রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আঞ্চলিক দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন
প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আঞ্চলিক দেশগুলো গত পাঁচ বছর ধরে দৃশ্যমান ও ফলপ্রসূ কোনো ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়নি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গা মাদক পাচার, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, হত্যা, মানব পাচার ইত্যাদি নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। এর ফলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অভিযান চালিয়ে ২০ লক্ষাধিক ইয়াবা, দেশি-বিদেশি অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ, দেশি-বিদেশি অর্থ এবং বিপুল পরিমাণ আমদানি ও বিক্রয়নিষিদ্ধ পণ্য জব্দসহ ৯৭২ জন দুষ্কৃতকারীকে আটক করে।
রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘ সময় চলমান থাকলে বাস্তুচ্যুত এ জনগোষ্ঠীর কট্টরপন্থা, চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়বে; এর ফলে বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন জরুরি হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের চাপ সামলাতে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বনজসম্পদ এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি মিলিয়ে মোট ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার মতো।
প্রত্যাবাসন বিলম্ব হলে পরিবেশগত এ ঝুঁকি বাড়তেই থাকবে। দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশকে এ ধরনের সংকটের মুখোমুখি পড়তে হতো না।
২৭তম আন্তর্জাতিক নিক্কেই সম্মেলনের বার্তায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে এশিয়ার দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
এ সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসা খুঁজে পেতে এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিজ বাসভূমে নিরাপদ, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরত পাঠাতে অবদান রাখতে আঞ্চলিক দেশগুলোকে অনুরোধ জানানো হয়।
পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ৪৮তম ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে তাদের উৎসে ফেরত পাঠাতে হবে বলে দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়ার করা মামলার আইনি খরচ মেটাতে স্বেচ্ছায় অবদান রাখতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে দৃঢ় সংহতির আহ্বান জানায় বাংলাদেশ। তুরস্ক এ তহবিলে দুই লাখ ডলার সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বাংলাদেশের উদ্যোগে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৭ জুলাই জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৫০তম অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের মাধ্যমে চলমান সংকট সমাধানে ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে।
এ প্রস্তাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ফলে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসার পাশাপাশি মিয়ানমারে তাদের ফেরত না যাওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহায়তার জন্য রাখাইনে কর্মসূচি বাড়াতে জাতিসংঘের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। ১৩ জুন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক মহাসচিবের বিশেষ দূত ড. নোলিন হাইজারকে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন ব্যবস্থার দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য এ অনুরোধ করা হয়।।
রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে ঘটনার ভবিষ্যৎ পুনরাবৃত্তি রোধ করতে সব দেশকে, বিশেষ করে আঞ্চলিক দেশগুলোকে এ সংক্রান্ত চলমান জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থায় সহযোগিতা দেওয়া ও তাদের প্রবেশাধিকার দিতে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশ দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আসিয়ান সদস্য দেশ এবং এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা অব্যাহত রাখার জন্য মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূতের প্রতি আহ্বান জানায়।
বাংলাদেশ চীনের সঙ্গেও আলোচনা অব্যাহত রেখেছে এবং ত্রিপক্ষীয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে, তবে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ আসিয়ানকে এ সমস্যার বিষয়ে অবহিত করেছে এবং জাপানের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা হয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং কূটনৈতিকভাবে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের জন্য চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য ইন্দোনেশিয়া ও আসিয়ানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমার এখন পর্যন্ত এ সংকটে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় দেশটির সঙ্গে এ বিষয়ে মধ্যস্থতা করতে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থেই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পাঠানোর ব্যাপারে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোকে সংকট সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের আলোচনা চলছে। মিয়ানমারের সঙ্গে করা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় এর সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে মিয়ানমার সম্মতি দিয়েছে। শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের মতে, এ সংকটের সমাধান মিয়ানমারেই। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপি মিয়ানমারের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় একটি সমঝোতার মাধ্যমে রাখাইনে কমিউনিটি প্রজেক্টগুলোতে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে সুষ্ঠু, নিরাপদ ও টেকসই পরিবেশ তৈরিতে আরও সাহায্য প্রয়োজন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সর্বশেষ সভা ২০১৯ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার। পরবর্তী সময়ে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের মধ্যে আর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়নি। দীর্ঘ এক বছর পর গত ১৪ জুন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসে দুই দেশ। সেই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে তিন বছর পর অনুষ্ঠিত হলো ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক। শীর্ষ পর্যায়ের এ বৈঠকে প্রত্যাবাসনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে মিয়ানমার। এক্ষেত্রে আসিয়ান ও জাতিসংঘের সহায়তা নিতেও রাজি আছে মিয়ানমার।
ইউক্রেন যুদ্ধ, আফগানিস্তান এবং বিশ্বে একাধিক মানবিক সংকটের কারণে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য, জ্বালানি তেলের সংকট ও মহামারিতে বিশ্ব জর্জরিত। ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ার গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের চাহিদা তুলে ধরার মাধ্যমে বৈশ্বিক মনোযোগ ও সমর্থন বজায় রাখার সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) নির্বাহী পরিচালক অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ সহায়তা সংকুচিত হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জাতিসংঘের কিছু কিছু কর্মসূচিতে খাদ্য রেশন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ বৈশ্বিক শরণার্থী সংকট এবং দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সংঘাতে বিশ্বজুড়ে অতিরিক্ত শরণার্থীর পাশাপাশি খাদ্যপণ্য ও শস্যের দাম বেড়ে গেছে।
চলমান পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তহবিল নিয়ে ‘সংকট’ হতে পারে বলে মনে করেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সম্পূর্ণভাবে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। আফগানিস্তান ও ইউক্রেন সংকটের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রতি যেন বিশ্বের মনোযোগ হারিয়ে না যায়। কারণ, দাতা দেশগুলো তাদের ত্রাণ তহবিল থেকে জরুরি ভিত্তিতে এসব সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিচ্ছে; এটা সামগ্রিক ত্রাণ সহায়তার ওপর প্রভাব ফেলছে। এর ফলে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থিক সহায়তার ওপর চাপ পড়তে পারে এবং ভবিষ্যতে এ ত্রাণ সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকটের দিকে যেন বিশ্বের মনোযোগ বজায় থাকে, সেজন্য ইউএনএইচসিআর হাইকমিশনার বাংলাদেশ সফর করেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উল্লেখ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সংহতি ও অব্যাহত সমর্থনের জন্য আবেদন জানিয়েছেন।
আঞ্চলিক দেশগুলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার। মিয়ানমার আসিয়ান সদস্য উল্লেখ করে, আসিয়ান দেশগুলোও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে বলে তারা মত প্রকাশ করেন।
ইউএনএইচসিআর হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি রোহিঙ্গাদের জন্য চলমান মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করবে বলে জানিয়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের উন্নয়নে নানা ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন করে সাত দশমিক এক কোটি মার্কিন ডলার অনুদান দেওয়ার কথা জানিয়েছে। এডিবির চলমান জরুরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় এ অনুদান দেওয়া হচ্ছে, এসব সহায়তা দুর্যোগের ঝুঁকি কমিয়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক চাহিদা পূরণ করবে।
বিশ্বব্যাংক টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তায় অনুদান হিসাবে ২৫৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ দেবে বলে জানিয়েছে। জাপান সরকার জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মাধ্যমে অতিরিক্ত আরও ৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে বাংলাদেশকে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকে জাপান প্রায় ১৭০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে।
কম্বোডিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী প্রাক সোখোন ৪ জুলাই ২০২২ মিয়ানমারে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে বৈঠক করেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রাক সোখোনের আসিয়ানের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণের পর মিয়ানমারসংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধানে কম্বোডিয়ার সক্রিয় ভূমিকার প্রশংসা করেন। আসিয়ানের সভাপতিত্ব গ্রহণ এবং মিয়ানমারে আসিয়ান চেয়ারের বিশেষ দূত হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রাক সোখোন, রোহিঙ্গা ইস্যুর টেকসই সমাধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে। আঞ্চলিক শক্তিগুলো বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মিয়ানমারের চলমান সমস্যাগুলো দেখছে এবং এক পক্ষকে প্রকাশ্য সমর্থনদান অন্য পক্ষকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে ঠেলে দিতে পারে-এমন আশঙ্কা থেকে তারা সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে সতর্ক। মিয়ানমারের ছায়া সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জি মা অং মনে করেন, ভারত একটি আঞ্চলিক শক্তি, তাই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ভারত তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।
মিয়ানমারের অর্থনীতিতে আঞ্চলিক অনেক দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তাদের বিনিয়োগ এবং চলমান বাণিজ্য সহযোগিতা মিয়ানমারকে পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধ ও চাপ থেকে রক্ষা করছে। এর ফলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান প্রলম্বিত হচ্ছে। সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মিয়ানমারের পরিস্থিতি অশান্ত হলেও দেশটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ থেমে নেই। মিয়ানমারে বিনিয়োগকারী প্রথম সারির দেশগুলো হলো-সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ড, মার্সাল দ্বীপপুঞ্জ, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম ও ভারত। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথমদিকে অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হলেও চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ অব্যাহত থাকায় তারা পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। এ দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ থাকার পরও অর্থনীতিকে সচল রেখেছে।
ভূ-রাজনৈতিকভাবে ভারত-চীন মিয়ানমারের সঙ্গে আছে। মিয়ানমারে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। আসিয়ান দেশগুলোও মিয়ানমারে বিনিয়োগ করছে ও অর্থনীতিকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রত্যাবাসনে চীন-ভারত, জাপান ও আসিয়ানকে কাজে লাগাতে হবে। এ দেশগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও থাইল্যান্ডে অবস্থানকারী অভিবাসী রোহিঙ্গাদের এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে।
আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে চীন, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারত আর্থিক ও মানবিক সাহায্য প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আসিয়ান দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং চলমান মানবিক সংকট মোকাবিলায় আরও জোরালো ভূমিকা নিতে পারে; কারণ, ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে এ দেশগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারকে সুসম্পর্ক রাখতেই হবে।
দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারণার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে তাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা ও তাদের প্রতি সহনীয় মনোভাব ফিরিয়ে আনতে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র যেমন- কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা মিয়ানমারের বৌদ্ধ সংগঠনগুলোর মনোভাব নমনীয় করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেন সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত, তারা তাদের আর্থিক, মানবিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সামর্থ্য ব্যবহার করে সমস্যার সমাধানে লেগে রয়েছে। এখন সময় হয়েছে এশিয়ার দেশগুলোর তাদের নিজস্ব সমস্যাগুলো নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে সমাধানে এগিয়ে আসা। রোহিঙ্গা সমস্যা এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট এবং এটি মোকাবিলায় আঞ্চলিক দেশগুলো একত্রে এগিয়ে আসার এখনি সময়। অর্থনৈতিক সহায়তার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে এ সমস্যার সমাধান করে আঞ্চলিক দেশগুলো বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে পারে এশিয়া সক্ষমতায় পিছিয়ে নেই।
ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন : এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল; মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক
