দেশপ্রেমের চশমা
ব্যালটে নির্বাচন সময়ের দাবি
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশে ডজনাধিক নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বিগত ৫১ বছরে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন সময়ে অনেক সংলাপ ও মতবিনিময় সভা হয়েছে। এসব সভায় স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে দলগুলো ইসিকে বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিয়েছে। তবে কখনো কোনো দল মেশিনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি উত্থাপন করেনি। বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আনেন দশম নির্বাচন কমিশনের সিইসি ড. এটিএম শামসুল হুদা। তবে ড. হুদা নিজ থেকে এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে বিশ্বাসযোগ্য নয়; কারণ, নির্বাচনে প্রযুক্তি ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকলে হুদা কমিশন ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্বে এসেই এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিতেন; বলতেন, নির্বাচনব্যবস্থায় তাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে প্রথম ২ বছর কমিশন এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। পরে ২০০৯ সালে কমিশন দু-একবার প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন বলে জানা যায় (সংবাদ, ২ আগস্ট ২০১১)। তবে ২০১০ সালের নভেম্বরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সবুজ সংকেত পেয়ে ইভিএমে ভোট করার ব্যাপারে কমিশন অগ্রসর হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ইসির বৈঠকে কমিশন সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত ধারাবাহিক সংলাপে কমিশন দলগুলোর কাছ থেকে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে মতামত গ্রহণ করে। উল্লেখ্য, ওই সংলাপে সরকারে শরিক কতিপয় দল ছাড়া অন্য সব দল ইভিএমে সংসদ নির্বাচন না করার পক্ষে মত দেয়।
ইভিএম ব্যবহার করলে যেসব লাভ হবে বলে ওই সময় জনগণকে বলা হয়, পরবর্তী সময়ে তার প্রায় সবকিছুই অসত্য প্রমাণিত হয়। বলা হয়েছিল, ইভিএমে ভোট করলে ভোট নষ্ট হবে না। দ্রুত ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করা যাবে ও ভোটের ফলাফল দ্রুত দেওয়া যাবে এবং এতে অর্থের সাশ্রয় হবে। এছাড়া জাল ভোট দেওয়া সম্ভব হবে না ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে এসব প্রতিশ্রুতি সত্য হয়নি। ইভিএম ব্যবহার করায় আরও নানা রকম অসুবিধা হয়েছে। ২০১০ সালের মাঝামাঝিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সর্বপ্রথম ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে শহরের প্রাণকেন্দ্রে শিক্ষিত ভোটার অধ্যুষিত জামালখান ওয়ার্ডে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। সেখানে অভিনব প্রক্রিয়ায় কারচুপির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল (দেখুন, নির্বাচন কমিশনের আমলনামা, ঢাকা, অসডার পাবলিকেশন্স, ২০১২, পৃষ্ঠা-৬৯)।
দশম সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ প্রসঙ্গে কমিশন অংশীজনদের নেতিবাচক মনোভাব জেনে কিছুটা ব্যাকফুটে যায়। তবে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ প্রার্থী ও ভোটারদের অনুরোধ উপেক্ষা করে ওই বছর কমিশন নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে। নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার (যিনি দলীয় নির্দেশে পরে নির্বাচন বর্জন করেন) ইভিএমবিরোধী বক্তব্য দিলে ইসি তাকে শোকজ করায় তিনি হেয়ারিং দাবি করেন। তার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ২১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার একটি কমিউনিটি সেন্টারে কমিশন শুনানির আয়োজন করে। ওই শুনানিতে অ্যাডভোকেট তৈমুর তার ইভিএম বিরোধিতার কারণ উপস্থাপন করেন এবং তার পক্ষে আইটি বিশেষজ্ঞ শামা ওবায়েদ ইভিএমের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে একটি প্রেজেন্টেশন দেন। শামা দাবি করেন, বুয়েটে তৈরি ইভিএম হ্যাক করা সম্ভব। তাকে একটি মেশিন সাত দিনের জন্য দিলে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন, এটি হ্যাকেবল (আমার দেশ, ২২ অক্টোবর, ২০১১)। সাংবাদিকরা কনভিন্সড হয়ে উপস্থিত বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইআইসিটি)-এর পরিচালক প্রফেসর ড. এসএম লুৎফুল কবীরকে বলেন, ‘স্যার এবার কী বলবেন? আপনি তো আগে বলেছিলেন, আপনাদের তৈরি ইভিএম হ্যাক করা যাবে না।’ জবাবে প্রফেসর কবীর বলেন, ‘দেখুন, আমাদের ইভিএম হ্যাক করা গেলে তা ধরা সম্ভব।’ এসব দেখে-শুনে অনেক দরিদ্র ভোটার বুঝে বা না বুঝে ইভিএমকে ‘ভোট চুরির মেশিন’ বলে আখ্যায়িত করেন। নাসিক নির্বাচনের পর বিএনপি প্রার্থী নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে ইভিএমকে ‘জাদুর বাক্স’ উল্লেখ করে এ মেশিনে কারচুপি করা সম্ভব বলে উল্লেখ করেন। এ নির্বাচনে সদরের ৯টি, সিদ্ধিরগঞ্জের ৩টি এবং বন্দর থানার ৬টি ভোটকেন্দ্রে ইভিএমের ত্রুটিজনিত কারণে ৫৯৩টি ভোট নষ্ট হয় (মানবজমিন, ২ অক্টোবর ২০১১)।
এ প্রশ্নবিদ্ধ ইভিএম নিয়ে দেশে দেশে রয়েছে অনেক বিতর্ক। অনেক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশও ইভিএম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মতো প্রযুক্তি-অসচেতন ভোটারের দেশে ক্ষমতাসীন দলের ইভিএমে ভোট করার বর্ধিত আগ্রহ নাগরিকদের মনে সন্দেহ জন্ম দিয়েছে। আমেরিকার মতো উন্নত দেশের ২৪টি অঙ্গরাজ্য ইভিএম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভারতের ইভিএমে কাগজের ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও সেখানে এ যন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ইভিএমের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে কাগজের ব্যালটে ভোট দাবি করেছেন। বাংলাদেশের গরিব, স্বল্পশিক্ষিত ভোটাররা প্রযুক্তি অসচেতন। তবুও তাদের সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট দিতে বলা হচ্ছে। ইসি ইভিএমে সংসদ নির্বাচন করতে চাইলে কমিশনকে আমরা একটি গণভোটের মাধ্যমে ভোটারদের মতামত নিতে বলব। তবে ওই গণভোটটি ইভিএমে করলে হবে না। গণভোটটি অবশ্যই কাগজের ব্যালটে করতে হবে। গণভোটে ইভিএমের পক্ষে রায় পেলে কমিশন এ ব্যাপারে অগ্রসর হতে পারে। তখন এ যন্ত্রে কাগজের ব্যবহারসহ অন্যান্য দিক উন্নয়ন করে এটি হ্যাকপ্রুফ কিনা, তা প্রযুক্তিবিশারদদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে ভোট করা ভালো হবে। এসব না করে ইভিএমে ভোট করলে নাগরিক সমাজ ভাববে, কমিশন কোনো বিশেষ দলের অঘোষিত ডিকটেশন অনুযায়ী কাজ করছে।
ইতোমধ্যে এ মাসের ৮ তারিখে সরকারদলীয় কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করার ইঙ্গিত দেন।
তার বক্তব্যের সুরে তাল মিলিয়ে সরকারদলীয় সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘নির্বাচন ইভিএমে হবে, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকলে ভোট নিরপেক্ষ হবে, মির্জা ফখরুলের দুশ্চিন্তার কারণ নেই’ (মানবজমিন, ৯ মে ২০২২)। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সাধারণ সম্পাদকের এহেন বক্তব্যে নাগরিক সমাজের ইভিএমের প্রতি যে সন্দেহ ছিল, তা আরও গভীর হয়েছে। কারণ, ভোট ইভিএমে হবে, নাকি ব্যালটে হবে; সে সিদ্ধান্ত দেবে নির্বাচন কমিশন। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদকের এমন সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার আছে কি? ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক এমন কথা বললে পরোক্ষভাবে নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করা হয়।
ইতঃপূর্বের অভিজ্ঞতা বলে, যেসব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে, ওই কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের লম্বা লাইন দেখা গেছে। কারণ, ভোটারদের অনেকে মেশিনে ভোট দিতে অভ্যস্ত নন। বিশেষ করে বয়স্ক ও নারী ভোটাররা ভোট দিতে অনেক সময় নেন। ভোট দিতে গিয়ে অনেকের আঙুলের ছাপ মেলে না। তা ছাড়া ব্যালটে ভোট দিয়ে অল্পশিক্ষিত ভোটাররা মানসিক শান্তি পান। নিজ হাতে কাগজের ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে প্লাস্টিকের স্বচ্ছ বাক্সে ব্যালট পেপার চোখে দেখে ভোটাররা মানসিক প্রশান্তি পান। ইভিএমে বোতাম টিপে চোখে না দেখে ভোট দিয়ে তারা ওই পরিতৃপ্তি পান না। এরপর ফলাফল ঘোষণার পর সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হলে অনেক ভোটার ভাবেন, তার প্রদত্ত ভোটটি হয়তো অন্য মার্কায় চলে গেছে। ইভিএমে ভোট আয়োজন করে ভোটারদের এ মানসিক যন্ত্রণা দেওয়ার অধিকার নির্বাচন কমিশনের নেই। ইভিএমের আরেকটি বড় ত্রুটি হলো, এ মেশিনে ভোট পুনঃগণনার ব্যবস্থা নেই। রকিব কমিশনের সময় রাজশাহীর টিটি কলেজ কেন্দ্রে একটি ইভিএম মেশিন থেকে ৩১০টি ভোট মুছে যায়। ওই ভোটগুলো অনেক চেষ্টা করেও আর উদ্ধার করা যায়নি। তখন কমিশন থেকে বলা হয়, কেন এ ৩১০টি ভোট মুছে গেল, তার কারণ বের করতে না পারলে অন্য নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। এর এক মাস পর গাজীপুরের নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কমিশন ইভিএম ব্যবহার করেনি। কিন্তু তারপর আবার ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। ওই ৩১০টি ভোট কেন মুছে গিয়েছিল, তার কারণ কমিশন থেকে আজও জনগণকে জানানো হয়নি।
নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীও নির্বাচনের দিন ইভিএমের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন, ‘ভোটাররা ইভিএমে আমাকে ভোট দিলেও সে ভোট চলে যাচ্ছে অন্য প্রার্থীর ঘরে’ (আমার দেশ, ৩১ অক্টোবর ২০১১)। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে গিয়ে নানা রকম ত্রুটি ধরা পড়ে। এসব ত্রুটির মধ্যে রয়েছে- ১. স্বল্পশিক্ষিত এবং বয়স্ক ভোটারদের এ পদ্ধতিতে ভোটদানে অস্বস্তি প্রকাশ; ২. সহকারী প্রিসাইডিং অফিসাররা বারবার শিখিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও ভোটারদের ভোটদানে ভুল করা; ৩. স্বল্পশিক্ষিত ও অনভ্যস্তদের ভোটদানে দীর্ঘ সময় নেওয়া; ৪. কতিপয় কেন্দ্রে ইভিএমের কিছুসংখ্যক বাটন অকার্যকর হয়ে যাওয়া; ৫. কিছুক্ষণ কাজ করার পর কতিপয় ইভিএম বিকল হয়ে যাওয়া; ৬. ইভিএম পদ্ধতিতেও ভোটগ্রহণে জাল ভোট পড়া; ৭. কতিপয় ইভিএমে কাস্টিং ভোট ডামি ভোট হয়ে যাওয়া; ৮. যান্ত্রিক ত্রুটিসহ বিভিন্ন কারণে ভোট নষ্ট হওয়া; ৯. ইভিএম থেকে অজ্ঞাত কারণে ভোট মুছে যাওয়া; ১০. ইসি বা প্রিসাইডিং অফিসার কর্তৃক মনোনীত নন, এমন যুবকদের ইভিএম মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এবং স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভোটারদের ভোটদানে সহায়তা করা ইত্যাদি।
গত কয়েকটি সংসদ নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ অবস্থায় আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ত্রুটিমুক্ত করতে না পারলে ভূলুণ্ঠিত গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি উদ্ধার করা যাবে না। সেজন্য স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে প্রযুক্তি-অসচেতন ও স্বল্পশিক্ষিত ভোটারের দেশে ইভিএম দিয়ে সংসদ নির্বাচন করা ভালো হবে না। তার চেয়ে পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ দেশের মতো কাগজের ব্যালটের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে। এমন সংকটময় মুহূর্তে ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন করা নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে না। কাগজের ব্যালটে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্তভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে বাংলাদেশে ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি উদ্ধারের সুযোগ এসেছে কমিশনের সামনে। এখন কমিশনের উচিত হবে, সততার সঙ্গে এ সুযোগ কাজে লাগানো।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
