বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ ফিরে আসুক
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক অর্থে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে সাধ্যমতো ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবাসিক হল থাকছে। সময়ের চাহিদায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পাল্লা দিয়ে হলগুলো সব শিক্ষার্থীকে ধারণ করতে না পারলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থী কোনো না কোনো হলের সঙ্গেই সংযুক্ত থাকে। তাদের অর্জিত ডিগ্রির সনদে থাকে হলের পরিচিতি। অর্থাৎ ডিগ্রি অর্জনকারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হলের আবাসিক ছাত্রছাত্রী ছিলেন এর উল্লেখ থাকে সনদে।
তাই স্বর্ণালি যুগে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের পাশাপাশি নির্বাচিত হল সংসদও গঠিত হতো। হল পরিচালনায় এ হল সংসদের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেত হল প্রশাসন। হল সংসদ দলমতনির্বিশেষে সব আবাসিক শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্ব করত। তাই শিক্ষার্থীদের ভরসার স্থল ছিল হল সংসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্রনেতারা। হলের আবাসিক ও অনাবাসিক ছাত্ররা নিজেদের আপন মনে করত হলগুলোকে। অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ্যতায় এগিয়ে থাকার একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতাও ছিল। হল সংসদের তত্ত্বাবধানে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, আন্তঃহল বিতর্ক, নাট্য ও নানা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা বিকাশের সূতিকাগার ছিল হলগুলো।
এসব এখন শুধু স্মৃতি হয়ে রয়েছে। এখন হল মানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রছাত্রী নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। হল পরিচালনায় হল প্রশাসন ঠুঁটো জগন্নাথ যেন! এখানে ক্ষমতার রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ছাত্ররা সামন্ত প্রভুর ভূমিকায় থাকে। অন্যসব আবাসিক শিক্ষার্থী অনেকটা তাদের আজ্ঞাবহ দাস। প্রভুত্ব বজায় রাখতে মাঝেমধ্যে নিবর্তনমূলক আচরণ নেমে আসে সতীর্থ শিক্ষার্থীর ওপর। এ কারণে এখন প্রত্যেক হলেই অলিখিত নাম হয়ে গেছে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীর কক্ষ’, আর ‘রাজনৈতিক কক্ষ’। রাজনৈতিক কক্ষের দাপুটে নেতাকর্মীদের অনুমোদন ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিশেষ কিছু করার বা বলার সাধ্য সাধারণত থাকে না। সবচেয়ে দুর্ভাগ্য এই হল প্রশাসনে যুক্ত শিক্ষকরাও আজকাল নাকি রাজনৈতিক কক্ষের নেতাদের ঘাঁটায় না। ওদের ইচ্ছাকেই নীরবে মেনে নেয়। যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকারের অনুগত রাজনৈতিক দলের ছাত্ররা হলে ক্ষমতাবান থাকে এবং সাধারণত একই রাজনৈতিক দলসমর্থিত শিক্ষকরা প্রায়ই হল পরিচালনার দায়িত্ব পান, তাই উভয় পক্ষের মধ্যে একটি আপস রফা হয়ে যায়।
এসবের কুপ্রভাবে এখন হল ঘিরে তেমনভাবে সুস্থ সংস্কৃতিরচর্চা হয় না। হলে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, আন্তঃহল প্রতিযোগিতা এসব অনেকটা অচেনা হয়ে যাচ্ছে। এখন শোনা যায়, দলীয় ছাত্রদের মিছিলে যেতে বাধ্য করা হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। ক্লাস-পরীক্ষার দোহাইও মানা হয় না। আর এমন অধঃপতনের সব দায়ই বর্তায় আমাদের জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রকদের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে অবস্থানের কারণে কাছে থেকে দেখি এসব জাতীয় নেতা-নেত্রী নিজেদের ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার পথ কুসুমাস্তীর্ণ করতে ক্যাম্পাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে চতুর আচরণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে তরুণদের সোনালি স্বপ্ন বোনার কথা, নিজেদের চৌকশ করার জন্য মেধা শানিত করার কথা, সেখানে নেতারা এদের অস্ত্রবাজ-চাঁদাবাজ আর সন্ত্রাসী হিসাবে গড়ে তোলার পথ করে দিচ্ছেন। আর ক্ষমতার সুখ সুবিধায় বসে এসব জাতীয় নেতা যখন বড় বড় কথা বলেন, হেদায়েতের বাণী শোনান, তখন ভীষণ কপট মনে হয়।
বোকা ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে চায় না নেতাদের লাঠিয়াল হতে গিয়ে শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অর্জনকে বর্জন করছে, জীবনের সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয় সময়গুলোকে অন্ধকার আর অনিশ্চয়তায় ঢেকে দিচ্ছে। দুদিনের দাপটের বড় খেসারত দিতে হবে সারা জীবন। তখন কোনো নেতা পাশে এসে দাঁড়াবে না। এদের চোখে অঞ্জন মেখে দেওয়া হয় সুনিপুণভাবে। পাশ করলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা হিসাবে লোভনীয় চাকরি-বাকরি পেয়ে যাবে। কেউ কেউ নেতাদের আশীর্বাদে পেয়েও যায়। অন্যদের দিকে নেতারা ফিরেও তো তাকাবেন না। এরা বুঝতে পারে না একশজনের ভাগ্য ফিরলেও এক লক্ষ জন আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। যখন বুঝতে পারবে তখন নিজেকে তৈরি করার মতো সোনালি সময়গুলো আর ফিরে পাবে না। শিক্ষক হিসাবে এ কষ্টবোধ সব সময় আমাদের বুকে বাজে।
আমি যখন কোনো এক হলের প্রাধ্যক্ষ, তখন আমার এক মেধাবী ছাত্র হলের সরকারি ছাত্র সংগঠনের বড় নেতা। ছেলেটি পড়াশোনো করলে ভালো করত। আমি অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বোঝাতাম পরিবারের প্রতিও তোমার দায় আছে। রাজনীতি কর ভালো, পাশাপাশি নিজের একাডেমিক যোগ্যতাও বাড়াও। ছেলেটি তখন মাস্টার্সের ছাত্র। বলত স্যার চিন্তা করবেন না। আমার দলের উচ্চপর্যায় থেকে আশ্বাস দিয়েছে আমার পুলিশে চাকরি প্রায় নিশ্চিত। মনে করতে পারেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট কার্ড আমার পকেটেই আছে। ও পাশ করতে করতে ওর দল ক্ষমতাচ্যুত হলো। দল ক্ষমতায় থাকলে কী হতো তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তবে ছেলেটির সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়। বিবর্ণ অবয়ব। জমির দালালি করে কোনোভাবে জীবন নির্বাহ করছে।
আমাদের ক্ষমতাপ্রিয় দায়িত্বহীন রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কাঠামো ও শিক্ষা সংস্কৃতির পরিবেশ পুরোটাই ধ্বংস করে দিয়েছে। বর্তমান ধারার ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্রুপদি সংজ্ঞার আর প্রতিনিধিত্ব করে না এখন। একজন আদর্শবান, মেধাবী, যোগ্য শিক্ষক বিশ্বাস করেন, শিক্ষক রাজনীতির বলয়ে না থাকার অপরাধে তিনি সরকার বা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো মর্যাদা পাবেন না। একজন শানিত মেধার শিক্ষার্থী বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, রাজনীতিসংশ্লিষ্ট না হওয়ায়, শক্ত তদবিরের কেউ না থাকায় এবং প্রশাসনকে তুষ্ট করার অন্য কোনো রসদ না থাকায় ক্ষমতার রাজনীতির পরিচয়ে থাকা প্রশাসন তার শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছার পথে ব্যারিকেড তৈরি করবে।
আমাদের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা জাতীয় রাজনীতি অঞ্চলের বড় নেতা-নেত্রীদের সন্তানদের খোঁজ করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে পাই না। শোনা যায়, এদের অনেকের সন্তানরাই নাকি দেশের ইংরেজি মাধ্যমে ও লেভেল, এ লেভেলে পাঠ শেষ করে বিদেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নিজেদের উজ্জ্বল করছে। তাই এসব ক্ষমতাবান নেতা-নেত্রীর কতটুকুই বা দায় রয়েছে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন নিয়ে ভাবার! এ বাস্তবতায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক পেশিশক্তি সরবরাহের ক্ষমতাকেন্দ্রে পরিণত করতেই বেশি উৎসাহী থাকেন। এর ফলাফলে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জ্ঞান সৃষ্টির প্রতিষ্ঠান হিসাবে তেমনভাবে আর দেখতে পারছি না। প্রথিতযশা পণ্ডিত অধ্যাপকদের এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিচালনায় দেখা যায় না। তাই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চর্চার বাইরে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির পথে নেতৃত্ব নিতে এগিয়ে আসা তেমন পণ্ডিতজনের সংখ্যা কমে আসছে। এ কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্ব র্যাংকিংয়ের তলানিতেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন বাস্তবতা কাছে থেকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে ভাবি, বর্তমান সরকারের এতসব অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফসল কতটুকু সময় পর্যন্ত আমরা বহন করতে আর এগিয়ে নিতে পারব! শুধু রাজনীতি নয়-শিক্ষা-গবেষণায় এগিয়ে থাকা মানুষের হাতে যদি উন্নয়নের ধারা লালন করার মশাল তুলে দিতে না পারি, তবে সবকিছুই না একসময় অর্থহীন হয়ে পড়ে!
তাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আবার এর সোনালি দিনে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন বুনি। ভাবতে ভালো লাগে হলগুলো যেন আবাসনের পাশাপাশি জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার চারণভূমিতে পরিণত হতে পারে। অসুস্থ রাজনীতির বলয়মুক্ত হয়ে ষাট ও সত্তরের দশকের আদলে হলগুলোয় যেন ছাত্র সংসদ গঠিত হতে পারে। একই ধারাতেই গঠিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। তবে সাম্প্রতিক ডাকসু নির্বাচনের মডেলে নয়। দীর্ঘ দাবির পর বিশেষ ধারার ডাকসু নির্বাচন দিয়ে কৌশলী রাজনীতি বুঝিয়ে দিল রাজনীতির কুশলীরা জানেন কীভাবে নিয়ন্ত্রণের লাগাম হাতের মুঠোয় রাখতে হয়।
সুস্থ ধারা ফিরে পেতে হলে রাজনীতির কোটারিভুক্ত অন্ধদের নয়, শানিত উজ্জ্বল দৃষ্টির মেধাবী শিক্ষকদের যুক্ত করতে হবে হল প্রশাসনে। যারা নিরপেক্ষভাবে সাহসিকতার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকেই সেই পথ তৈরি করে দিতে হবে। এভাবে ছাত্র-শিক্ষকের সম্মিলনে একটি সুস্থ ধারা ছড়িয়ে পড়বে। এর আলোই বিচ্ছুরিত হবে ক্যাম্পাসজুড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিচালনায় বিবর্ণ রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলতে হবে। যোগ্য মানুষের প্রতিভা বিকাশের পথ করে দিতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো অনেক প্রথিতযশা পণ্ডিত ও গবেষক অধ্যাপক রয়েছেন। রাজনীতির কালো চাদরওয়ালারা সুকৌশলে তাদের ঢেকে রাখতে চাইছেন প্রতিমুহূর্তে। সুযোগ পেলে সম্মানিত করার বদলে তাদের অসম্মানিতও করা হয়। এমন ধারা বজায় থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আপন মহিমায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। দুরাশা হলেও আমরা আশা ছাড়তে চাই না। প্রত্যাশা থাকবে, সুস্থতা ফিরে আসবে ক্যাম্পাসে।
নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাতে পারব-কজন কল্পনা করতে পেরেছিলাম? একুশ শতকেই আমরা মেট্রোরেলের অধিকারী হব, তা-ও তো ভাবনার অধিক ছিল। এ কারণেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, আমাদের মোহাচ্ছন্ন রাজনীতিও একদিন বাস্তবতার উঠোনে এসে দাঁড়াবে। নীতিনির্ধারকরা সবাইকে চমকে দিয়ে রাজনীতির পরিচয়ে নয়, নিরপেক্ষ অনুসন্ধানে যোগ্য অধ্যাপকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার পথ তৈরি করে দেবেন। এভাবে শিক্ষক রাজনীতির ধারায় পরিবর্তন আসবে। শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতির আজ্ঞাবহ না হয়ে নিজেদের মুক্তমন ও বিবেকের মানুষ মনে করবেন, হলগুলোকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনকে নষ্ট রাজনীতির ছোবলমুক্ত করে তুলবেন। এমন পরিবেশ তৈরিতে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা ছায়া হয়ে দাঁড়াবেন, শক্তি হয়ে ভরসা দেবেন। আমরা বিশ্বাস করি, অমনটি হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও গবেষণায় বৈশ্বিক অঙ্গনে উজ্জ্বলতা ছড়াতে সক্ষম হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
