Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দেশপ্রেমের চশমা

নির্বাচনের আগে দুটি বিষয়ের ফয়সালা হওয়া দরকার

Icon

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচনের আগে দুটি বিষয়ের ফয়সালা হওয়া দরকার

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। বেড়েছে গণহয়রানি এবং অফিস-আদালতে অনিয়ম-দুর্নীতি। আর্থসামাজিক ও প্রশাসনিক নৈরাজ্য দূর করতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিকতা ও সুস্থতা নিশ্চিত করা দরকার।

রাজনীতি ঠিক না হলে কেবল বিচার করে আর শাস্তি দিয়ে এ নৈরাজ্য দূর করা যাবে না। বিচার কার্যক্রমেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা আর বিশৃঙ্খলা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনি, নারায়ণগঞ্জের স্কুলছাত্র ত্বকী হত্যাকাণ্ডের আজও বিচার হয়নি। বিচার হয়নি আরও অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড এবং অপরাধের।

রাজনৈতিক ও আর্থিক দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান নয়। মানি লন্ডারিং এবং আর্থিক খাতের দুর্নীতির কি কোনো বিচার হয়েছে? হয়েছে কি কোনো বড় অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি? রাজনীতির সুস্থতা এবং ক্ষমতার রদবদলের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি আর ছলচাতুরী হলে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সমাজে দেখা দেয় নৈরাজ্য।

সাম্প্রতিক রাজনীতিসংক্রান্ত আলোচনায় নির্বাচনের প্রসঙ্গ অগ্রাধিকার পায়। কারণ, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অত্যাসন্ন। রাজনীতি ঠিক করতে হলে গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে পঞ্চম, সপ্তম এবং অষ্টম সংসদ নির্বাচনগুলো ছাড়া বাকি নির্বাচনগুলো কমবেশি দুর্নীতিযুক্ত ছিল।

বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া যুগপৎ স্থানীয় সরকার এবং উপনির্বাচনগুলোও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। শেষ দুটি নির্বাচনের একটিতে (১০ম) নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে ঠিক হয়ে যায় কোন দল সরকার গঠন করবে। আর অন্যটিতে নির্বাচনের দিনের আগের রাতে প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীর সহায়তায় বিভিন্ন কেন্দ্রে কমবেশি ভোট হয়ে যায়।

উল্লিখিত দুটি নির্বাচন দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করেছে। এসব নির্বাচনে যারা দুর্নীতি করেছে তাদের শাস্তি হয়নি। ফলে দুর্নীতিকারীরা সরকারি প্রশ্রয় পেয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে অধিকতর দুর্নীতি করতে মুখিয়ে আছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এসব দুর্নীতিকারী আবারও নির্বাচনে দুর্নীতি চর্চার সুযোগ পাবে। এ কারণে বিরোধী দলগুলো থেকে নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের জোরালো দাবি উঠেছে।

বিএনপিসহ কতিপয় রাজনৈতিক দল দলীয় সরকারাধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। আমলানির্ভর ইসির ওপর এ দলগুলোর আগ্রহ বা আস্থা নেই। এ কারণে দলগুলো কমিশন আহূত সংলাপে যোগ দেয়নি। ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যেভাবে অনড় ছিল, ২০২২-এ বিএনপি ও সমমনা দলগুলো একইভাবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে অটল রয়েছে।

বিরোধী দলগুলো বুঝতে পেরেছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অর্থ হলো সরকারি ফাঁদে পা দিয়ে নির্বাচনি পরাজয়বরণ করে নেওয়া।

বর্তমান সরকার পর্যায়ক্রমে তিনবার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এ সময়কালে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতিকারীরা সরকারি প্রশ্রয়ও পাচ্ছে। বড় বড় দুর্নীতিবাজের শাস্তি হচ্ছে না। মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানকারী বিদেশি নাগরিকদের সম্মাননা প্রদান প্রক্রিয়ায় ক্রেস্টের সোনা আত্মসাৎকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। মুজিবনগর সরকারের চাকরিজীবী হিসাবে বিভিন্ন পদে চাকরি নেওয়া ব্যক্তিদের দুর্নীতি ধরা পড়ার পর তাদেরও শাস্তি হয়নি।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে গরিব ভূমিহীনদের ঘর বানিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও দুর্নীতি হওয়ায় কোথাও কোথাও নির্মিত ঘর এক-দুই মাসেই ভেঙে পড়েছে। এ দুর্নীতিও তদন্ত কমিটি করে ধামাচাপা দিয়ে দুর্নীতিকারীদের শাস্তির পরিবর্তে বদলি করা হয়েছে। প্রতিবার বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। যারা মানি লন্ডারিং করে দেশের টাকা বাইরে নিয়ে গেছেন, তারা সে টাকা দেশে নিয়ে এলে তাদের কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না।

এসব সরকারি সিদ্ধান্তে প্রমাণিত হয়, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছে, তা লোকদেখানো। দুর্নীতির প্রতি সরকারের এমন মনোভাবে দুর্নীতিকারীরা পরোক্ষ উৎসাহ পাচ্ছে।

সরকার আবারও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতা’ বজায় রাখতে চাইছে। এ কারণে বিরোধী দলের নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি উপেক্ষা করে সরকারদলীয় মন্ত্রী ও নেতারা সংবিধানের ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন।

যে ভুল খালেদা জিয়া ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিকে উপেক্ষা করে করেছিলেন, সে একই ভুল শেখ হাসিনা এখন করছেন। সরকারদলীয় নেতারা সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইছেন। কারণ, তারা জানেন, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে গেলে প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীর সহায়তায় বিজয় নিশ্চিত করা যাবে।

