Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ফিরে দেখা স্বাধীনতার ইতিহাস

Icon

ড. এম এ মাননান

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফিরে দেখা স্বাধীনতার ইতিহাস

‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’। দুটি মাত্র শব্দ, একটি ভাস্কর্য। কিন্তু মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের অনেক বছরের দুঃসহ বঞ্চনা আর যন্ত্রণার ইতিহাস। জয়দেবপুর চৌরাস্তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে এ ভাস্কর্য।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মাইলফলক সৃষ্টিকারী এ ‘হঠাৎ যুদ্ধ’ সমগ্র জাতির জন্য একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই একাত্তরের ১৯ মার্চ সংঘটিত হয় একটি খণ্ডযুদ্ধ গাজীপুরে (তখনকার জয়দেবপুরে) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় জনতার। ঘটনাটি ঘটেছিল হঠাৎ করে। জয়দেবপুরে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার জন্য সব বাঙালি সেনাকে অস্ত্র সমর্পণ করার আদেশ দেওয়ার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার তার রেজিমেন্ট নিয়ে জয়দেবপুর পৌঁছেন।

খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক নির্দেশে (বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী) আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে স্থানীয় জনতা জয়দেবপুরের কাছে বাংলার ঐতিহ্যময়ী বংশদণ্ড হাতে নিয়ে কঠিন প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সূচনার আগেই মুক্তিযুদ্ধের যাত্রা শুরু এখান থেকে। ভাস্কর্যটির সামনে দিয়ে আসা-যাওয়ার পথে এটিকে দেখলেই মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অনেক ঘটনা।

১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশ-শাসিত ভারত বিভক্ত হয়ে ‘ভারত’ আর ‘পাকিস্তান’ নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তখনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়ে যায়। এক হাজার মাইলের দূরত্বের দুটি ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত পাকিস্তানে উর্দুভাষী এক ভিনজাতি বাংলার বুকে জুলুম আর শোষণের জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দিয়ে বাঙালির মুখের ভাষাসহ সব স্বকীয়তা কেড়ে নিয়ে শুরু করে বাঙালি জাতিকে নিঃস্ব করে দেওয়ার অশুভ পাঁয়তারা। তৎপরতা শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার। দিন যায়, মাস যায়, বছর পার হয়।

পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের মাত্রা বাড়তেই থাকে। ২৩ বছর ধরে তারা লুণ্ঠন করে এ দেশের অর্জিত সম্পদ, বাধাগ্রস্ত করে সাংস্কৃতিক বিকাশ, ‘তাহজীব-তমদ্দুন’ রক্ষার নামে ঠেলে দিতে উদ্যত হয় বাঙালি জাতিকে কুসংস্কারের গভীর গর্তে, ধর্মান্ধতার গোঁড়ামিতে পুরো জাতিকে আচ্ছন্ন করার প্রয়াসে গ্রহণ করে বিভিন্ন পন্থা, শিক্ষাব্যবস্থায় ঢুকিয়ে দেয় কূপমণ্ডূকতা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কালাকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ করে সৃষ্টি করে মুক্তবুদ্ধিচর্চার পরিপন্থি এক শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ।

শাসকদের মনোভাব ধরতে পেরেছিলেন তরুণ শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলের প্রথম থেকেই। ধীরে ধীরে নিজস্ব প্রজ্ঞায় সব বাঙালিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে শ্রেণিপেশা নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে এক ছাতার তলায় আনতে সক্ষম হন তিনি। বাঙালি জাতীয়তাবোধে সবাইকে উজ্জীবিত করেন। শাসকদের হুমকি-ধমকি-নির্যাতন উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে যা পরবর্তীকালে রূপ নেয় স্বাধীনতার সংগ্রামে।

এ দেশের মানুষের মনে তিনি রোপণ করে দেন স্বাধীনতার বীজ। তার এ প্রচেষ্টার ফসল আমরা দেখতে পাই সত্তরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে। ২টি বাদে সব আসনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ জিতে প্রমাণ করে দিল যে সরকার গঠনের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী আর জনপ্রিয় দল হলো আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি শোষক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে শুরু করে গড়িমসি।

৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণে বঙ্গবন্ধু ডাক দেন স্বাধীনতার, নির্দেশ দেন যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকার, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার। ঘুরতে থাকে ইতিহাসের চাকা। দৃশ্যমান হতে থাকে শাসকদের ষড়যন্ত্র। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনতে থাকে অস্ত্র-গোলাবারুদ। বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে বাংলার ভূখণ্ড দখলে রেখে ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার লক্ষ্যে প্রণয়ন করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বর্বর গণহত্যা চালানোর অভিযান-পরিকল্পনা। ঢাকায় থাকার কারণে গণহত্যার বীভৎস রূপ নিজ চোখে দেখেছি বটে, তবে অভিযানের বিষয়ে আমরা কিছুই জানতে পারিনি।

এ পরিকল্পনার বিষয়ে আমরা জানতে পেরেছি অনেক পরে। বিশেষ করে, ধোঁকামূলক এ পরিকল্পনার মূল হোতা এবং বাস্তবায়নকারীদের অন্যতম ব্যক্তি সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ থেকে কিছু তথ্য জানা যায়।

মেজর জেনারেল রাজার তথ্য অনুযায়ী, পরিকল্পনায় অনেক বিষয়ের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল বাঙালি সৈন্য আর পুলিশকে নিরস্ত্র করাসহ পিলখানা, রাজারবাগ আর চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার থেকে সব রাইফেল দখলে নিয়ে নেওয়া; অপারেশনের শুরুতে সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো অবরুদ্ধ করে রাখা; শেখ মুজিবকে জীবিত ধরা এবং ১৫ জন চিহ্নিত বাঙালি নেতাকে গ্রেপ্তার করা। তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ দুপুরে হাইকমান্ড থেকে সেদিনই রাতের বেলায় তাকে অপারেশন শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এসে যায় ২৫ মার্চ। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক সামরিক অভিযান শুরু করা হয় মধ্য রাতে, চলতে থাকে নির্মম হত্যাকাণ্ড রাজধানীসহ সারা বাংলা জুড়ে। এ রাতটি ছিল বাঙালি জাতির জীবনে এক মর্মান্তিক কালরাত। অবশ্য অনেক রক্ত দিয়ে রক্তের ইতিহাস সৃষ্টি করে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পরিপূর্ণ বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত নয় মাসের প্রতিটি রাতই ছিল আমাদের জীবনে কালরাত। প্রতি রাতেই হানাদার আর তাদের বর্বর দোসরদের হামলা চলত গ্রামে-শহরে বাড়িতে বাড়িতে। সেই সময়কার জীবনে কালো ছাড়া কোনো আলো ছিল না আমাদের সামনে। সেই কী দুঃসহ স্মৃতি!

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরো জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম এক লড়াইয়ে যা রূপ নেয় জনযুদ্ধে। জাতির অস্তিত্ব রক্ষা আর বাঁচামরার এ লড়াইয়ে যোগ দেয় নারী-পুরুষ কিশোর-যুবা নির্বিশেষে সারা দেশের দামাল মানুষেরা। বাঙালির এমন ভয়ংকর রূপ দেখেনি কখনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর সামরিক শাসকরা। ভীত-সন্ত্রস্ত হানাদাররা মুক্তিযুদ্ধকালের নয় মাসে পুরো বাংলার মাটিকে লাশের মর্গ বানানোর লক্ষ্যে শুরু করে অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞ। নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে মরণ কামড় বসিয়ে দেয় শিক্ষাজগতের আলোকিত সূর্যসন্তান আর কবি-লেখক-সাংবাদিক-সাহিত্যিকসহ সৃজনশীল বাঙালিদের ওপর।

মননশীল মেধা ধ্বংস করে পুরোপুরি নিঃস্ব করে দিতে চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে, যাতে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলেও বাঙালিরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এ ছাড়াও, পাকিস্তানি শাসকরা বহু অপরাধের মধ্যে যে গুরুতর অপরাধটি করেছে তা অমার্জনীয়। তাদের ‘ছায়া’ তৈরি করে রেখে গেছে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে, যারা ভেতরে থেকে বিভীষণের মতো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র-অপকর্মের মাধ্যমে ধীরলয়ে বিষ ছড়িয়ে দিতে পারে সারা দেশে, বিভ্রান্ত করতে পারে মানুষকে আর স্বাধীনতাকে করতে পারে বিপন্ন। এরা হলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের লেজুড়বৃত্তি করা ঘৃণিত দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামসের লোকজন, যারা অজানা সংখ্যায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা দেশে, কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও ছদ্মবেশে বিষ-নিঃশ্বাস ছাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে।

ড. এম এ মাননান : কলামিস্ট; সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ উ›মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

ফিরে দেখা স্বাধীনতার ইতিহাস

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম