Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দেশপ্রেমের চশমা

নির্বাচন সুষ্ঠু হলে সামাজিক নৈরাজ্য কমবে

Icon

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচন সুষ্ঠু হলে সামাজিক নৈরাজ্য কমবে

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকা নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে সাধারণ ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি দুদিনব্যাপী ব্যাপক সংর্ঘষে দুজন নিহত এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তি আহত হন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এক দোকানে খাবারের বিল পরিশোধ করা নিয়ে কথা কাটাকাটির জের ধরে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন না যে, রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে এমন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কেন দেরি করে অ্যাকশনে গেলেন। তারা চাইলে কি সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে গিয়ে এমন সংঘর্ষ নিষ্ক্রিয় করতে পারতেন না? আড়াই ঘণ্টাব্যাপী ইট পাটকেল, রাম দা আর লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষ চলে কী করে? অনেকসংখ্যক হেলমেট পরা যুবক লাঠিসোটা হাতে ওই সংঘর্ষে জড়ালেন কেন? এদের পরিচয় কী? আবার পরদিন আরও দীর্ঘ সময় ধরে কিভাবে এমন সংঘর্ষ চলে? কেন পুলিশ দেরি করে অ্যাকশনে গেল? মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ১৯ তারিখ বিকালে চাঁদপুরে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সকাল থেকে থাকলে হয়তো পরিস্থিতি আরেকটু ভালো হতে পারত’ (যুগান্তর, ১৯-০৪-২০২২)। প্রশ্ন হলো, কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সকাল থেকে থাকল না? মানুষ জানতে চায়, পুলিশের ওপর কেমন নির্দেশ ছিল? অনেকের মনে এমন সন্দেহ উঁকি দেয় যে, পুলিশকে দেরি করে অ্যাকশনে পাঠিয়ে কি এ সংঘর্ষ দীর্ঘায়িত করার কোনো অঘোষিত অদৃশ্য পরিকল্পনা ছিল?

দেশে এখন একটি রাজনৈতিক সংকট চলছে। সরকার প্রশ্নবিদ্ধ ও নড়বড়ে নির্বাচনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সামনে আরেকটি নির্বাচন এগিয়ে আসছে। সাধারণ মানুষের ধারণা, চলমান ব্যবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হলে চলমান সংকটের নিরসন হবে না। অন্যদিকে সরকারি দল ও এর সঙ্গে জোটবদ্ধ দলগুলো ছাড়া বাকি বিরোধী দলগুলোর প্রায় সবাই নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ দাবি আদায়ে রাজপথে নামার পরিকল্পনা করছে। এমতাবস্থায় বহুল ব্যবহৃত সনাতনী কৌশল চর্চা করে বিরোধী দলগুলোর ঐক্যে ফাটল ধরার জন্য যদি সরকার চেষ্টা করে, সেটা মোটেও আশ্চর্য হওয়ার মতো কোনো ঘটনা হবে না। এ লক্ষ্যেই বিরোধী দলগুলোর কার্যক্রম থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে এমন সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।

বাংলাদেশে রাজনীতি সুস্থ ধারায় না থাকায় সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা দেশে প্রাতিষ্ঠানিক নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার প্রচেষ্টায় নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনি দুর্নীতিতে জড়িতদের আইনের আওতায় না আনায় তৈরি হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেটবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মাননীয় মন্ত্রীরা সবসময় জিডিপি বৃদ্ধি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলে যাচ্ছেন। চারদিকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে বলে দাবি করছেন। কিন্তু তারা সামাজিক অস্থিরতা ও প্রাতিষ্ঠানিক নৈরাজ্যের কথা স্বীকার করছেন না। টিসিবির খাদ্য বিতরণকারী ট্রাকের পেছনে সাধারণ মানুষের ভিড় প্রমাণ করে যে মানুষ কতটা ভালো আছেন। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর অনেকে তাদের জমানো টাকা ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। করোনা-পরবর্তী সময়ে করোনাকালীন ক্ষতি পুষিয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের অনেকই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। অনেক ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার, দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। শহরে বসবাসকারী ছোট চাকরিজীবীদের কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও দুর্নীতি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে জনগণ সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাদের দেখার কেউ নেই। কেউ নেই সহায়তা করার। বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া চেয়ারম্যান, মেম্বার, কাউন্সিলর, মেয়র, এমপি ইত্যাদি জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সঙ্গে প্রত্যাশিত মাত্রায় দায়িত্বশীল আচরণ করছেন না। করবেনই বা কেন? তাদের অনেকেরই তো এসব পদে আসতে জনগণের সমর্থন লাগেনি। ফলে সারা দেশে দায়বদ্ধতার সংস্কৃতিতে ব্যাপক ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। ভূমি অফিস, তহসিল অফিস, থানা, কোর্ট কাচারিসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠা দুর্নীতির চক্র আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়েছে। তাদের বাধা দেওয়ার যেন কেউ নেই। কোনো বড় রকমের দুর্নীতি ধরা পড়লে তদন্ত কমিটি করে সে ঘটনা চাপা দেওয়া নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতি হওয়ায় ভূমিহীন নিঃস্ব মানুষের ঘর ধ্বসে পড়ছে। অথচ এসব দুর্নীতিকারীদের কাউকে শোকজ, বা কাউকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ নেই। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স কাগুজে সিদ্ধান্ত হয়ে আছে।

যে সমাজে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে, সেখানে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণের রায়ের ওপর নির্ভর না করে পোশাকধারী বাহিনী ও আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চাইছে বিধায় এখানে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনীতিকে নিয়মতান্ত্রিক ধারায় আনতে না পারলে সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। আর এ মুহূূর্তে রাজনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় আনতে হলে ক্ষমতার রদবদলকে একটি স্বচ্ছ নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করতে হবে।

এমন কাজ সুনিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় জনগণের রায় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারের অধিষ্ঠান প্রয়োজন। এমন সরকার দেশ পরিচালনায় থাকলে কেবল সামাজিক নৈরাজ্য দূর হবে না, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত ও টেকসই করা যাবে। মনে রাখতে হবে, একাধিক নির্বাচনে দেশের সব ভোটার স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেনি। তাদের মনে ক্ষোভ রয়েছে। কাজেই উন্নয়নের মূলা দেখিয়ে গণতন্ত্র দুর্বল করার যে কোনো প্রক্রিয়া জনগণ মেনে নিতে চাইবেন না। গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে জনগণ উন্নয়ন অর্জন করতে চান না। যদি গণতন্ত্র সঠিকভাবে চর্চা করার পরিবেশ তৈরি করা যায়, যদি গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা ভোটকে সবার কাছে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, তাহলে উন্নয়ন এমনিতেই হবে। আর অগণতান্ত্রিক পরিবেশে সামাজিক নৈরাজ্যের মধ্যে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও সে উন্নয়ন টেকসই হবে না।

চলমান ব্যবস্থায় দলীয় ব্যবস্থাধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ওই নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে না। আর এমন নির্বাচনে প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনী ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দলের জয়ী হয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে বেগ পেতে হবে না। উল্লেখ্য, গত দুটি নির্বাচন ভিন্ন ভিন্ন ফন্দিফিকির করে ক্ষমতাসীন দল জয় করায়ত্ত করেছে। আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আবারও অন্য কোনো কৌশল অবলম্বন করে সরকার ক্ষমতা আকড়ে থাকতে চাইলে জনগণের ক্ষোভ বাড়বে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, সরকার যদি ইভিএমে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে বিরোধী দলগুলোকে রাজি করাতে পারে, তাহলে কোনো রকম সন্ত্রাস সৃষ্টি ছাড়াই ডিজিটাল কারচুপি করে নীরবে নিঃশব্দে ভোটের ফলাফল নিজ পক্ষে আনা সম্ভব হবে। এ রকম ইচ্ছা না থাকলে জনগণ, সুশীল সমাজ, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে ভোট না চাইলেও ক্ষমতাসীন এবং সরকারে সম্পৃক্ত দলগুলো ও নির্বাচন কমিশন ইভিএমে ভোট করতে এতো আগ্রহী কেন? ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী ইভিএমে কাগজের ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও কাগজের ব্যালটে ভোট চেয়েছেন। আমেরিকার ২৪টি অঙ্গরাজ্য ইভিএমে ভোট করা বাতিল করেছে। জার্মানি ইভিএম পরিত্যাগ করেছে। সেখানে বাংলাদেশে কাগজের ব্যবহারবিহীন, ভোট পুনঃগণনার ব্যবস্থা নেই এমন প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত ইভিএমে ক্ষমতাসীন দল ভোট করার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে। প্রযুক্তিসচেতন ভোটারের অনেক দেশ যখন ইভিএম পরিত্যাগ করছে, তখন বাংলাদেশের অধিকাংশ ভোটার প্রযুক্তি অসচেতন জেনেও যদি সরকার বা নির্বাচন কমিশন ইভিএমে ভোট করতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে কোনো দুরভিসন্ধি আছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে আগামী বছরের শেষ দিকে। সরকার এবং ইসি যদি এখনই এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে সামাজিক অস্থিরতা কমে আসবে। ইসির পক্ষে সরকারের সহায়তা নিয়ে তখন নির্বাচনপূর্ব কাজগুলো স্বচ্ছতার সঙ্গে করে জনমনে ভোটদানের পক্ষে আস্থা তৈরি করা সম্ভব হবে। নতুন নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে অতি দ্রুত ইভিএম সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্ত জাতিকে জানিয়ে দেওয়া। সবচেয়ে ভালো হয়, যত দ্রুত সম্ভব বলে দেওয়া যে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। তাহলে সাধারণ ভোটারদের মনে কিছুটা স্বস্তি আসবে। আর যদি একগুয়েমি করে জনমত উপেক্ষা করে সরকার ইভিএমে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে সামাজিক অস্থিরতা কমবে না। ইসিকেও জনগণ সন্দেহের চোখে দেখবেন। তবে ইসি যদি বলে, আমরা ইভিএমকে হ্যাকপ্রুফ করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব, এ মেশিনে কাগজের ব্যবহার করব, ভোট এদিক-সেদিক হয়ে গেলে পুনঃগণনার ব্যবস্থা থাকবে, এ লক্ষে আমরা প্রযুক্তিবিশারদদের দিয়ে কাজ করাব, সেক্ষেত্রেও ইভিএমকে বিশ্বাস করার কারণ নেই। কারণ, আজকাল তরুণ প্রজন্ম অনেক কিছুই হ্যাক করতে পারেন। আর আমাদের ভোটাররা, প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসাররা প্রযুক্তিজ্ঞানসমৃদ্ধ নন, সেজন্য ইভিএমে জারিজুরি করার সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না। এখানে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সরকার এবং ইসি যদি ইভিএমে নির্বাচন করতে একেবারেই মরিয়া হয়, তাহলে দেশপ্রেমিক এবং গণতন্ত্রপ্রেমিক জনগণের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে একটি গণভোটের আয়োজন করতে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। ওই গণভোটে যদি অধিকাংশ ভোটার ইভিএমে ভোট করার পক্ষে রায় দেন, তাহলে তারা এ ব্যাপারে অগ্রসর হতে পারেন। তবে এমন গণভোট করলে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই ওই গণভোট ইভিএমে নয়, কাগজের ব্যালটে সম্পন্ন করতে হবে। তবে এসব ব্যবস্থা গ্রহণে দেরি করা যাবে না। যে কোনো উপায়ে আগামী নির্বাচন ইনক্লুসিভ করতে পারলে সামাজিক নৈরাজ্য হ্রাস পাবে। আর সামাজিক পরিবেশ শান্তিময় হলে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের দিকে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে।

 

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম