দেশপ্রেমের চশমা
কে কার অলংকার! কে করবে বিচার?
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা সম্প্রতি নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করেছেন। বর্তমান কমিশন ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সিইসি নুরুল হুদার সঙ্গে ইসি কমিশনার মাহবুব তালুকদারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বহুবার মতানৈক্য হওয়ার ঘটনা পত্রপত্রিকার হেডলাইন হয়েছে।
রাতের ভোটের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করে পৃথিবীর সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাসের বইয়ে একটি কালো পাতা যুক্ত করার পর বর্তমান কমিশনামলে অন্য সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও নির্বাচনি দুর্নীতির একই ধারাবাহিকতা প্রবাহিত হয়েছে।
অধিকাংশ নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীদের একটি বড় অংশ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকিদের প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীর সহায়তা নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হতে অসুবিধা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনি এজেন্টরা ভোটকেন্দ্রে থাকতে পারেননি।
ভোটাররাও স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেননি। এই হলো মোটা দাগে কে এম নুরুল হুদা কমিশনের পারফরম্যান্স। তবে এর আগের কাজী রকিব এবং তারও আগে ড. হুদা কমিশনের পারফরম্যান্সও ভালো ছিল না। ওই কমিশনগুলোও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি।
তিন সদস্যবিশিষ্ট ড. হুদা কমিশন (২০০৭-২০১২) চাতুরির সঙ্গে দুর্নীতি করেছে। তাদের আমলে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে বাহ্যিকভাবে সন্ত্রাস-সহিংসতা দৃশ্যমান না হলেও পৃথিবীর সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস ম্লান করে দিয়ে ওই নির্বাচনে ৮৭.৬০ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে। এ থেকে অনুধাবন করা যায়, ওই নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ ছিল। ড. হুদা ইসি অবশ্য চাতুরির আশ্রয় নিয়ে ভোটের কাস্টিং রেট হিসাব করার সময় ‘না’ এবং ‘বাতিল’ ভোট বাদ দিয়ে অন্যায়ভাবে ৮৬.৩৪ শতাংশ ভোট কাস্ট দেখায়। যেখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ৬০-৭০ শতাংশ ভোট কাস্ট হয় না, সেখানে সেনাসমর্থিত সরকার আমলে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ৮৭.৬০ শতাংশ ভোট কাস্ট হওয়া কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
ড. হুদা রেফারির ভূমিকায় থেকে বিএনপির মতো বড় দলকে সরকারি মদদে ভেঙে দুই টুকরা করে সরকারের প্রিয়ভাজন হন। এ কারণে আবার পরে তিনি জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। ২০১২ সালে তার বিদায়ানুষ্ঠানে সাংবাদিক কর্তৃক এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হয়ে ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র ড. হুদা বলেন, জাতীয় জীবনের অনেক কিছু ভুলে যাওয়া ভালো। তিন মাসে ছবি সংবলিত ভোটার তালিকা তৈরির কাজটির সঙ্গে কোনো স্টেকহোল্ডারের দাবি ছাড়াই ভোটের সঙ্গে সম্পর্কহীন জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ জুড়ে দিয়ে ড. হুদা সেনা সমর্থিত সরকারকে ১৮ মাস ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দেন। এ দীর্ঘ সময় ব্যবহার করে ওই সরকার ৪-৫টি সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজের তালিকার মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার করে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রধান দুই নেত্রীকেও গ্রেফতার করা হয়। ড. হুদার সময় অনুষ্ঠিত ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনের সন্ত্রাস-সহিংসতার গতিপ্রকৃতি দেখে প্রয়াত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, ‘এই নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী জয়লাভ করেছে, আর পরাজিত হয়েছে গণতন্ত্র।’ ড. হুদার সময় ইসিতে লাখ লাখ টাকার বদলি বাণিজ্য, পদোন্নতি বাণিজ্য, গেজেট বাণিজ্য, ভোটার তালিকার সিডি বিক্রয় বাণিজ্য অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় ইসি মিরপুর, ফার্মগেট ও বাড্ডায় চারটি ফ্ল্যাট ক্রয়ে ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৯২ হাজার পাঁচশ টাকার দুর্নীতি করলেও এসব দুর্নীতিকারীদের আইনের আওতায় আনা হয়নি।
যে ড. হুদা নিজেই নিজের ঘরে দুর্নীতি কমাতে উদ্যোগ নেননি, তিনি বিদায়ের আড়াই মাস পর টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য পদে মনোনয়ন পেয়ে পুরস্কৃত হন। এমনই একজন কলঙ্কিত সিইসি হয়ে ড. হুদা কোন মুখে বর্তমান সিইসি কেএম নুরুল হুদার কাজকর্মের সমালোচনা করেন তা বোধগম্য নয়। এর অর্থ এ নয় যে, আমরা বলতে চাই, নুরুল হুদা কমিশন ভালো কাজ করেছে। এ কমিশন যে আরও অথর্ব ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেছে তার উদাহরণ তো আগেই ‘রাতের নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের উদাহরণের মাধ্যমে উল্লেখিত হয়েছে। আমরা এ কমিশনের আরও কিছু কাজ সম্পর্কে বলতে পারি। তবে এ দুই হুদা কমিশনের চরিত্র উন্মোচন করতে প্রবন্ধ লেখার পরিবর্তে বই লেখা দরকার। কারণ, তাদের এত বেশি অপকর্ম রয়েছে যা প্রবন্ধে সন্নিবেশিত করা সম্ভব নয়। তবে বই যে লেখা হয়নি, এমন নয়। ড. হুদা কমিশনের ডিএনএ টেস্ট করতে চাইলে পাঠক আমার লেখা নির্বাচন কমিশনের আমলনামা (ঢাকা : অসডার পাবলিকেশন্স, ২০১২) গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন। আর কেএম নুরুল হুদা কমিশনের কার্যকলাপ পরখ করতে চাইলে পাঠকদের আমার লেখা যথাক্রমে প্রসঙ্গ নির্বাচন কমিশন (খুলনা : অধ্যয়ন পরিষদ, ২০২১) এবং বাংলাদেশি নির্বাচন, সংকট ও গতিপ্রকৃতি (খুলনা : অধ্যয়ন পরিষদ, ২০২১) গ্রন্থ দুটি পড়তে হবে। উল্লিখিত গ্রন্থ দুটিকে নুরুল ইমাম খান সাম্প্রতিক সাপ্তাহিক দেশকাল পত্রিকায় রিভিউ করাকালীন ‘লালিত্যময় প্রবন্ধগ্রন্থ’’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। বর্ণিত ইসিগুলোর চরিত্র উন্মোচনে এসব গ্রন্থ নির্বাচনের ইতিহাসে সাক্ষী হিসাবে অবদান রাখবে।
নুরুল হুদা কমিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের চেয়ে নির্বাচনের পর্যবেক্ষকদের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে সমালোচিত হন। তিনি সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেকের সঙ্গে আলোচনা করেন। সুশীল সমাজের সঙ্গে আরপিও সংস্কার নিয়ে মতবিনিময় করতে গিয়ে জনাব হুদা অনুমতি না নিয়ে কেবল ঢাকায় বসবাসকারী ৫৯ জনকে আমন্ত্রণ জানালে ২৬ জনই সে আমন্ত্রণে সাড়া দেননি। পরে কেসিসি, বসিক, সিসিক, গাসিক ইত্যাদি সিসি নির্বাচনে চরম সহিংসতা ও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়লে খুলনা ও গাজীপুর নির্বাচনের নৈরাজ্য নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের প্রতিপক্ষ ছিল প্রশাসন, পোশাকধারী বাহিনী ও সরকারদলীয় ক্যাডার। টিআইবি, সুজন ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকাসহ অনেকেই ৩০ তারিখের ভোট ২৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়ার অভিযোগ করেন। একজন বিবিসি সংবাদদাতা চট্টগ্রামের লালখান বাজারের একটি ভোটকেন্দ্রে সকাল সাড়ে ৭টায় ব্যালটভরা ভোটের বাক্স দেখতে পান। এ সংসদ নির্বাচনে ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে ১০০ শতাংশ, ১২৭টি ভোটকেন্দ্রে ৯৯ শতাংশ, ২০৪টি ভোটকেন্দ্রে ৯৮ শতাংশ, ৩৫৮টি ভোটকেন্দ্রে ৯৭ শতাংশ, ৫১৬টি কেন্দ্রে ৯৬ শতাংশ, ৬৪৬৮টি ভোটকেন্দ্রে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ, ১৫৭১৯টি কেন্দ্রে ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ, ১০০৭৩টি ভোটকেন্দ্রে ৭০ থেকে ৭৯ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়। মোট কাস্টিং রেট ৮০.৮০ শতাংশ, অথচ ইভিএমে ভোট হওয়া কেন্দ্রগুলোর কাস্টিং রেট ছিল ৫১.৪২ শতাংশ। বাহ কী চমৎকার নির্বাচন!
নির্বাচনের পর পুলিশ সুপারদের প্রশংসাবার্তা দেন পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (এডমিন)। এ নির্বাচনে সমন্বয় ও শৃঙ্খলা দেখতে পান প্রধানমন্ত্রীর ওই সময়ের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। কিন্তু জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রশাসন একচেটিয়াভাবে সরকারি দলের পক্ষে মাঠে নেমেছে। পুলিশ প্রশাসন এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ক্যাডার।’ এ নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে দুজন ইসি কমিশনার যথাক্রমে মাহবুব তালুকদার এবং রফিকুল ইসলাম ভোটকেন্দ্রে বিরোধীদলীয় কোনো এজেন্ট দেখেননি। এমন নাউজুবিল্লাহ মার্কা নির্বাচনের পর ইসি পিঠা উৎসব করলে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘মানুষের মতো ভোটও গুম করা হয়েছে।’ পরে উপজেলা ও বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এ নির্বাচনি নৈরাজ্য অব্যাহত থাকে। সিইসি হুদা নিজ দেশের নির্বাচনি সংকট জিইয়ে রেখে ২০২১ সালের ১৬ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচন দেখতে বিদেশ ভ্রমণ করেন।
এই হলো দুই সিইসির সংক্ষিপ্ত কর্মকাণ্ডের খতিয়ান। এদের শরীর কালো দাগে ভরপুর। এরা গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা হিসাবে বিবেচিত ‘নির্বাচন’-এর হত্যাকারী। দুজনকেই গণতন্ত্রকে মুমূর্ষু করার জন্য অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। হুদা কমিশনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে এসেছে। সে জন্য দুই হুদা এখন পরস্পরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন। এরা দুজনই ব্যর্থ। কে কার অলংকার বলা মুশকিল। সম্প্রতি ড. হুদা বর্তমান হুদা কমিশনের সমালোচনা করে বলেন, ‘সদিচ্ছা থাকলে বর্তমান নির্বাচন কমিশন ভালো নির্বাচন করতে পারত। তাদের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক নয়। তারা বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।’ ড. হুদার এ সমালোচনা শুনলে মনে পড়ে বহুল আলোচিত প্রবাদ বাক্য : ‘সুই বলে চালুনিকে তোর পশ্চাতে ছিদ্র।’ প্রশ্ন হলো, এরা বিতর্কিত কাজ করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু সে সমালোচনা আরও বড় বিতর্ক সৃষ্টিকারী ড. হুদার মুখে কি মানায়? কারণ, তিনি তো আরও বড় বিতর্ক সৃষ্টিকারী। বিএনপিকে অন্যায়ভাবে ভেঙে দুই টুকরা করে পরে জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশকারী।
ড. হুদার এ সমালোচনা বর্তমান সিইসি গ্রহণ না করে উলটো তাকে এক হাত নিয়ে বলেন, ‘২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে সিইসির দায়িত্ব পালন করা এটিএম শামসুল হুদা বিরাজনীতির পরিবেশে সাংবিধানিক ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ইসির দায়িত্ব ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করা। তিনি নির্বাচন করেছেন ৬৯০ দিন পর। এ সাংবিধানিক ব্যত্যয় ঘটানোর অধিকার তাকে কে দিয়েছে?’ এ দুই সিইসির বাহাস শুনে মনে হয়, যে লাউ সেই কদু। দুজনই নির্বাচনকে ধ্বংস করেছেন। গণতন্ত্রকে করেছেন মুমূর্ষু। এরা সরকারের অঘোষিত ডিকটেশন অনুযায়ী কাজ করে জনগণের ক্ষতি করেছেন। নির্বাচনের ইতিহাসে এরা দুজনই কলঙ্কিত সিইসি হিসাবে চিহ্নিত হবেন। কে করবে এদের বিচার? এদের কে কার অলংকার? এরা নিজের দোষ না দেখে অন্যকে সমালোচনা করে নিজের কুকর্ম আড়াল করতে চান। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
