দেশপ্রেমের চশমা
সার্চ কমিটি নয়, গুরুত্ব দিতে হবে নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য জাতীয় সংসদে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার আইন-২০২২’ পাশ হয়েছে। সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদে এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপনের পর দুটি সংশোধনীর পর বিলটি পাশ হয়। এ নতুন আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ৬ সদস্যবিশিষ্ট সার্চ কমিটি গঠন করেন।
এ কমিটিতে রয়েছেন বিচারপতি, আমলা এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন ব্যক্তিত্ব। এর গঠন প্রক্রিয়া দেখে অনেকেরই ভালো লাগছে না। তাদের মতে, এ কমিটির মধ্যে সরকারের বেতনভুক কর্মচারী এবং দলীয় পরিচিতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব কম থাকলে ভালো হতো। এমন সব ব্যক্তিত্ব দিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করতে পারলে ভালো হতো, যাদের ওপর জনগণের আস্থা আছে এবং যারা অনেকটা নিরপেক্ষ ধরনের ব্যক্তিত্ব।
এ কথা সর্বজনবিদিত, সরকারের বেতনভুক আমলারা এমন কাজ করতে চাইবেন না যাতে তারা সরকারের বিরাগভাজন হন। তা ছাড়া যারা নির্বাচন সম্পর্কে এবং নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, এমন ব্যক্তিত্বের সমাবেশ সার্চ কমিটিতে হলে ভালো হতো। কারণ, এমন জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিত্বরা বুঝতে পারতেন, ইসিতে নিয়োগের জন্য কেমন ধরনের ব্যক্তিত্বদের নাম দেওয়া উচিত।
নতুন আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি দুজন ব্যক্তিত্বের নাম সার্চ কমিটিতে দিয়েছেন। তাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলা যায়, তাদের একজন নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের চেয়ে সাহিত্য বিষয়ে অধিক ওয়াকিবহাল। অন্যজন নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে জ্ঞান রাখলেও তিনি নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ ড. এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের একজন কমিশনার ছিলেন। পরে তিনি একটি বড় দল থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন।
এমন ধরনের ব্যক্তিকে মনোনয়ন না দিয়ে রাষ্ট্রপতি চাইলে এর চেয়ে আরও যোগ্য ও নিরপেক্ষ ধরনের লোক নিশ্চয়ই সার্চ কমিটিতে দিতে পারতেন। কিন্তু আমাদের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ শুনে কাজ করতে হয়। রাষ্ট্রপতির এ মনোনয়ন দেখে সরকার কেমন ব্যক্তিত্ব সার্চ কমিটিতে বা ইসিতে চাইছে তা কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়।
ইতোমধ্যে ৬ ফেব্রুয়ারি বিকালে সার্চ কমিটি সুপ্রিমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে এর প্রথম বৈঠক করে। এ কমিটি নির্বাচন কমিশনে নিয়োগদানে নাম বাছাইয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নামের তালিকা চাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ছাড়া কমিটি সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গেও এ ব্যাপারে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এসব বিষয় নাগরিক সমাজের কাছে নতুন কিছু নয়। কারণ, তারা দেখেছেন, এর আগের দুটি সার্চ কমিটি লোক বাছাই করার সময় একই ধারায় কাজ করেছিল এবং তার ফলও হয়েছিল একই রকম। অর্থাৎ, গণতন্ত্রে লুকোচুরির কোনো স্থান না থাকলেও কমিটি গোপনে ১০টি নাম বাছাই করে রাষ্ট্রপতিকে জমা দিয়েছিল।
আমরা নাগরিক হিসাবে সে ১০ জনের নাম জানতে পারিনি। পরে রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে ইসিতে নিয়োগ দেন। এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কারা বিবেচিত হলেন, কারা বাদ পড়লেন, সে সম্পর্কে নাগরিক সমাজ পরিষ্কার ধারণা পাননি। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী যাদের পছন্দ করেছেন, রাষ্ট্রপতি সে কজনকেই ইসিতে নিয়োগ দিয়েছেন।
এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির হাতে কোনো বিকল্প ছিল না। এবারও সে একই ধরনের কার্যক্রম হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ কমিটি লোক দেখানোর জন্য ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তালিকা আহ্বান করেছে, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের লোকদেরই যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে ব্যক্তিগতভাবেও যদি কেউ নাম দিতে চায়, কমিটি সে জন্য একটি ই-মেইলের মাধ্যমে এমন নাম প্রদানের সুযোগ দিয়েছে। এতে পত্রিকার খবর অনুযায়ী প্রথম দিনই নাকি ১০০ জনের নাম জমা পড়েছে। কিন্তু তাতে কি কোনো লাভ হবে?
তবে নবগঠিত সার্চ কমিটির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নামের তালিকা গ্রহণের বিষয়টি একেবারেই ভালো হয়নি। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মীরা সব সময় রাজনীতি করছেন। দলের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের তো ওপরে ওপরে কিছুটা নিরপেক্ষতার আবরণ আছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের নামই দিবেন।
আর ভালো নাম দিলেই কি তাকে ইসিতে নিয়োগ দেওয়া হবে? এখানেও আগের মতোই সরকারদলীয় পক্ষ থেকে যে নাম জমা দেওয়া হবে, সে নামগুলো হয়তো প্রাধান্য পাবে। অথবা, সরকারের অনুগত কোনো ছোটো দলকে দিয়ে সরকারদলীয় নেতারা তাদের পছন্দের ব্যক্তিত্বের নাম সুপারিশ করিয়ে সেসব নাম ইসিতে ঢোকাতে চেষ্টা করতে পারেন। মোট কথা, কোনো দল যত ভালো ও যোগ্য লোকের নাম জমা দিক না কেন, চূড়ান্ত নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেবেন। ফলে এ ক্ষেত্রে কোনো উন্নয়ন বা ইতিবাচকতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এটাই বা কেমন শোনায় যে, সার্চ কমিটি ইসিতে নিয়োগদানের জন্য নিবন্ধিত দলগুলোর কাছে নাম চাইছে, আর কোনো কোনো দল বলছে, না আমরা নাম দেব না। আমাদের এমন ইসিতে কোনো আগ্রহ নেই। এতে তো নবগঠিত সার্চ কমিটির সম্মানিত সদস্যদের ভালো লাগার কথা না।
বিএনপির মতো একটি বড় দলের মহাসচিব ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার নিয়োগে গঠিত সার্চ কমিটির কাছে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো নাম প্রস্তাব করা হবে না। সার্চ কমিটিতে অন্তর্ভুক্তদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে আরেকটি হুদা কমিশন করার জন্যই সার্চ কমিটি কাজ করছে। তাই সার্চ কমিটি নিয়ে কোনো আগ্রহ বা প্রত্যাশাও নেই বিএনপির’ (মানবজমিন, ০৭.০২.২০২২)।
সার্চ কমিটির রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নাম না চাওয়া ভালো হতো। কারণ, তারা তো এ দেশেরই লোক। সবাইকে চেনেন, জানেন। আর কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে অধিকতর তথ্য প্রয়োজন হলে তারা সরকারের ইন্টেলিজেন্সের সহায়তা নিয়ে তা জোগাড় করতে পারতেন। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কোনো রাজনৈতিক দল সার্চ কমিটির কাছে তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের নামের তালিকা দিতে এলে তাদের বলা উচিত হতো-আমরা দক্ষ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ ধরনের ব্যক্তিত্ব নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করব।
আপনারা তো রাজনৈতিক দল করেন। আপনারা ২৪ ঘণ্টা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আপনারা দয়া করে আমাদের কোনো নামের তালিকা দিবেন না। আপনারা তালিকা দিলে আমরা সে তালিকা গ্রহণ করব না। আমরা এ দেশের লোক। আমরা সবাইকে চিনি। আমাদের ওপর আস্থা রাখুন।
আমরা নিরপেক্ষ রকমের মেরুদণ্ড শক্ত ব্যক্তিত্ব ইসিতে নিয়োগদানের জন্য সুপারিশ করব। কিন্তু তা না করে তারা দলগুলোর কাছ থেকে নাম নিচ্ছেন। সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব কাজ নাগরিক সমাজের কাছে ‘শো অফ’ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।
নাগরিক ও সুশীল সমাজ সদস্যদের অনেকের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে জানা যায়, তাদের সার্চ কমিটির প্রতি কোনো আস্থা নেই। তারা মনে করেন, সার্চ কমিটি গঠন করে এ প্রক্রিয়ায় না অতীতে একাধিকবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন করা গেছে, না ভবিষ্যতে করা যাবে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এমন ধারণা সক্রিয়। বিরাজিত বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে তারা মনে করেন, মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন করতে হলে সার্চ কমিটি নয়, জোর দিতে হবে যে সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তার স্বরূপের ওপর।
এদের ধারণা, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে যত সার্চ কমিটি আর যত ভালো নির্বাচন কমিশন করা হোক না কেন, কিছুতেই মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। ইনক্লুসিভ নির্বাচন করার একটি মাত্র পথ খোলা আছে। আর তা হলো একটি অস্থায়ী নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।
কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ওই নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীনদলীয় নেতা-কর্মী-ক্যাডাররা প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীর সহায়তা নিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে দলীয় সরকারাধীনে অনুষ্ঠিত শেষ দুটি নির্বাচন কেবল নির্বাচনকেই কলুষিত করেনি, গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কিছু ভুল-ত্রুটি দেখা দিলে ওই ত্রুটিগুলো সংস্কার না করে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত এ ব্যবস্থাকে এককভাবে বাতিল করে ক্ষমতাসীন দল বড় রকমের ভুল করেছে। এখন সে ভুল শুধরে ‘নির্বাচনকালীন’, ‘তদারকি’ বা অন্য কোনো নাম দিয়ে একটি অস্থায়ী নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে ওই সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করলে ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। যত ভালো সার্চ কমিটি আর যত ভালো নির্বাচন কমিশন গঠন করা হোক না কেন, তাতে কাজ হবে না।
নির্বাচনকালীন সরকার হিসাবে কিছু ছোট দল আবার জাতীয় সরকার গঠনের দাবি তুলেছে। কিন্তু সরকার এ বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনাই করছে না। প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-এমপিরা ক্ষমতায় থেকে, সংসদ না ভেঙে দলীয়করণকৃত প্রশাসন ব্যবহার করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করলে সে নির্বাচন কিছুতেই স্বচ্ছ হবে না। কাজেই সরকারসহ সব স্টেকহোল্ডারদের উচিত, সার্চ কমিটিতে মনোসংযোগ না করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে মনোসংযোগ করা। এ ব্যাপারে কী করা যায়, কীভাবে করা যায়, সে বিষয়ে সবার সঙ্গে পরামর্শ করে উপায় উদ্ভাবন করা।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
