Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

অপরাধের পুনরাবৃত্তি সহজেই রোধ করা সম্ভব

Icon

মো. সাইফুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অপরাধের পুনরাবৃত্তি সহজেই রোধ করা সম্ভব

প্রতীকী ছবি

ব্যাংকার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান শুভ (ছদ্মনাম)। ছেলেকে কখনোই অপূর্ণতার স্বাদ গ্রহণ করতে দেয়নি। কিন্তু সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আদরের ছেলেটি একদিন বন্ধুদের সঙ্গে ২০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়। এক মাস হাজতবাসের পর শুভ আদালত থেকে জামিন পেলেও দুই সপ্তাহের মধ্যে সে আবারও মাদকসহ গ্রেফতার হয়। পুনঃপুনঃ অপরাধ করায় আদালত থেকে জামিনও মিলছে না। একইভাবে গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে মানিক (ছদ্মনাম) মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে আদালত থেকে এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। কিন্তু সাজা ভোগ শেষে কিছুদিনের মধ্যে আবারও পুলিশ কর্তৃক ধৃত হয়েছে। অভিযোগ-এলাকায় আবারও মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। এভাবে এক বছরে একে একে ৪ বার এলাকায় চুরি হলেই সে গ্রেফতার হয়েছে।

শুধু শুভ কিংবা মানিক নয়, অধিকাংশ অপরাধী এভাবে কারাগারে আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে। জামিনে মুক্তির পর কিংবা সাজা ভোগের পর পুনরায় বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে একই ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা বারবার গ্রেফতার হচ্ছে। কারা অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের তথ্য মোতাবেক, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বিচারাধীন বন্দিদের মধ্যে ১০,৫৪৫ জন আগে একবার, ৫০৫৭ জন আগে দুইবার, ২৪৭৯ জন আগে তিনবার, এভাবে পনেরো বারের অধিক সময় পর্যন্ত মোট গ্রেফতার হয়েছে ১৯,৯১২ জন এবং সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের মধ্যে ৩,৩৮৪ জন আগে একবার, ১৫৫০ জন আগে দুইবার, ৬৯৭ জন আগে তিনবার এভাবে পনেরো বারের অধিক সময় পর্যন্ত মোট গ্রেফতার হয়েছেন ৬০৬২ জন। উভয় প্রকার বন্দি মিলে মোট ২৫,৯৭৪ জন বন্দি একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন, যা মোট বন্দির ৩৫.৪৯ শতাংশ।

পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আর কোনো জরিপ হয়নি। ফলে আমরা জানতেও পারি না বাংলাদেশে অপরাধের পুনরাবৃত্তি ও অপরাধপ্রবণতার (Recidivism) হার বাড়ছে না কমছে। অপরাধবিজ্ঞানে একই ব্যক্তি কর্তৃক ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার এবং সাজা ভোগের পর আবার একই অপরাধে গ্রেফতারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য থাকলেও এই অভ্যাসগত অপরাধী (Habitual Offender) এবং অপরাধের পুনরাবৃত্তিকারীরা বারবার কারাগারে আসা-যাওয়ায় কারা ব্যবস্থাপনায় এবং সমাজে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। একটি রাষ্ট্রের যখন এক-তৃতীয়াংশের অধিক অপরাধী বারবার অপরাধে লিপ্ত হয়, তখন এটি একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।

আমাদের দেশের কারাবন্দিদের অধিকাংশই মাদক মামলার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮-এর ৩৬ (২) ও (৩) ধারানুসারে মাদকদ্রব্য অপরাধের জন্য কেউ একবার সাজাভোগের পর আবার একইরূপ অপরাধ করলে অপরাধটি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অপরাধ না হলে আইন নির্ধারিত দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত হবে। একইভাবে দ্বিতীয়বার সাজাভোগের পর আবার একইরূপ অপরাধ করলে অন্যূন ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এভাবে বেশ কিছু আইনে অপরাধের পুনরাবৃত্তির শাস্তি আইন নির্ধারিত শাস্তির প্রায় দ্বিগুণ শাস্তির বিধান করলেও পুনঃঅপরাধকারীদের ঠেকানো যাচ্ছে না। বরং তারা নিত্য নতুন পন্থায় অপরাধ করছে। ২০১৯ সালের ঢাকা আহছানিয়া মিশনের একটি গবেষণায় দেখা যায়, মাদকাসক্ত থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পরেও আবার মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের ৫২.১ শতাংশ কারাবন্দি হন। এদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ একবার, ৪১.৯ শতাংশ দুই থেকে পাঁচবার এবং ১৫.১ শতাংশ পাঁচবারের বেশি আইনগত কারণে গ্রেফতার হন।

কারাগার থেকে বের হওয়ার পর কেন তারা আবার অপরাধে জড়াচ্ছে-এটা নিয়ে এখন ভাববার সময় এসেছে। কারামুক্ত অপরাধীদের ওপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান কার্যক্রমে শিথিলতা অপরাধীকে আবার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। কারণ কারামুক্ত হয়ে অপরাধী সমাজে তার পুরোনো সহযোগীদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়। এতে অপরাধী আরও সংগঠিত হয়ে আবার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। আমাদের দেশে অপরাধের পুনরাবৃত্তির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরাধীর দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, কর্মসংস্থানের অভাব, পিতা-মাতা কর্তৃক যথাযথ তত্ত্বাবধানের অভাব, মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, কাউন্সেলিংয়ের অভাব, অপরাধীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যথাযথ পুনর্বাসনের অভাব ইত্যাদি।

অপরাধের পুনরাবৃত্তি সারা বিশ্বে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালেও উলটো ঘটনা ঘটেছে নরওয়ে, সুইডেন, লুক্সেমবার্গ, লিশটেনস্টাইন ও নেদারল্যান্ডসে। এ দেশগুলোতে অপরাধের পুনরাবৃত্তি কমে যাওয়ায় একের পর এক কারাগার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের এই দেশগুলোতে কারাগারকে দেখা হয় সংশোধনাগার হিসাবে। তাদের এমন সফলতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উদ্যোগ। নেদারল্যান্ডসের একে একে ২৩টি কারাগার বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিভিন্ন অনুঘটকের প্রভাব ও ধারণাগুলো বিশ্লেষণ করে আমরাও উপকৃত হতে পারি। তারা মনে করেন, কারাগারে অপরাধীদের উপর যেভাবে আচরণ করা হবে, কারামুক্তির পর সমাজে তারা একই রকম আচরণ করবে। তারা মূলত দুটো লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। প্রথমত, অপরাধীর অন্য একটি অপরাধ প্রতিরোধ করা এবং দ্বিতীয়ত, অপরাধীর বয়ে নিয়ে আসা মানসিক যন্ত্রণা ও সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সেখানে বিচারকরা অপরাধীদের কারাদণ্ডের বিকল্প শাস্তির ব্যবস্থা করে থাকেন। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কমিউনিটির বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়, জরিমানা করা হয় এবং প্রযুক্তির সাহায্যে ইলেকট্রিক অ্যাংকেল মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হয়।

অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে নরওয়ে বিস্ময়কর সাফল্য পেয়েছে। তাদের কারাগার ব্যবস্থাটি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে পুনর্বাসনের ওপর জোর দিয়েছে। এখানে পুনর্বাসনমূলক পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, চাকরির প্রশিক্ষণ, ব্যবসা-বাণিজ্যে সফলতা অর্জনের কর্মশালা এবং বিভিন্ন ধরনের থেরাপি। বন্দিদের যাদের আগে দিনের বেশিরভাগ সময় তালাবদ্ধ করে কাটাতে হতো, তাদের প্রতিদিন প্রশিক্ষণ ও শিক্ষামূলক কর্মসূচি দেওয়া হয়। এ ছাড়া মুক্তির পরে একজন সাবেক বন্দিকে থাকার জায়গা, কাজ বা শিক্ষার সুযোগ, ঋণ পরামর্শ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন পরিষেবার নিশ্চয়তা নিয়ে কাজ করা হয়। এ পদ্ধতির সফলতাও পেয়েছে স্পষ্টভাবে। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ’র তথ্য অনুসারে, ২০০৫ সালে নরওয়েতে অপরাধপ্রবণতার হার ছিল ২০ শতাংশ এবং ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অথচ ১৯৮০ সালের আগে এটি ছিল প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ।

সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা যেন আবার অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘মুক্ত কারাগার’ নামের এক ধরনের সংশোধনাগার আছে। আমাদের দেশে ২০১৭ সালে কক্সবাজারের উখিয়ায় এমন কারাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল যা এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের জন্য মুক্তিপূর্ব এই উন্মুক্ত কারাগার অপরাধীর পুনরাবৃত্তি রোধে দারুণ কার্যকর। নির্ধারিত সাজার অধিকাংশ সময় যেসব বন্দি পার করেছেন এবং যারা কারাগারে ভালো আচরণ করেছেন, কেবল তাদেরই উন্মুক্ত কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে শুধু ভারতেই এরূপ ৬৯টি কারাগার রয়েছে। ভারতে ওড়িশা রাজ্যের বিজু পাটনায়ক উন্মুক্ত আশ্রম বন্দিদের গুরুত্বপূর্ণ মানবিক কাজেও নিয়োজিত করে। সেখানে আগ্রহী বন্দিরা বন্যাকবলিত গ্রামে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে সহায়তা করেছে। এ ধরনের কমিউনিটি সম্পৃক্ততা তাদেরকে অপরাধবিমুখ করে সমাজের উপযোগী করে তুলতে সাহায্য করে।

সম্প্রতি ইতালিতে বন্দিদের জন্য একটি পুনর্বাসন কর্মসূচি সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। ২০১৮ সালে সিএনএনের একটি প্রতিবেদনে দেখেছি, তুরিনের একটি কারাগারের পরিচালক কয়েদিদের মধ্যে রাগবি খেলার প্রচলন করেন। পরবর্তীকালে প্রতিযোগিতামূলক রাগবি কারাগারে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে অনেক কয়েদি মুক্তির সময় হলেও কারাগার ছেড়ে যেতে চাচ্ছিল না। গবেষণায় দেখা গেল, সেখানে রাগবি প্রশিক্ষণ ও খেলার পর মুক্তি পাওয়া কয়েদিদের অপরাধপ্রবণতা কমে ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবে যেটি ৭০ শতাংশ থাকত। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক কয়েদির অপরাধপ্রবণতা কমে গেছে শুধু খেলাধুলায় যুক্ত হওয়ার পর। এ সফলতায় পরবর্তীকালে আরও বিভিন্ন কারাগারে তা চালু করা হয়েছে।

গত একযুগে আমাদের দেশেও ব্যাপক কারা সংস্কার হয়েছে। অর্ধ লক্ষাধিক বন্দির কর্মমুখী প্রশিক্ষণ গ্রহণ, বন্দিদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কারাগারে ফোন বুথ স্থাপন এবং কারাভ্যন্তরে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির লভ্যাংশের ৫০ ভাগ প্রাপ্তি ইত্যাদি কার্যক্রম নিঃসন্দেহে তাদের অপরাধবিমুখ করে সমাজের উপযোগী করে তোলে। আমরা নরওয়ের হালডেন কারাগারের মতো অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মতো কয়েকটি সংশোধনাগার হয়তো বানাতে পারব না, কিন্তু দেশের ৬৪ জেলায় মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদিদের পুনর্বাসনের জন্য আমরা ২/১টি প্রকল্প হাতে নিতেই পারি। সরকারি প্রকল্পের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোও কাজ করতে পারে। দিন দিন প্রবেশন অফিসারদের কাজের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় এই প্রকল্পের আওতায় পৃথক আফটার-কেয়ার সার্ভিস অফিসার নিয়োগ করা যেতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে শুধু আর্থিক অনুদানে অপরাধী পুনর্বাসিত হয় না। আর্থিক অনুদানে গ্রহীতা অন্যের মুখাপেক্ষী হয়, পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পুনর্বাসন কর্মসূচিগুলো হতে হবে চাহিদাভিত্তিক। কারণ একেকজন অপরাধীর চাহিদা একেকরকম। যে পর্যায়েই কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হোক না কেন, ফলোআপটা খুব জরুরি। সঠিকভাবে ফলোআপ না করলে যে কোনো কর্মসূচি ব্যর্থ হতে পারে।

এ ছাড়া মামলাজট কমানোর জন্য কারাদণ্ডের বিকল্প পদ্ধতিগুলোর ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্রবেশন, প্যারোল, ফারলো, কনডিশনাল ডিসচার্জ-এগুলোর প্রয়োগ বাড়াতে হবে। এ পদ্ধতিগুলো অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে দারুণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। অনেকেই মনে করেন, এসব পদ্ধতি আমাদের দেশে প্রয়োগযোগ্য নয়, এগুলো পশ্চিমাদের জন্য। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নেদারল্যান্ডসের মানুষও অতীতে জলদস্যু ছিল, অপরাধপ্রবণ জাতি হিসাবে তাদের দুর্নামও ছিল। তারা এ পদ্ধতিগুলোর যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই সফল হয়েছে। আশার কথা, ইতোমধ্যে দেশের প্রায় সব জেলাতে প্রবেশন ও কনডিশনাল ডিসচার্জ পদ্ধতি দুটোর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা যদি এই পুনরাবৃত্তিকারীদের প্রতিরোধ করতে পারি তাহলে ফৌজদারি মামলার একটি বড় উৎস বন্ধ হবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও ২০২০ সালে ১ বছরের কম সাজাপ্রাপ্ত ২৮৮৪ জন লঘুদণ্ডের অপরাধীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে এরূপভাবে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের মুক্তি দেওয়া হয়। কারা অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ২০০৯ সাল থেকে অক্টোবর, ২০২০ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ৭,২৫৫ জন বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বিচারাধীন বন্দিরাও কিছুদিন হাজতবাসের পর জামিনে মুক্তি পাচ্ছে। কিন্তু তারা আবার অপরাধ করল কিনা সেটা নিয়ে যথাযথ ফলোআপের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে যেটা হচ্ছে, কারামুক্তির পর অপরাধীরা সমাজে খাপ খাওয়াতে না পেরে কারাগারে আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে। এজন্য তাদের ছবি, বায়োমেট্রিক ছাপ ও আগের অপরাধের রেকর্ডসহ একটি ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একবার কাউকে গ্রেফতার করলে তার তথ্য ডাটাবেজে চলে আসে। এটা করতে পারলে খুব সহজেই একজন কারামুক্ত অপরাধীকে মনিটর করা সম্ভব হবে এবং সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।

কারামুক্ত ও প্রবেশনে মুক্ত অপরাধীদের অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে প্রবেশন অ্যান্ড আফটার-কেয়ার সার্ভিস বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ অপরাধীদের একমাত্র নিবিড় অবেক্ষণ ও পরিকল্পিত পুনর্বাসন কর্মসূচি এ থেকে মুক্তি দিতে পারে। এতে শুধু সমাজ থেকে অপরাধপ্রবণতাই কমবে না, কারাগারের জনসংখ্যাধিক্য কমবে এবং নতুন মামলা প্রতিরোধে আদালতের ওপর চাপও কমবে। পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার প্রবেশন অ্যান্ড আফটার-কেয়ার সার্ভিস বিভাগের ২০০৭ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেখানে সাবেক অপরাধীদের তত্ত্বাবধান ও তাদের সমাজের উপযোগী করে প্রস্তুত করার জন্য একটি প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হয়েছিল। প্রোগ্রামটি এই ভিত্তির ওপর তৈরি করা হয়েছে যে, অপরাধীরা কেবল শাস্তিই নয়, শাস্তির ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে অপরাধমুক্ত জীবন গড়ার সুযোগও পেতে পারে।

জেলখানায় থাকা বন্দিরা আমাদের কারও ভাই, বন্ধু বা প্রিয়জন। সুযোগ পেলে তারাও সংশোধন হয়ে সমাজের মূলধারায় পুনর্বাসিত হতে পারে। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই অপরাধের পুনরাবৃত্তি নিয়ে গবেষণা হয়। অপরাধপ্রবণতার হার বাড়লে তা কমানোর জন্য তারা মাস্টারপ্লান করে ফেলে। আমাদেরও তাদের অনুসরণ করে উন্নয়নমূলক, সংস্কারমূলক এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু বড় বড় চোখ ধাঁধানো অবকাঠামোর উন্নতি করলে চলবে না। আমাদের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ও অপরাধপ্রবণতার হার কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। সামাজিক উন্নয়ন না হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কোনো অর্জন মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারবে না।

মো. সাইফুল ইসলাম : যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, কুড়িগ্রাম

অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম