প্রধান বিচারপতির মেয়াদ নিয়ে একটি প্রস্তাব
ডা. জাহেদ উর রহমান
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজ থেকে ঠিক ৮০০ বছর আগে সামন্ততান্ত্রিক ইংল্যান্ডে রাজার হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকার বিরুদ্ধে ব্যরনদের প্রতিবাদ হয়েছিল।
রাজাকেও আইনের অধীনে আসতে হয়েছিল। এর পথ ধরে প্রায় আড়াইশ বছর আগের ফরাসি বিপ্লব রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, ভিত্তি স্থাপন করেছিল উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার।
এ পথচলায় নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, মানুষ নিশ্চিতভাবে জানতে পেরেছে রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিযুক্তকরণ (সেপারেশন অব পাওয়ার) কার্যকরভাবে করা না গেলে সেটি আখেরে একজন রাজাই তৈরি করবে। এর মাশুল অনিবার্যভাবেই দেবে দেশের জনগণ। তারপর অনেক দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিযুক্তকরণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে দীর্ঘকাল উদার গণতান্ত্রিকব্যবস্থা কার্যকর আছে।
একটি রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ থাকে। প্রত্যাশা করা হয়, এগুলোর একটি অপরটির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। কিন্তু শাসন আর আইনের ক্ষেত্রে একধরনের মিথস্ক্রিয়া থাকে, যেহেতু এ দুটোই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত। শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলটির বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আইন পরিষদগুলোয় (সংসদ) থাকে, তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাসক দলের ইচ্ছাতেই আইন পাশ হয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে আমাদের দেশে আইন পরিষদ বলে আসলে কিছু নেই, এটি সরকারের আইন পাশ করার একটি ‘রাবার স্ট্যাম্প’-এর বেশি কিছু নয়। এ প্রেক্ষাপটেই বিচার বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে জনগণের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা যাক।
সারা পৃথিবীতে তোলপাড় ফেলে দেওয়া ইসরাইলি স্পাইওয়্যার পেগাসাস দিয়ে ফোনে নজরদারির প্রেক্ষাপটে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে মামলা করা হয়। আদালত সরকারকে বারবার সময় দিয়েছিল এ অভিযোগের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ হাজির করার জন্য, কিন্তু সরকার সেটি করেনি। শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রধান বিচারপতি এনভি রামানার সুপ্রিমকোর্ট বেঞ্চ সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা করে এবং একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি আরভি রবীচন্দ্রন ও দুই সাইবার বিশেষজ্ঞ থাকছেন এ কমিটিতে। এভাবেই বিচার বিভাগ সরকারের দমন-পীড়ন থেকে জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য খুব দৃঢ়ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের নিম্ন আদালত সাংবিধানিকভাবেই (সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ) সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আছে, যা বিচারব্যবস্থার পৃথক্করণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ ২২-এর সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। জেনে রাখা জরুরি, অনুচ্ছেদ ২২ সংবিধানের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’-এর অংশ। তাই এর সঙ্গে কোনো অনুচ্ছেদ কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক হতে পারে না। উচ্চ আদালত সাংবিধানিকভাবে অন্তত স্বাধীন, যদিও সেখানে গিয়েও জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয় সব সময়, এটি বলা কঠিন। ফোনে আড়ি পাতার ঘটনা দিয়ে ব্যাপারটি বুঝে নেওয়া যাক।
ভারতে ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ এসেছে শুধু, রেকর্ডকৃত কোনো অডিও ফাঁস হয়নি। বাংলাদেশে মানুষের ফোনালাপ রেকর্ড করা তো হয়ই, ফাঁসও হয়। এর মধ্যে বাদ যায়নি দেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর ফোনালাপ। তবে অবিশ্বাস্য বিষয় হচ্ছে, এটি নিয়ে আমাদের হাইকোর্টে একটি রিট করা হলে সেটি খারিজ করে দেন আদালত।
একটা সত্যিকারের সাংবিধানিক এবং কার্যকরভাবে পৃথক রাষ্ট্রীয় অঙ্গ হিসাবে কাজ করতে হলে আমাদের বিচারব্যবস্থাকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে এখনো। প্রধান বিচারপতি পদে যিনি আসীন হবেন, তিনি এ লড়াইয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। তার পদকে স্রেফ একটি চাকরি হিসাবে দেখা ঠিক হবে না। তিনি রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অঙ্গের প্রধান। তাই কোনো প্রধান বিচারপতি যদি খুব কম মেয়াদ পান, তার পক্ষে এ ভূমিকা পালন করা আদৌ কতটা সম্ভব? তাই আমি বিশ্বাস করি, প্রধান বিচারপতির মেয়াদ নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
সদ্যনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বাংলাদেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি; অর্থাৎ এর আগে ২২ জন প্রধান বিচারপতি ছিলেন দেশে। তাদের অর্ধেক প্রধান বিচারপতি পদে আসীন ছিলেন এক বছরের কাছাকাছি সময় বা তারও কম। তাদের মধ্যে কমবেশি এক বছরের মতো মেয়াদ পেয়েছিলেন বদরুল হায়দার চৌধুরী, লতিফুর রহমান, মাহমুদুল আমিন চৌধুরী, মাইনুর রেজা চৌধুরী, এমএম রুহুল আমিন। এছাড়া ফজলুল করিম, খায়রুল হক সাড়ে সাত মাস, মোস্তফা কামাল সাত মাস, কেএম হাসান ছয় মাস, হাবিবুর রহমান চার মাস মেয়াদ পেয়েছিলেন। অবিশ্বাস্যভাবে তাফাজ্জল ইসলামের মেয়াদ ছিল মাত্র দেড় মাস।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতমকে নিয়োগ করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু অনুমান করি, বহু ক্ষেত্রে অত্যন্ত কম মেয়াদ পেয়েছেন যেসব বিচারপতি, সেসব ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতাকে নিয়োগ দেওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রধান কারণ ছিল। ওদিকে আবার কোনো বিচারপতিকে কিছুটা বেশি সময় মেয়াদ দেওয়ার জন্য জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করাও এক ধরনের সমালোচনা তৈরি করে।
প্রধান বিচারপতির মেয়াদ প্রসঙ্গে একটি আইনের কথা মাথায় আসছে-‘প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের নিয়োগ, বেতন, ভাতা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি নির্ধারণের জন্য বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন।’ এই আইনে সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী প্রধানদের চাকরির মেয়াদ এখন ‘একসঙ্গে বা বর্ধিতকরণসহ’ সর্বোচ্চ চার বছর হতে পারে (৪.২ ধারা)। এক্ষেত্রে তাদের চাকরিতে অবসরের বয়স বিবেচনায় না নিয়ে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে তাদের নিয়োগ প্রদান করা হয়। যেমন বর্তমান সেনাবাহিনীর প্রধান নিয়োগ পেয়েছেন তিন বছর মেয়াদে।
নিশ্চয়ই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী। বাহিনী গঠনে এবং পরিচালনায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত থাকে। দীর্ঘ সময়ের প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তৈরি হওয়া একজন সামরিক অফিসারের মোটামুটি সময় থাকা প্রয়োজন, যাতে তিনি তার অর্জিত দক্ষতা-অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু তারপরও আমরা জানি, এ পদ দেশের শাসন অঙ্গের অংশ, কোনো স্বাধীন, সাংবিধানিক পদ নয়। তারা কাজ করেন দেশের শাসন অঙ্গের অধীনে।
বিচারব্যবস্থায় নজির খুব গুরুত্বপূর্ণ; যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নজিরকে সম্ভবত একটু বেশিই গুরুত্ব দেওয়া হয়। যাক, তবুও এ অঞ্চলেই প্রধান বিচারপতির বয়স নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির আছে। আমাদের এ অঞ্চলের সাম্প্রতিকতম সংবিধানটি হচ্ছে নেপালের সংবিধান, যেটি প্রণীত হয় ২০১৫ সালে। এর ১২৯ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নেপালের প্রধান বিচারপতির মেয়াদ হবে ছয় বছর।
বাংলাদেশের শাসন এবং আইন বিভাগের মেয়াদ পাঁচ বছর। তাত্ত্বিকভাবে এটি কখনো কখনো কম হতে পারে। একটি সরকার ক্ষমতায় এলে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি ন্যূনতম সময় প্রয়োজন। এ বন্দোবস্তকে যদি আমরা সঠিক বলে স্বীকার করে নিই, তাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে, বিচার বিভাগের প্রধান, প্রধান বিচারপতির জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদ থাকা উচিত। আমরা এমন নিয়ম করতেই পারি, যেখানে তিনি যেন কমপক্ষে ৩/৪ বছর মেয়াদ পান। সেই লক্ষ্যে আমাদের সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
ক্ষমতার বিযুক্তকরণ (সেপারেশন অব পাওয়ার) করার ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। বহু ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়েও পড়ছি বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থাটিই প্রথম ম্যাগনাকার্টার সময়কার একজন কুখ্যাত ‘রাজা জন’ তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। আর এমন সর্বময় ক্ষমতার পরিণতি কী, এ প্রসঙ্গে লর্ড একটনের বিখ্যাত উক্তিটি আমাদের জানা আছে-ক্ষমতা প্রকৃতিগতভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত হতে চায়; সর্বময় ক্ষমতা সর্বগ্রাসী দুর্নীতিপরায়ণতা তৈরি করে (পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট; অ্যাবসলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলিউটলি)।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
