ওই গল্পেই রয়েছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ
ডা. জাহেদ উর রহমান
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইউক্রেন সংকট বাংলাদেশের মিডিয়ার তো বটেই, সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মনোযোগের কেন্দ্রে আছে। এ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসাবে এটি দেখা বেশ আনন্দের যে, আমাদের দেশের মানুষ একটি বৈশ্বিক সংকটে তাদের মতো করে অবস্থান ব্যক্ত করছে। বিশ্বায়নের এ যুগে বহু দূরের কোনো ঘটনার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়তেই পারে। ইউক্রেন সংকটের মতো একটি বিরাট ব্যাপার, যেটি বদলে দিতে পারে পুরো বিশ্বব্যবস্থা, সেটার প্রভাব তো আমাদের দেশের ওপর পড়বেই। কিন্তু গত কিছুদিনে এ তুমুল আলোচনার মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের অকল্পনীয় মূল্যবৃদ্ধি।
এ দেশে মাঝেমধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যায়। এর সঙ্গে আমাদের এক ধরনের অভ্যস্ততা আছে। কোনো কিছুর প্রতিকার করা না গেলে অভ্যস্ত হওয়া ছাড়া আর উপায়ইবা কী? প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ দাম বৃদ্ধির একটি প্যাটার্ন আছে। হঠাৎ করে দাম বাড়তে শুরু করে অনেক উঁচুতে উঠে যাবে সেই দাম। সেই মূল্যে থাকবে বেশ কিছুদিন, তারপর কমে আসবে খানিকটা, যদিও আর কখনো যাবে না আগের জায়গায়।
এটুকু কাণ্ডজ্ঞান এ দেশের মানুষের আছে যে, যেসব পণ্যের বড় কিংবা প্রধান অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেগুলোর দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের একটা প্রভাব থাকবেই। ব্যবসায়ীরা দাতব্য সেবা দেন না, ব্যবসা করেন, তাই তারা বেশি দামে আমদানিকৃত পণ্য বেশি দামেই বিক্রি করবেন। এটি বুঝি আমরা, নিজেরা ব্যবসায়ী হলেও আমরাও সেটাই করতাম। সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ যুগে আমরা খুব সহজেই জেনে যেতে পারি বিশ্ববাজারে কোনো পণ্যের দাম আসলে কখন বেড়েছে এবং কতটুকু বেড়েছে। একটু দূরের দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য দেশে এলে বাজারজাত করতে কম-বেশি দুই মাস সময় লাগে। কিন্তু এ কথা এখন সাধারণ নাগরিকরা খুব ভালোভাবে জানেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয় এ দেশে। তাতেও শেষ হয় না জনগণের ভোগান্তি।
মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে দাম যতটুকু বাড়ার কথা দেশে, বাড়ে তার চেয়ে অনেক বেশি। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য যখন কমে আসে, তখন তার প্রভাব দেশে পড়তে লেগে যায় অনেক দীর্ঘ সময়, আমাদের জানানো হয় এখনকার বাজারে থাকা পণ্য কেনা হয়েছিল ‘বাড়তি’ দামে। একইসঙ্গে এটিও আমরা জানি যে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের কারণে যতটা কমার কথা, দেশের দাম কমে তার চেয়ে অনেক কম। বাজারে দোকানদারকে যখন একজন ক্রেতা জিজ্ঞেস করছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তো পণ্যের দাম কমেছে, তোমার দোকানে দাম এখনো বেশি কেন, এর জবাবে দোকানি বলছে, ‘কম পাইলে আন্তর্জাতিক বাজারেই যান’। এমন কৌতুক করা কার্টুন আমরা দেশের পত্রিকায় দেখেছি।
সাম্প্রতিককালে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে চলছে তেলেসমাতি। বরাবরের মতো তেল উৎপাদনকারী এবং বড় বড় ডিলার এর পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি দেখাচ্ছেন। তবে এটিও স্পষ্ট, কারসাজি এটি এখন আর বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দল কিংবা জনগণ বলছে না, বলছে খোদ রাষ্ট্রীয় সংস্থা। সেই প্রসঙ্গে আসছি পরে।
নিয়মিত বিরতিতে এ দেশে বাজারে কারসাজি হবেই। পণ্যটাই পালটে যায় শুধু। কখনো চাল, কখনো পেঁয়াজ, চিনি, তেল এমনকি কাঁচামরিচের দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ খাওয়ার স্মৃতি এ দেশের মানুষের মনে এখনো তরতাজা।
জিনিসপত্রের দাম যে বাড়েই সবসময় তা নয়, কমেও এবং মাঝেমধ্যে মূল্যহীনও হয়ে যায়। গত কয়েকটি ঈদুল আজহায় কুরবানি দেওয়া প্রাণীর চামড়াকে প্রায় মূল্যহীন হয়ে যেতে দেখেছি আমরা। অনেকে ৫০/১০০ টাকায় গরুর চামড়া বিক্রি না করে সেটি ফেলে দিয়েছে। দাম কমে ফসলের মৌসুমে যখন ফসল ওঠে। কৃষক হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে লাভ করা দূরে থাকুক, বহু সময় উঠিয়ে নিতে পারে না তার ধান, আলু কিংবা সবজি আবাদের খরচটুকুও। অর্থাৎ যেসব জিনিসের দাম বাড়লে দেশের হাতেগোনা কিছু মানুষের লাভ হবে, অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়বে সেগুলোর। আবার উলটোদিকে যেসব জিনিসের দাম কমলে বিরাট লাভবান হবে সেই হাতেগোনা কিছু মানুষ, সেগুলোর দাম পড়ে যাবে একেবারেই।
ফিরে আসা যাক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে। প্রতিবার প্রতিটি জিনিসের যখন দাম বাড়ে, তখন সেগুলো নিয়ে নানা আলোচনা হয়। অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কাজ করা মানুষ এবং রাজনীতিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সংকট নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা করেন। টিভির টকশোগুলোতে অনেক আলোচনা হয়, পত্রিকায় কলাম লেখা হয়। এ যাবতীয় আলোচনায় একজন সচেতন নাগরিক মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই জানেন কেন দ্রব্যমূল্য অযৌক্তিকভাবে-অন্যায়ভাবে বৃদ্ধি পায়।
যেহেতু দায়ী কারণগুলো মোটা দাগে সবাই নিশ্চিত করতে পারেন, তাই সেগুলোর সমাধানেও কী কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সেই পথও বাতলে দিতে পারেন খুব সহজেই। মানে প্রতিটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য কারসাজি রোধে অগ্রিম কোন কোন ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এবং সেই কারসাজি যখন শুরু হয়, তখন কোন কোন ব্যবস্থা নিলে সেটি রোধ করা যায় সেগুলো আমাদের অজানা নয়। এ কারণেই এ কলামে সে কারণগুলোর পুনরুল্লেখ করতে যাচ্ছি না। তাহলে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এ দেশের মাটিতে কিছুদিন পরপরই কোনো না কোনো পণ্য নিয়ে কারসাজি হয়? কেন সরকারকে আমরা দেখি না কারসাজি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নিতে?
কৌতুকটি পরিচিত, তবুও বলছি, কারণ এটি আসলে আমাদের খুব সহজে জানিয়ে দেবে কেন দ্রব্যমূল্য নিয়ে এ ভয়ংকর কারসাজি হয় নিয়মিত বিরতিতে। এক রাজার সেনাপতি তার সেনাদল নিয়ে গেছেন অন্য রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। সে যুদ্ধে বাজেভাবে হারে এ রাজার সেনাপতি। যুদ্ধ শেষে নিজ রাজ্যে ফিরে রাজার সামনে জবাবদিহির জন্য দাঁড়ান তিনি। রাজা জিজ্ঞেস করেন যুদ্ধে সেনাপতি কেন হেরেছে। তখন সেনাপতি বলেন, যুদ্ধে হারার একশ একটা কারণ আছে। রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, অতগুলো দরকার নেই, কয়েকটা বলো। সেনাপতি বলতে শুরু করলেন, যুদ্ধে হারার প্রথম কারণ হলো বৃষ্টিতে আমাদের সব বারুদ ভিজে গিয়েছিল, তাই আমরা কামান দাগতে পারিনি। সেনাপতি পরের কারণ বলতে যান, কিন্তু রাজা তাকে থামিয়ে দেন, বলেন, এ কারণের পর আর একটি কারণও জানার প্রয়োজন নেই।
হঠাৎ করে অযৌক্তিকভাবে অনেক বেশি দ্রব্যমূল্য বাড়া নিয়ে দীর্ঘকাল থেকে আমাদের সমাজে আলোচনা হয়। এর ‘১০১টা’ কারণ আলোচনার মাধ্যমে বেরিয়েও আসে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বলা হয় না কোন কারণটিকে প্রথম কারণ বলে মনে করি। অযৌক্তিকভাবে দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়ার একশ একটা কারণ আছে। এর মধ্যে প্রথম কারণটা হলো-দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার ইচ্ছাটাই সরকারের নেই। আমি বিশ্বাস করি, সেই সেনাপতির যুদ্ধে হারার কারণের মতো এই প্রথম কারণটা বলার পর আর কোনো প্রয়োজন নেই পরবর্তী কারণগুলো জানার।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার সরকারের যে কোনো ইচ্ছা নেই এর অনেক প্রমাণ দেওয়া গেলেও এখন দিচ্ছি সাম্প্রতিকটি। ৯ মার্চ জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছিল তার আগের ১৫ দিনে সয়াবিন তেলের বাজার কারসাজি করে অন্তত এক হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছিল। আরও আগের এবং এর পরের সময়টা হিসাব করলে এ অঙ্ক হবে কয়েকগুণ। বেশি হিসাবটার কথা বাদ দেই, সরকার কি ওই এক হাজার কোটি টাকা কারসাজির বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেবে? এর উত্তর এই দেশের একজন শিশুও জানে।
একটা বাজার কারসাজি বন্ধ করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ হচ্ছে বাজার কারসাজির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। কিন্তু এ ঘটনা আমরা দেখি না। কিছুদিন আগে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিটে হাইকোর্ট বলেছেন, কখনো কোনো কারসাজির ঘটনার বিরুদ্ধে লক্ষণীয় আইনি পদক্ষেপ দেখা যায় না।
আসলে এ দেশে যখনই দ্রব্যমূল্যের কারসাজি করে বিরাট অঙ্কের টাকা লোপাট করা হয়েছে, তখনই তার হিস্যা পৌঁছে যায় বহুদূর। তাই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে এ দেশে। এ কারণে সরকারেরই ইচ্ছা নেই এগুলো বন্ধ করার। ইচ্ছাটা যদি থাকত, তারপর বাজারে কারসাজি বন্ধ করার বাকি পথগুলো নিয়ে আলোচনা-মূল্যায়ন করে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়াই যেত।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
