Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

এ দায় আমরা এড়াতে পারি না

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এ দায় আমরা এড়াতে পারি না

স্বাভাবিক মনে করা যাবে না। কদিন পরপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কোনো নাম গোত্রহীন কেউ ফেসবুকে ধর্ম অবমাননা করেছে, পবিত্র কুরআন অবমাননা করেছে, মহানবির প্রতি কটূক্তি করেছে। আর এর প্রতিবাদে জুমার নামাজের পর এক দল জেহাদি মনোভাবের মুসলমান নামধারী মানুষ মসজিদ থেকে বেরিয়ে পবিত্র কুরআন আর রাসূলের শিক্ষাকে অমর্যাদা করে হিন্দু বসতিতে আগুন দিচ্ছে, লুটতরাজ করছে। কখনো রামুতে ঘটছে, কখনো নাসিরনগরে আবার কখনো লোহাগড়ায়।

ভাবতে অবাক লাগে, হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়া এ বাংলার সমাজে সামান্য ঐতিহ্যচর্চার সুযোগও দেখাতে পারছে না এসব ধর্মীয় লেবাসধারী। আমার কাছে স্পষ্ট নয় যে, ইসলামের মতো এমন জীবন্ত ধর্ম-যে ধর্ম তার স্থিতিস্থাপকতার আদর্শের কারণে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে কে ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ বা মহানবিকে কটূক্তি করল তাতে কী আসে যায়! ধর্মের কতটা ক্ষতি হয় তাতে? এসবকে উপেক্ষা করতে পারি না কেন? ধর্ম রক্ষার নামে এরা সব প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছে। ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্যকে কালিমালিপ্ত করছে।

সবচেয়ে বড় কথা, এমন কালিমা এ যুগের সংযোজন। তেরো শতকের শুরু থেকে আঠারো শতকের মাঝপর্ব পর্যন্ত শুধু বাংলা নয়, ভারতবর্ষ শাসন করেছে বহিরাগত মুসলমান শক্তি। এ ছয় শতাধিক বছরে এদেশে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের কোনো অবনতি দেখা যায়নি। তেরো শতক থেকে আরব, ইরান, ইরাক, পশ্চিম এশিয়া-নানা অঞ্চলের সুফি সাধকরা এসে সাড়ম্বরে এ দেশে ইসলাম প্রচার করে সফল হয়েছেন। সেন যুগে ব্রাহ্মণ শাসকদের অত্যাচারে নিপীড়িত শূদ্র হিন্দুরা মুসলিম শাসক ও সাধকদের আনুকূল্য পেয়েছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা গড়ায় সুফিরা ভূমিকা রেখেছিলেন। ইংরেজ শাসন যুগের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এ অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ বজায় ছিল। শেষ দিকে এসে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রতিবাদী ভারতবাসীকে কৌশলে দিকভ্রষ্ট করার জন্য তাদের পরিচিত ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ চালু করে। পরিকল্পিতভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের বীজ ঢুকিয়ে দেয়। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে তা আরও স্পষ্ট হয়। পাকিস্তান আন্দোলন ঠেকাতে কোথাও কোথাও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিল। এসবই ছিল সুবিধাবাদীদের আরোপিত। এভাবে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরানো হয় ধর্মীয় কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণে।

পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ছিল ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’। তবুও সেই যুগে সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্পর্কে বড় রকমের ফাটল ধরেনি। এ পর্বে কয়েকটি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণই সক্রিয় ছিল। আর দাঙ্গাকারী মুসলমানদের বড় অংশ ছিল বিহারি মুসলমান ও সম্পদলোভী কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এখানে খুব কম ছিল। বরঞ্চ সাধারণ মুসলমান দাঙ্গার সময় প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারকে রক্ষার চেষ্টা করেছে।

এমন প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মুক্তির আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বর্তমানে এর বদলে যুক্ত হয়েছে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’। যা বাহাত্তরের সংবিধানকে লাঞ্ছিত করার শামিল। দুর্ভাগ্য আমাদের, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল বা আঁকড়ে থাকার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কালিমালিপ্ত করতে দ্বিধা করছে না। আর এসবের ফাঁক গলে তথাকথিত ধর্মীয় শিক্ষার নামাবরণে লেবাসধারী গোষ্ঠীবদ্ধ মুসলমানের বিস্তার ঘটেছে। প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা তাদের অনেকের বক্তব্য ও আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে না। বরঞ্চ ইসলামের নামে ধর্মমূর্খ মানুষগুলোকে ক্ষেপিয়ে তুলে যেভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাতে ইসলামের সৌন্দর্যকেই আঘাত করা হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এখান থেকে দেশ-জাতি ও ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্যকে রক্ষা করার জন্য কোনো পক্ষ এগিয়ে আসছে না।

উনিশ শতকে রাজা রামমোহন রায় যখন নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্রাহ্ম আন্দোলন শুরু করেন, তখন কট্টর হিন্দু নেতারা তাকে সমর্থন দেননি। বরঞ্চ সাধারণ হিন্দুর চিন্তার জগৎ যাতে বিকশিত না হয়, তাই ধর্মের নাম ভাঙিয়ে এবং ভুল ব্যাখ্যা করে অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত হিন্দুকে মন্দিরের চার দেওয়ালে আটকে রাখা হয়েছে। রামমোহন রায় শিক্ষিত পণ্ডিত মানুষ। তিনি হিন্দু ধর্মের মূল দার্শনিক গ্রন্থ বেদান্ত বা উপনিষদ পাঠ করে ধর্মের উদারতা বুঝতে পারলেন। নিরাকার এক ব্রহ্মার আরাধনাকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের একমাত্র আরাধ্য বিষয় বলে প্রচার করতে থাকলেন। এভাবে সাধারণ হিন্দুকে ধর্মমূর্খতা থেকে বের করতে চেয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এ একুশ শতকে এসেও যখন একদল লেবাসধারী সেয়ানা ধর্মনেতা ধর্মের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনের কোমল জায়গাটিকে ব্যবহার করে উত্তেজনা ছড়ায় এবং অন্য ধর্মের মানুষের বাড়িঘরে হামলা করে, তখন এ অন্ধ মানুষগুলোকে আলোকিত করে সুপথে আনার জন্য আমরা কোনো পক্ষই এগিয়ে আসি না। এত ঘটনা ঘটছে, তবুও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এসব প্রতিহত করার কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখছি না। প্রকৃত আলেম সম্প্রদায়কেও দেখছি না ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করে ধর্মের সৌন্দর্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে।

সাম্প্রতিক নড়াইলের অঘটনের কথাকেই যদি সামনে আনি, সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো হিন্দু নামধারী কারও কটূক্তির প্রতিক্রিয়া। এখানে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কেউ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ অর্জনের জন্য নাম ভাড়িয়ে অনর্থ বাধাতে পারে। সেই কটূক্তিকারীকে কি শনাক্ত করা গেছে? তাহলে তো তাকে আইনের হাতে দেওয়ার কথা। আমি বোখারি শরিফের ২৮০০নং হাদিসটিকে স্মরণ করতে পারি। সেখানে উল্লেখ আছে, হজরত আবু হুরাইরা কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি-একজন নবিকে একটি পিঁপড়া কামড় দিলে তার আদেশে পিপীলিকার গোটা আস্তানাটিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আল্লাহ ওহির মাধ্যমে তাকে জানালেন, ‘একটি মাত্র পিপীলিকা তোমাকে কামড় দিয়েছে আর তুমি একদল পিঁপড়াকে আগুনে পুড়িয়ে মারলে?’

নড়াইলের যে মসজিদে জুমা নামাজের সময় সাধারণ ধর্মমূর্খ মানুষকে উত্তেজিত করে হিন্দুপাড়া আক্রমণে উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল, তার সূত্র বের করতে মসজিদের ইমামসহ মসজিদসংশ্লিষ্টদের কি জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হয়েছে? মুক্তচিন্তার ধার্মিক আলেম সমাজ কি ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে ভুলপথে চালিত করার হাত থেকে রক্ষার জন্য কোনো সংগঠিত ভূমিকা রাখছেন?

সাধারণ মানুষকে অন্ধত্ব থেকে বের করে মানবিক করে তোলার জন্য রাজনীতিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা রাখার যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু সে দায়িত্ব আমরা কতটুকু পালন করে থাকি? আমাদের ক্ষমতার রাজনীতিতে বাঁধাপড়া রাজনৈতিক নেতারা পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে যে পরিমাণ কণ্ঠশীলন করেন, এর সিকি পরিমাণও যদি সমাজ সংস্কারে ভূমিকা রাখতেন, তাহলে আমরা বেঁচে যেতাম। এদেশে বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর তো রাষ্ট্রক্ষমতায় পৌঁছার ইঁদুর দৌড়ের সুযোগ কম। তাই তারাও যদি স্বর্ণলতা হয়ে এর-ওর গলায় না ঝুলে এসব দূরাচার থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য ভূমিকা রাখতেন, তবে উপকার হতো সমাজের। পাকিস্তান আমল থেকে দেখেছি সাংস্কৃতিক কর্মীরা সংগঠিত হয়ে অন্ধত্বে জড়িয়ে থাকা মানুষকে মুক্তচিন্তায় নিয়ে আসায় ভূমিকা রাখতেন। এখন সব ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণ এত বেশি হচ্ছে যে, সঠিক দায়িত্ব পালনে কোনো পক্ষকে দেখা যাচ্ছে না। আমরা সেই দুর্যোগের কথা স্মরণে আনতে পারি। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গ্রেফতার হওয়ার পর পাবনার গ্রামের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অন্ধত্বকে পুঁজি করে মৌলবাদী গোষ্ঠী সাঈদীর ছবি চাঁদে দেখা গেছে এমন অপপ্রচারে ক্ষিপ্ত করেছিল সাধারণ মানুষকে। হাজার হাজার মানুষ আক্রমণ করেছিল থানা। এ সাধারণ মানুষকে একুশ শতকে মুক্তচিন্তায় নিয়ে আসার জন্য মৌলবাদীদের আগে কি সাংস্কৃতিক কর্মীরা পৌঁছতে পেরেছিল পাবনার গ্রামে? একইভাবে রামুতে, নাসিরনগরে বা নড়াইলে মৌলবাদীদের আছর থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের কতটুকু ভূমিকা রয়েছে? সাংস্কৃতিক সংগঠন তো আছে অনেক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটও তো রয়েছে। জোটের জাতীয় কমিটি আছে, স্থানীয় কমিটিও আছে। কী দায়িত্ব পালন করছেন জোট নেতারা। মৌলবাদীদের প্রপাগান্ডার গতির কাছে তারা বারবার পরাস্ত হচ্ছেন।

আমরা মনে করি, জাতির এ দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রত্যেকেরই ব্যর্থতার দায় রয়েছে। শত শত বছরে অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে বিকাশ ঘটেছিল, তা হঠাৎ যেন রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থবাদীদের অন্যায় আচরণে ভেঙে পড়ছে। এদেশের সাধারণ মানুষ এখনো মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িকতা লালন করে। মৌলবাদী দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্র চায় ধর্মমূর্খ সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় আবেগ দিয়ে আচ্ছন্ন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে। কিন্তু একে মোকাবিলা করতে কোনো পক্ষ এগিয়ে আসছে না। আমি মাঝেমধ্যে পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন ও ছয় দফা আন্দোলনে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মিছিলের ছবিগুলো দেখি। প্রতিটি ছবিতে শালীন শাড়ি পরিহিতা মেয়েরা রয়েছে। কষ্টেও একজন হিজাব পরিহিতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর এখন পথেঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে হিজাবের বিপুল ব্যবহার। অসংখ্য হিজাব ও বোরখার দোকান। আমি বলছি না এসব মন্দ দিক। বলা যায়, পোশাকি মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সেই মতো শান্তির ধর্ম ইসলামকে তাদের সামনে উপস্থাপন করতে পারছি না। তের শতকের পর থেকে বিখ্যাত সুফি সাধকরা বাংলায় বড় বড় মাদ্রাসা নির্মাণ করেছিলেন, যেখান থেকে মুসলিম শিক্ষা ছড়িয়ে পড়েছিল। এসব মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকায় কুরআন-হাদিস ছাড়াও চিকিৎসাবিদ্যা, আইন, গণিত, বিজ্ঞানের মতো নানা বিষয় ছিল। এভাবে মাদ্রাসাগুলোতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার চর্চা ছিল। এখন দিনে দিনে মাদ্রাসার সংখ্যা অসংখ্যতে পরিণত হয়েছে। গ্রামে-গঞ্জে, অলিতে-গলিতে নানা নামের মাদ্রাসার বিস্তার ঘটছে। সেখানে কতটা সেক্যুলার বিষয় পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানো হচ্ছে তা আমার জানা নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যে ধর্মের নামে ভিন্ন ধর্ম ও মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মিছিলে এসব মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।

এ অবস্থায় সব পক্ষ দায় না এড়িয়ে যদি প্রকৃত ধর্ম শিক্ষা দিয়ে ও সংস্কৃতির আলো ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের মন থেকে অন্ধত্ব সরাতে না পারি, তবে আরও ঘোর অন্ধকার অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

ধর্ম অবমাননা ইসলাম

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম