শতফুল ফুটতে দাও
উৎসব হোক গণতান্ত্রিক অধিকার ও জাতীয় ঐক্যের
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গতকাল ছিল ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের জনগণ মিত্র দেশ ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে।
এ আত্মসমর্পণ ছিল বাংলাদেশের জনগণের জন্য মহান বিজয় অর্জন। এ বিজয় শুধু বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ নয়, এ বিজয় দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহুমুখী পরিবর্তনের সূচনা করে। বাংলাদেশের জনগণের জীবনে এ বিজয় পরবর্তী দিনগুলোতে রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কী কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দিতে সাহসী হয়েছিল, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আয়তনের দিক থেকে পাকিস্তানের আয়তনের তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তানের এ প্রদেশটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানিদের তুলনায় পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে ঈর্ষণীয় অবদান রেখেছিল।
পাকিস্তান দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর এসব নেতা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মানসিক সংকীর্ণতা এবং প্রচণ্ডভাবে অনৈতিক ভেদনীতির ভুক্তভোগী হয়ে পড়েন। মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন।
আওয়ামী মুসলিম লীগ নামটির অর্থ হলো জনগণের মুসলিম লীগ। এ দল গঠনের ফলে এই অঞ্চলে বিরোধীদলীয় রাজনীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
সদ্য গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের উচ্চতর নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন মরহুম শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ইয়ার মোহাম্মদ খান এবং আতাউর রহমান খানসহ অনেকে। ওই সময়, এমনকি পরবর্তীকালেও একজন সংগঠক হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমান সর্বোচ্চ যোগ্যতার পরিচয় দেন।
মওলানা ভাসানী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি প্রায়ই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এবং সভা-সমিতিতে বলতেন, ‘মুজিব আমার ৩২ জন সেক্রেটারির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেক্রেটারি ছিল।’
পরবর্তীকালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানকে সপ্রশংস দৃষ্টিতেই দেখতেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উল্লিখিত নেতারা মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের ষড়যন্ত্রের ফলে প্রান্তিকতায় নিক্ষিপ্ত হন।
পুরো ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগের অঙ্গন থেকে এসব নেতার বিচ্ছেদ পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছেদকে অনিবার্য করে তোলে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে এক বড় মাইলফলকে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তানের অর্থনীতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিঃসন্দেহে বৃহত্তর হিস্যা ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস। এ প্রদেশের পাট, চা, চামড়া ইত্যাদি রপ্তানি করে পাকিস্তান তার বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারকে অধিকতর পূর্ণ করত। অথচ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য অনেক কম পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার বরাদ্দ দিত। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তান বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হয়েছিল।
ভাষা নিয়ে পাকিস্তানিদের অনেক ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে আমরা দেখেছি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জেদ, রোমান বা আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব এবং পাকিস্তানি ভাবধারার পরিপন্থি অজুহাতে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত প্রচারে নানামুখী নিয়ন্ত্রণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের মনে পাকিস্তান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দৃঢ়মূল করে তুলেছিল। পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোতে গণতন্ত্রের চর্চা ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করা হচ্ছিল।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে জনতার কাতারে শামিল হতে সক্ষম হন। ততদিনে তিনি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতায় পরিণত হন। পরবর্তীকালে পরিণত হন বাংলাদেশের স্থপতিতে। তার বাগ্মিতা হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো বাংলাদেশের জনগণকে রক্তাক্ত অভিযাত্রায় নির্ভীকচিত্তে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা হিসাবে শেখ মুজিবের অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ক্যান্টনমেন্টের বিচারালয় থেকে সাংবাদিক আতাউস সামাদের মাধ্যমে তার মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে মওলানা ভাসানীকে অনুরোধ জ্ঞাপন করেন।
মওলানা ভাসানী প্রয়াত সাংবাদিক আতাউস সামাদের কাছ থেকে শেখ মুজিবের অনুরোধের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘মুজিব একথা বলেছেন!’ মওলানা ভাসানী ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ পল্টন ময়দানের সভায় বজ্র নির্ঘোষে উচ্চারণ করলেন, ‘ফরাসি বিপ্লবের মতো ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে মুজিবকে মুক্ত করে আনব।’ সেদিনের এ সভাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্থাপন করেছিল।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। অর্থাৎ দীর্ঘ ২৩ বছরের ব্যবধানে। ১৯৭০-এ সমগ্র পাকিস্তানভিত্তিক নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন লাভ করে। এক লোক এক ভোট নীতির ভিত্তিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর ফলে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী হয়। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা নির্বাচনের এ ফলাফল দেখে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তারা ভুট্টোকে সঙ্গে নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে শুরু করে। নানা রকম নাটক করে তারা গণতন্ত্রের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানবাসীর আকাঙ্ক্ষা দমনের উদ্দেশ্যে ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়। অবশেষে সমঝোতার জন্য যে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তা ভণ্ডুল করতে এ অঞ্চলের জনগণকে অন্ধকারে রেখে ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। ২৫ মার্চ (১৯৭১) রাতে শুরু হলো অপারেশন সার্চলাইট। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এ অপারেশনের নামে আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করে। সামরিক অভিযানের কবলে পড়ে লাখ লাখ পূর্ব পাকিস্তানি পুরুষ ও নারীকে হত্যা করা হয়। নারীর সম্ভ্রমহানি সব মাত্রা অতিক্রম করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আজ পর্যন্ত যথাযথভাবে রচিত হয়নি। হওয়া সম্ভবও নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর একটি প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনার জন্য যথেষ্ট নয়। এ স্বাধীনতার জন্য অনেকে অনেকভাবে অবদান রেখেছেন। সবার অবদান ও ত্যাগ স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে মহিমাময় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তাৎপর্যগুলো কী? প্রথম তাৎপর্য হলো, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে একমাত্র জাতিরাষ্ট্র। এ জাতিরাষ্ট্র ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মধ্য দিয়ে উত্থিত হয়ে নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে বর্তমান চেহারা ধারণ করেছে। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে ছিল ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর নির্মম হত্যাকাণ্ড, সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান, সামরিক শাসন, স্বৈরতান্ত্রিকতা ও কর্তৃত্ববাদ। স্বাধীন বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম হচ্ছে। গণতন্ত্রের অধিকার অস্বীকার করার ফলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ গোলটেবিল বৈঠকের সংলাপে অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশের বিজয় এসেছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পথে। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় উপমহাদেশের বিভিন্ন নিপীড়িত জাতিকে তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করছে এবং করবে।
অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন কিছুটা হলেও সচ্ছল। এ সচ্ছলতার প্রধান দুটি খুঁটি হলো পোশাকশিল্প এবং প্রবাসী আয়। এ দুটি খুঁটি পুরোপুরিভাবে দেশের বাইরে প্রোথিত। এগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থনৈতিক চাকাকে গতিশীল করতে প্রয়োজন দেশের অভ্যন্তরে আয় বর্ধনকারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের বহুমুখীকরণ এবং এগুলোকে টেকসই ভিত্তির উপর দাঁড় করানো।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা যায় না। জনগোষ্ঠীর গঠন কাঠামোর দিক থেকে বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের পর্যায়ে রয়েছে। এ সুযোগ হাতছাড়া হলে আর পাওয়া যায় না। সুতরাং এ সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন সুশাসন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণ, রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ভগ্নদশা থেকে উদ্ধার করে সুঠাম কাঠামোর ওপর বিন্যস্তকরণ, জনগণের সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণ। কথা ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একাগ্রচিত্তে এগিয়ে যাবে। বাস্তবে তা হয়নি। এগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন দৃঢ় ও ইস্পাত কঠিন রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। উন্নত দেশগুলোর মতো কোনো দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য না থাকলেও সেদেশের মানুষের মুখে সর্বদা হাসির রেখা দেখা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ অবস্থায় পৌঁছাতে পারলে বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। মানুষ দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা এবং ভীতিমুক্তভাবে দিন যাপন করতে পারলে তাদের মুখে অমূল্য হাসির রেখা ফুটে উঠবে।
আরও প্রয়োজন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নির্ভরযোগ্য ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা। এবারের বিজয় উৎসব গণতান্ত্রিক অধিকার এবং জাতীয় ঐক্য সুপ্রতিষ্ঠিত করার উৎসবে পরিণত হোক।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