এ কারণে সরকারের মন্ত্রীরা সংবিধানকে প্রাধান্য দিয়ে বিরোধী দলগুলোকে দলীয় সরকারাধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু বিরোধী দলগুলো এ আহ্বান নাকচ করে দিয়েছে। কারণ, তারাও এ দেশের আলো-বাতাসে বড় হয়েছেন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলে তার ফল কী হবে তারা তা ভালো করেই জানেন।

নির্বাচন নিয়ে এবার যে চাতুরীর পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা হলো মেশিনে তথা ইভিএম-এ নির্বাচন। এমন নির্বাচন করতে পারলে সন্ত্রাস-সহিংসতা ছাড়াই নিঃশব্দে ডিজিটাল কারচুপি করে সরকারি দলের পক্ষে নির্বাচন জেতা সম্ভব হবে। বিএনপি গোড়া থেকেই ইভিএমবিরোধী।

একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বলেন, ‘আমি মনে করতাম এটি (ইভিএম) চুরির বাক্স, কিন্তু নির্বাচনের পরে দেখেছি এটি ডাকাতির বাক্স। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ইভিএমে নির্বাচনে যায়, তাহলে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

একই বছর নভেম্বরে আ স ম আবদুর রব ‘ইভিএমকে না বলুন, আপনার ভোটকে সুরক্ষিত করুন’ শীর্ষক সেমিনারে বলেন, ইভিএমে ভোট করলে সংবিধান লঙ্ঘন করা হবে, রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের ২(এ) ধারা উল্লেখ করে আ স ম রব বলেন, ‘সেখানে বলা আছে সংসদ গঠন হবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে। মেশিনে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সংবিধানে বলা আছে ডাইরেক্ট। প্রশ্নবিদ্ধ ইভিএম এ শর্ত পূরণ করে না। তাই সংবিধান সংশোধন করা ছাড়া ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না’ (যুগান্তর, ২২-১১-২০১৮)।

অথচ একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি সংসদীয় আসনে ইভিএমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হলে বিএনপি ইভিএমবিরোধী হয়েও ওই নির্বাচনগুলোয়ও অংশগ্রহণ করে। বিএনপির কিছুতেই ওই ছয়টি সংসদীয় আসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত হয়নি।

আশা করা যায়, এবার সরকারি দল এবং সরকারি দলের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে নামসর্বস্ব দু-একটি দল ছাড়া আর কোনো দল ইভিএমে ভোট হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হবে না। ইতোমধ্যে ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথমবার কেবল ইভিএম প্রসঙ্গ নিয়ে সংলাপ করেছে। প্রতিদিন ১৩টি দলকে আমন্ত্রণ করে তিন দিনে এ সংলাপ করা হয়। প্রথম সংলাপে উপস্থিত ১০টি দলের মধ্যে ৯টি দল ইভিএমে নির্বাচন করার বিরোধিতা করে। সরকারে শরিক জাতীয় পার্টিও ইভিএমে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘সাধারণ মানুষের ধারণা হলো ইভিএম মানে এর মধ্যে অন্য কোনো কারসাজি আছে। ইভিএম মানে বিশেষ দল কিছু করতে পারে। ইভিএমের দোষের চেয়ে বড় হলো দেশের ভোটাররা ইভিএমে ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়’ (যুগান্তর, ১৯-০৬-২০২২)।

একই দিনের আলোচনায় বাংলাদেশ মুসলিম লীগ নেতা আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণ মানুষ মনে করেন, ইভিএম ডিজিটাল কারচুপির একটি নির্ভরযোগ্য যন্ত্র।’ মোটা দাগে তিন দিনের আলোচনায় অধিকাংশ দলই ইভিএমে নির্বাচনের বিরোধিতা করে। উল্লেখ্য, বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল এ সংলাপ বর্জন করে। এ দলগুলো ইভিএমের পরিবর্তে প্রথমে নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের নিশ্চয়তা চায়। কারণ, এ দলগুলো জানে, নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারলে ওই সরকার জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে ইভিএমে নির্বাচন করবে না।

ইদানীং সরকারি দল ও ইসি ইভিএমের পক্ষে একই সুরে কথা বলছে। আওয়ামী লীগ আগেই সব আসনে ইভিএমে নির্বাচনের কথা বলেছে। আবার ইসির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপেও দলটি ৩০০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন দাবি করেছে। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ইভিএমে নির্বাচন চাইতে পারে; কিন্তু নির্বাচন কমিশন তো স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান।

ইসির ইভিএমের প্রতি এত আগ্রহের রহস্য কী? ইসি তো রেফারি। কোন বলে খেলা হবে তা নিয়ে তার এত মাথাব্যথা কেন? এ দায়িত্ব খেলোয়াড়দের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। ইসি পারলে ব্যালটে গণভোট করে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে ভোটারদের রায় নিয়ে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করুক।

এসব বিষয়ের ফয়সালা করতে যত দেরি হবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক নৈরাজ্য ততই বাড়বে। আজ শিক্ষক হত্যা করা হচ্ছে, কাল তার গলায় জুতার মালা পরানো হচ্ছে। খুনসহ বিভিন্ন রকম নৈরাজ্য এবং সামাজিক হয়রানি বাড়ছে। গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বচ্ছতা সৃষ্টি করা দরকার, সেসব প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছে নৈরাজ্য। ফলে জাতি এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে এ নৈরাজ্য কমতে পারে। এজন্য প্রয়োজন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে এবং ব্যালটে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এমন নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়ে সরকারের সামনে নিজ দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করার সুযোগ এসেছে। দেখার বিষয়, সরকার এ সুযোগ কীভাবে কাজে লাগায়।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

নির্বাচন দুটি বিষয় ফয়সালা দরকার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম