দেশপ্রেমের চশমা
দেরি হবে যত, ক্ষতি হবে তত
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ০৯ মে ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকটটি নির্বাচনকেন্দ্রিক। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারাধীনে সম্পন্ন করে এ সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচনের পর মধ্য ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে দলীয় ব্যবস্থাধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। কারণ, এ ব্যবস্থাধীনে নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশাল ক্ষমতাধিকারী হয়ে ক্ষমতাসীন থাকবেন। মন্ত্রী এবং এমপিরা অনেক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ক্ষমতায় থাকবেন। জাতীয় সংসদ ভাঙা হবে না। নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে সরকারের মনপছন্দ লোকজন দিয়ে। আর নির্বাচন করার জন্য প্রশাসনের যেসব সদস্যকে ব্যবহার করা হবে তারা হবেন দলীয়করণকৃত। তারা সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনের কাজ করবেন, যে সরকারের হাতে তাদের পদোন্নতি, বদলি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ছিল। ফলে তারা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন তা অনুমেয়। এমনই ব্যবস্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীর যোগসাজশে অনেক ক্ষেত্রে রাতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়ে যায়। ফলে দশম সংসদ নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনটিও কালিমালিপ্ত হয়ে পড়ে। দেশে এবং বিদেশে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অনেকে ভেবেছিলেন সরকার হয়তো পরবর্তী সময়ে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেবে। কিন্তু তা না করে ওই নড়বড়ে নির্বাচনের ওপর ভর করে সরকার মেয়াদ শেষ করতে চলেছে। আগামী বছর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে একইভাবে অনুষ্ঠিত হলে ওই নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা অনুমান করা যায়।
বিরোধী দলগুলো বুঝতে পেরেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনটি বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন পেলেও লাভ হবে না। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যদের অঘোষিত ডিকটেশন অনুযায়ী কাজ করিয়ে সরকারি দলের পক্ষে নির্বাচন জেতা কষ্টকর হবে না। আর নির্বাচন ইভিএমে করা হলে তো সোনায় সোহাগা। সরকার নীরবে-নিঃশব্দে সব আসনেই ডিজিটাল ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে জিততে পারবে। কারণ, এ মেশিন যে হ্যাকপ্রুফ, তা প্রযুক্তিবিশারদদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে সুনিশ্চিত হওয়া যায়নি। ইভিএমে কাগজের ব্যবহার নেই। ভোট পুনঃগণনার ব্যবস্থা নেই। প্রযুক্তি অসচেতন ভোটাররা এ মেশিনে ভোট দিতে আগ্রহী না হলেও সরকার এবং সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দলগুলোই কেবল ইভিএমে ভোট চাইছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল ও অন্য সব দল ইভিএমে ভোট চান না। নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল পরিস্থিতি অনুধাবন করে শপথ নেওয়ার পর বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজ সহজ হবে।
এমন সমঝোতা করতে গেলে সরকারকে বিরোধী দলগুলোর নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে হবে। এ দাবি মানতে হলে সংবিধান সংশোধন করে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব। কারণ, জাতীয় সংসদ কার্যকর আছে। আর সরকারি দলের সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও আছে। কাজেই বল সরকারের কোর্টে। সরকার চাইলে আগে থেকেই যদি একটি নির্বাচনকালীন সরকারের বিল পাশ করে এমন দাবি মেনে নেয়, তাহলে স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সহজ হবে। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পোশাকধারী বাহিনীও তখন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে। সামাজিক অস্থিরতা কমে যাবে। রাজনৈতিক আন্দোলনের দরকার হবে না। সমাজ ও রাজনীতি স্বাভাবিকতা ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আর সরকার যদি একগুঁয়েমি করে এমন প্রস্তাবে রাজি না হয়ে নিজেরা ক্ষমতায় থেকে, জাতীয় সংসদ না ভেঙে, মনপছন্দ নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনী দিয়ে আবারও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে, তাহলে এর ফল কী হবে তা বোঝা যায়। বিরোধী দলগুলো এমন নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হবে বলে মনে হয় না। কারণ, তারা জানে, এমন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা আর নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য নেই।
এ অবস্থায় আগামী দিনগুলোর সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমবে কি না, তা নির্ভর করছে সরকারের স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সদিচ্ছার ওপর। এমন সদিচ্ছা প্রদর্শিত না হলে বিরোধী দলগুলোর জন্য রাজপথের আন্দোলন করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। আর রাজপথের আন্দোলন মানেই হলো আবার ধরপাকড়, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান এবং নাশকতা সৃষ্টির কারণে মামলা ও গ্রেফতার। সরকারের মন্ত্রীদের এ প্রাসঙ্গিক বক্তব্য-বিবৃতি শুনলে মনে হয় না সহজে তারা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চাইবেন। কতিপয় মন্ত্রী বলে দিয়েছেন, তারা সংবিধানের বাইরে যাবেন না। আর তা হলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অতিসম্প্রতি ৬ মে সরকারদলীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম আহসান উল্লাহ মাস্টারের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত সভায় এ প্রসঙ্গে কথা বলেন। বিএনপির রাজপথের গণ-আন্দোলনের প্রস্তুতির জবাবে তিনি বলেন, ‘গণ-আন্দোলনের কথা না বলে নির্বাচনি প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আমরা একটি বিরোধী দল চাই।’ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব পালন করবেন জানিয়ে কামরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বিএনপি অহেতুক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। বিএনপির কর্মকাণ্ড মানুষ ভুলেনি’ (মানবজমিন, ০৬-০৫-২০২২)।
অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যদি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হন, আর মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা ক্ষমতায় থেকে যদি একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো নির্বাচন করা হয়, তাহলে সে নির্বাচনে কোন দল জিতবে তা অনুমান করা যায়। এহেন ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে সরকারের শরিক দলগুলো ছাড়া আর কোনো দল ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, তা বোঝা যায়। সেক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো এমন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিশ্চিত পরাজয়বরণ করার চেয়ে রাজপথে আন্দোলন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য এসব দল সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করেছে এবং রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর এমন আন্দোলন শুরু হলে দেশ দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কবলে পড়বে। তবে সরকার চাইলে এ পরিস্থিতি থেকে দেশকে স্বাভাবিকতার পথে আনতে পারে। কারণ, বল এখন সরকারের কোর্টে। জাতীয় সংসদ কার্যকর আছে। আর সরকারের সে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সরকার যদি একটি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিল জাতীয় সংসদে পাশ করে সেই সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়, তাহলে দ্রুতই সামাজিক অস্থিরতা স্তিমিত হতে পারে। তখন প্রতিটি দল নির্বাচনি প্রস্তুতি গ্রহণের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
সরকারি মনোভাব পড়তে পেরে বিএনপি রমজানে তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কমিটি গঠনের কাজ করেছে। তারা তৃণমূলকে দলীয় কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অবহিত করেছে। সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থীরা এলাকায় গিয়ে ইফতার মাহফিলে অংশগ্রহণ করে নেতাকর্মীদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অবহিত করে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। দলীয় সরকারের অধীনে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তাকে ‘জাতীয় বেইমান’ হিসাবে গণ্য করার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত তৃণমূলে জানিয়ে দিয়েছেন। আরও জানিয়েছেন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দল জয়ী হলে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের কথা। এমন সিদ্ধান্তে বিএনপির সঙ্গে বাম এবং অন্য দলগুলোর আন্দোলনের ব্যাপারে ঐকমত্যের জায়গাটি শক্তিশালী করতে পারে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন। আওয়ামী লীগও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভা করেছে। বছরের শেষদিকে জাতীয় সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। উভয় বড় দলের মধ্যে নির্বাচন কেমন সরকারের অধীনে হবে, সে বিষয়ে কোনো ঐকমত্যের সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। পরিবর্তে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে বলে মন্ত্রীরা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাচ্ছে না, তা একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। একগুঁয়েমি পরিহার করে সরকার যত দ্রুত একটি নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি মেনে নেবে, সমাজে তত দ্রুত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে। খালেদা জিয়ার মতো দীর্ঘদিন পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন দেওয়ার বিরোধীদলীয় দাবি না মেনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও কি একই রকম ভুল করবেন? খালেদা জিয়া পরবর্তীকালে সম্মিলিত বিরোধীদলীয় লাগাতার আন্দোলনের চাপে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন করে স্বল্পায়ুর সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নেন। আগামী দিনে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল একাট্টা হয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে সরকারের জন্য ভালো হবে এসব দলকে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের সুযোগ না দিয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নির্বাচনকালীন সরকার বিল পাশ করে নিজ দলীয় জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে সংসদ নির্বাচন দেওয়া। এ দাবি মানতে সরকার যত দেরি করবে, দেশ ও সমাজের তত ক্ষতি হবে। কারণ, যৌক্তিকতার বিচারে এ ব্যাপারে বিরোধী দলগুলো এগিয়ে রয়েছে। উন্নয়নের নামে স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবি ধামাচাপা দেওয়ার সরকারি চেষ্টা গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণের সমর্থন পাবে বলে মনে হয় না। কারণ, বিরোধী দলগুলো তাদের অধীনে নির্বাচন চাইছে না। পরিবর্তে, এ দলগুলো একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে। এমন দাবি আওয়ামী লীগও মধ্য নব্বইয়ের দশকে আদায় করেছিল। আওয়ামী লীগ যদি এখন বিরোধী দলে থাকত, তাহলে কি দলটি বিএনপি সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হতো? কাজেই বিরোধী দলগুলো থেকে উত্থাপিত নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি গণতন্ত্রপ্রিয় দেশপ্রেমিক জনগণের অনেকের কাছেই যৌক্তিকতার বিচারে অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এমন দাবি নিষ্ক্রিয় করার উদ্যোগ সমাজ ও রাজনীতিতে কেবল অশান্তি, অস্থিতিশীলতা আর অস্থিরতাই বাড়াবে। কাজেই লেবু বেশি না চটকিয়ে এ ব্যাপারে সরকারের যা করার, তা দ্রুত করাই মঙ্গলজনক হবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
