নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে আফগানিস্তান
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.)
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আফগানিস্তানে আমেরিকার ২০০১ সাল থেকে অবস্থান ছিল অনেকের কাছে আশীর্বাদের এবং অনেক দেশের কাছে অভিশাপের। ভারত তার কূটনীতি, বুদ্ধি, আন্তর্জাতিক বন্ধুদের সহায়তায় চাইছিল আফগানিস্তানে তালেবান ও আল কায়দাবিরোধী পশ্চিমাঘেঁষা সরকার ক্ষমতায় আসীন থাকুক, যাতে চীন-পাকিস্তান তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সরকারগুলোকে গত ২০ বছর ধরে কেবলই আমেরিকার ধমকানি শুনতে হয়েছে।
আমেরিকার যথেচ্ছ ড্রোন, মিসাইল ব্যবহার নীরবে সইতে হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী জোটে তারাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, বাধ্য হয়েই। অথচ পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আমেরিকার আগ্রাসী আচরণ ও পাকিস্তানের সরকারগুলোর সব নীরবে সহ্য করে যাওয়া মোটেই মেনে নিতে পারছিল না। এরই মধ্যে ভারতের বিশাল বিনিয়োগ, সালমা ড্যাম নির্মাণ, পার্লামেন্ট ভবন নির্মাণ, কাবুলে শিশুদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ, সারা দেশে রাস্তাঘাট নির্মাণ, আইটি বিষয়ে বিশেষ সহায়তা, বাণিজ্য ১ বিলিয়ন ডলারে বিস্তার, ভারতের ইঞ্জিনিয়ারদের অবকাঠামো নির্মাণ ও টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল অনেকের হিংসার কারণ।
এর চেয়ে বড় হলো, পাকিস্তান-চীনের নাকের ডগায় দাদাগিরি। চীন-পাকিস্তান ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় ছিল সুদিনের। চীন এরই মধ্যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (ইজও) বিস্তৃতি নিকট প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে সম্প্রসারণের অপেক্ষা করছিল।
বাইডেন প্রশাসন তার পূর্বসূরিদের পলিসি অনুসরণ করে ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য-সামন্তসহ যাবতীয় সরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়। তালেবান-আমেরিকান এ চুক্তিতে অবদান রাখে কাতার। এতে কপাল খুলে যায় চীন-পাকিস্তানের, আর কপাল পুড়ে যায় ভারতের। আমেরিকা তার অত্যাধুনিক সমরসম্ভার, প্রযুক্তি, হেলিকপ্টার, সামরিক যান ইত্যাদি সহযোগে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছিল আফগান সশস্ত্র বাহিনী। আমেরিকার প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য সহযোগিতায় গত ২০ বছরে আফগান শহর-নগরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আফগান নারীরা গত ২০ বছরে শিক্ষায়, দক্ষতায়, চাকরিতে ভালো অবদান রাখা শুরু করেছিলেন। আমেরিকার ধারণা ছিল, আফগান সামরিক বাহিনীর এতসব প্রশিক্ষণ ও আধুনিক সরঞ্জাম নিশ্চয়ই তালেবান বা আল কায়দার আগ্রাসন ঠেকাতে সক্ষম হবে। এর ফলে একপর্যায়ে আফগানদের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে ন্যাটো ও আমেরিকা প্রত্যাবর্তন করতে পারবে। যদিও তালেবানদের সঙ্গে আমেরিকার দীর্ঘ আলোচনা এবং কাতারের মধ্যস্থতা ছিল দ্বিতীয় রক্ষাকবচ, যাতে আমেরিকানদের অপমানজনকভাবে পালাতে না হয়। তবে তালেবানরা পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে আমেরিকানদের দেশ ছাড়তে দেওয়ার যে অঙ্গীকার করেছিল, তা রক্ষা করেছে। আমেরিকাও তাদের অঙ্গীকার-৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান ছেড়ে দেওয়ার কথা রেখেছে।
বস্তুত আফগানিস্তান এখন চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, কাতার, তুরস্ক ইত্যাদি দেশের কাছে এক অমূল্য উর্বর ভূমি। সেখানে তারা কী করতে চায়, তা দেখার বিষয়। চীন-রাশিয়ার বৈরী কূটনৈতিক দূরত্ব কমে যাওয়ায় এবং দুই দেশের প্রধান শত্রু একই দেশ হওয়ায় তাদের অপূর্ব যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে আফগানিস্তান ঘিরে। চীন কোনোরূপ রাখঢাক না করেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তালেবান সরকারের অর্থকষ্ট এবং আমেরিকার রিজার্ভ ব্যাংকে আফগান অর্থ জব্দ অথবা আটকিয়ে কোনোরূপ ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ কার্টার বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা পৃথিবীতে সংঘটিত প্রায় সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং জনবল ও অর্থের ক্ষতি করেছে; সামরিক ব্যয় অত্যধিক বাড়িয়েছে, যা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনোরূপ শুভ ফল দেয় না। অন্যদিকে, চীন এরই মধ্যে কোনোরূপ যুদ্ধে জড়ায়নি। শুধু তিলে তিলে দেশকে উন্নত করে এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সে বিশ্বের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। সর্বোচ্চ সম্পদশালী দেশ থেকে তার ১ থেকে ২ বছর সময় লাগতে পারে। চীনের উন্নয়ন না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এমনকি ১০-১৫ বছর পূর্বের চীন আর এখনকার চীন ব্যাপক পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। চীন তার দেশকে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়েছে। সারা পৃথিবীকে একটি সড়কে তুলতে চেষ্টা করছে। এমন কী জলযোগাযোগেও তার ‘ইজও’ নীতি কার্যকর করছে। ইউরোপ-আমেরিকা এখন বাণিজ্যের ব্যাপারে চীনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। চীন তার উদ্বৃত্ত অর্থ বিনিয়োগ করছে সারা বিশ্বে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকা চীনের অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। চীন ছাড়া এখন বিশ্ব প্রায় অচল।
আমেরিকানদের আফগানিস্তান ত্যাগ ও ভারতের সব ইঞ্জিনিয়ার-কলাকৌশলীদের দ্রুত প্রত্যাবর্তন নতুন বিশ্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকা-ভারত-জাপান-অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে নতুন সহযোগিতার উন্মেষ ঘটেছে। এ কোয়ার্ডে বাংলাদেশের যোগদানের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে ভারত-আমেরিকার পক্ষ থেকে। আর চীন সোজাসাপ্টা বাংলাদেশকে সাবধান করেছে কোয়ার্ডে যোগদানের ক্ষেত্রে। ভারত এতেই ক্ষান্ত নয়। ভারত যুক্তি তুলেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচটি দেশের সঙ্গে তার দেশের অন্তর্ভুক্তির কথা। ভারতের বিশাল আয়তন, একশ কোটির বেশি জনসংখ্যা, গণতান্ত্রিক দেশ, দক্ষ জনবল, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় ভারতের এলিট শ্রেণিদের দীর্ঘদিনের ব্যাপক অভিজ্ঞতা, পারমাণবিক বোমা মজুত ও সংরক্ষণ ইত্যাদি ভারতকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে সাহস জোগাচ্ছে। এরই মধ্যে বাইডেন প্রশাসন ভারতের এরূপ আকাঙ্ক্ষাকে স্বাগত জানিয়েছে-ভারত যদি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হয়, তাহলে চীন-পাকিস্তানের মাথাব্যথা কেন? এতে তাদের কী ক্ষতি? এরই মধ্যে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারগেই লেভরভ ভারত ভ্রমণ করে গেছেন এবং ভারতের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এ সময়ের সভাপতি হিসাবে করণীয় কী, তার হিসাব কষে গেছেন। তদুপরি আমেরিকা, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ভারতের স্থায়ী সদস্য পদের আবেদনে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। বিপক্ষ শিবির শুধু চীন। ভারত এরই মধ্যে জাতিসংঘে তার স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবর উদ্দীনকে সরিয়ে নামি কূটনীতিক টিএস তিরুমূর্তিকে দায়িত্ব দিয়েছে। এ ছাড়া ভারত কাতার ও বাহরাইনে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছে, যাতে ভারতের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ পেতে সুবিধা হয়। জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন ভারতের দরকার।
চীনের যুক্তি-শুধু ভারতের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের আলোচনা হতে পারে না। একটি প্যাকেজ প্রস্তাব আলোচিত হতে পারে। যাতে ব্রাজিল, জাপান, জার্মানি স্থায়ী সদস্যপদ পেতে পারে। এসব বিবেচনা একসঙ্গে করা উচিত। চীন বলেছে, নিরাপত্তা পরিষদে তারা এমন পরিবর্তন বা সংস্কার চায়, যাতে এ পরিষদের ক্ষমতা ও কার্যকারিতা বাড়ানো যায় এবং ছোট, মধ্যম ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক বেশি সুবিধা পায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। এ রকম প্যাকেজ প্রস্তাবে সব দেশের স্বার্থ ও ঈড়হপবৎহ (ভয় বা শঙ্কা)-এর প্রতিফলন থাকতে হবে।
জেরুজালেম নিয়ে ইসরাইল যেমন, তেমনি কাশ্মীর নিয়েও ভারত জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে না বহু বছর ধরে। ভারতের দুর্নাম রয়েছে প্রিন্সলি স্টেটগুলো ক্রমান্বয়ে নিজ দেশের অভ্যন্তরে গিলে ফেলার বিষয়ে। তা না হলে ভারতের নিরাপত্তা পরিষদে ষষ্ঠ স্থায়ী পদ অলংকরণ ছিল অত্যন্ত সহজ। জেরুজালেম পোস্ট এ বছরের ১৬ আগস্ট এক নিবন্ধে লিখেছে, আফগানিস্তানে কার্যত বিজয়ী কাতার, রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরান। পত্রিকাটির মতে, এসব দেশ খুব সন্তর্পণে তালেবানদের আশ্রয় দিয়েছে এবং পেছনে শক্তি জুগিয়েছে। এরা সবাই চেয়েছে আমেরিকার অসম্মান হোক। ইরান আগেভাগেই বলা শুরু করেছে, তালেবানরা কখনো চরমপন্থা রপ্তানি করবে না। কাতার, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণকে স্বাগত জানিয়ে সতর্ক থাকতে এবং ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দূর করতে সচেষ্ট হওয়ার তাগিদ দিচ্ছে।
তবে এও সত্য, তালেবানদের নারী শিক্ষার ওপর নিয়ন্ত্রণ, শরিয়া আইন ইত্যাদি তাদের ইসলামের উন্নত-সমৃদ্ধ, সহনশীল ধারা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে। ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে তা পশ্চিমাদের সুযোগ করে দিচ্ছে। কাতার অবশ্য এরই মধ্যে তালেবানদের শরিয়া আইনের বিস্তৃত দিকটি উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়েছে প্রকাশ্যে। আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের ফলে যে বিশ্ব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, এতে ভারত সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পাকিস্তানও খুব বড় লাভের মুখ দেখবে না। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান এখন স্বাধিকারের জন্য যে আরও বেশি সোচ্চার হবে, তা সহজেই অনুমেয়। পাকিস্তান খুব সুখে থাকবে, তা নয়। ভারতের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ লাভের প্রচেষ্টায় বাধা দিতে পাকিস্তান চীনের ওপরই ভরসা করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এক্ষেত্রে নিজের পক্ষের কোনো জোরালো দাবি উপস্থাপনের মতো তথ্য ও যোগ্যতা পাকিস্তানের আছে বলে মনে হয় না। শুধু ভারতের বিগত দিনের কৃতকর্ম দেখিয়ে ভারতকে কতদিন পাকিস্তান আটকে রাখতে পারবে, তা দেখার বিষয়।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.) : তুরস্কে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সামরিক অ্যাটাশে
jahangir010754@gmail.com
