু ইসির অধীনে চলে যায় উল্লেখ করে জনাব ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও সেভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ কিন্তু নাগরিক ও সুশীল সমাজ মন্ত্রীদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। কারণ, তারা একাধিকবার দেখেছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হয় না। সেখানে যোগ্য লোকের সমাবেশ ঘটে না। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে নিয়োগ দেওয়ায় সার্চ কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর মনপছন্দ লেকজনই নিযুক্ত হন। এ ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন সরকার ইসিতে নতজানু লোক বসিয়ে তাদের কাছ থেকে আনুকূল্য গ্রহণ করতে চায়। এ জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সাংবিধানিক আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ইসি গঠনের জন্য ইতোমধ্যে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২১’ নামে একটি আইনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর নেতারা এ প্রসঙ্গে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে উদগ্রীব হয়ে আছেন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে না। তাদের কথাগুলোর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের আগে ওই সময়ের বিরোধীদল আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অস্বীকার করে উপস্থাপিত বিএনপি সরকারের যুক্তিগুলোর প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ওই সময় আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাপাকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর আন্দোলন করে বিএনপিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য করে।
বিএনপি সরকারও সাংবিধানিক আইন ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে রাজি না হওয়ায় দলটিকে একটি যেনতেন প্রকারের ষষ্ঠ নির্বাচন করে ওই নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে স্বল্পায়ুর ষষ্ঠ সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ করে বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম সংসদ নির্বাচন দেয়। ষষ্ঠ নির্বাচনটি ভালো না হওয়ায় ওই নির্বাচনের তীব্র সমালোচনা করলেও ওই সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে বলেনি যে, ষষ্ঠ নির্বাচনকে আমরা মানি না। পরিবর্তে ওই নির্বাচনের পর সংসদে পাশকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ হলে সে আইনের অধীনে দলটি সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ওই নির্বাচন জিতে সরকার গঠন করে পূর্ণ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করে।
ষষ্ঠ ও সপ্তম সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনীতির যে অবস্থা ছিল এখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনীতির অবস্থা অনেকটা তেমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে না পারলেও সাংবিধানিক সংশোধনী এনে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। সরকারদলীয় নেতারা এ প্রসঙ্গে দাবি করছেন, তারাই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তারা ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় রাষ্ট্রপতি মনোনীত নির্বাচন কমিশনের অধীনে সব দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে একমাত্র সরকারি দল ব্যতীত আর কোনো দলের পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব হবে না।
সরকারি দলের নেতারা দলীয় সরকারের অধীনে সব দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে যুক্তি দিয়ে অংশগ্রহণ করাতে অব্যাহতভাবে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। দলীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর কখনো হবে না। জনাব হানিফ বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে রায় ঘোষণা করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আর কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হবে না। তিনি আরও বলেন, যদি কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে সেটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে।
যারা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অবমাননা করে তাদের মনগড়া সরকার দেখতে চায়, তাদের কথা শোনা হবে না। একই সুরে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মিথ্যা স্বপ্ন দেখে কোনো লাভ হবে না। সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কণ্ঠেও একই সুর ধ্বনিত হয়েছে। তিনি বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘যতই এ নিয়ে হইচই করুন না কেন, আগামীতে নির্বাচন কমিশনের অধীনেই ইলেকশন হবে এবং বর্তমান সরকারই সহায়ক সরকার হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে। আগামী নির্বাচনের আগে সংবিধানে হাত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
সরকারের মন্ত্রীদের এসব বক্তব্য ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার হীন স্বার্থে দেওয়া হচ্ছে। এগুলো যুক্তির ধোপে টেকে না। কারণ, নাগরিক সমাজ বারবার দেখেছেন যে, দলীয় সরকারের অধীনে বর্তমান ব্যবস্থায় অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক নাম না দিয়ে একটি যে কোনো নামের নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা কোথায়? তা ছাড়া বিচারপতি খায়রুল হকের যে বিতর্কিত ও খণ্ডিত (৪:৩) রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে আরও দুবার সংসদের অনুমোদনসাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকবারের অধীনে দুটি নির্বাচন করার সুযোগ ছিল।
সে বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার স্বার্থে সপ্তম সংসদে সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারাকে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ না ভেঙে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিরা নিজ নিজ পদে রেখে নতজানু ইসি এবং দলীয়করণকৃত প্রশাসকদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কখনোই ক্ষমতাসীন দলকে নির্বাচনে পরাজিত করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাশ করা হয়েছিল সর্বসম্মতভাবে। কিন্তু এটি বাতিল করা হয়েছে এককভাবে।
কাজেই নির্বাচন কমিশন যোগ্য লোকদের দিয়ে গঠন করলেই স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান সুনিশ্চিত হবে না। এ জন্য সরকারের চরিত্র বদলানো জরুরি। নির্বাচন কমিশন প্রশাসনের যে লোকবল ব্যবহার করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে, সেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর পোস্টিং, বদলি ও পদোন্নতি তো ক্ষমতাসীন সরকারের হাতে। ওই সরকার ও সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করলে কেমন করে ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পক্ষপাতমুক্ত থেকে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন?
স্বচ্ছ নির্বাচন করতে হলে বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃবহাল না করে ভিন্ন কোনো নামে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে সে সরকারের অধীনে অবাধ সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব। এমন সরকারের নাম ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’, ‘তদারকি সরকার’, ‘নির্দলীয় সরকার’, ‘নির্বাচন দেখভালকারী সরকার’ বা অন্য কোনো কিছু হতে পারে। কাজেই স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যারা নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে মাতামাতি করছেন, তাদের ভুলে গেলে হবে না, ইসি যতই ভালো বা শক্তিশালী হোক না কেন, সরকার ও সংসদ না ভেঙে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
সেতুমন্ত্রী ‘আগামী নির্বাচনের আগে সংবিধানে হাত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই’ বলে যে বক্তব্য প্রদান করেছেন, তার মধ্যে সারবত্তা আছে বলে মনে করা যায় না। কারণ, সংবিধান তো নাগরিকদের কল্যাণের জন্য। আমরা যদি নাগরিকদের প্রয়োজনে ১৭ বার সংবিধান সংশোধন করতে পেরে থাকি, তাহলে গণতন্ত্র চর্চার লক্ষ্যে ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে আরেকবার সংবিধান সংশোধন করতে বাধা কোথায়? কাজেই সংশ্লিষ্টজনদের ভুলে গেলে চলবে না, মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে কেবল ভালো নির্বাচন কমিশন গঠন করলেই হবে না, তার আগে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
