মানুষের সহ্যশক্তিরও একটি সীমা থাকে
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দিন কয়েক আগে একটি টিভি চ্যানেলে সংবাদপত্র পর্যালোচনা করছিলাম। নিত্যপণ্যের বাজারে যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, সে প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন রাখলেন উপস্থাপক। জানাতে বললেন আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। আমি বলেছিলাম, বাজারের দায়িত্বটি গৃহকর্ত্রীর। তাপ-উত্তাপটা তিনি ভালো অনুভব করেন। গতকাল তিনি মাসের বাজার করে ফিরলেন। অসহায়ের মতো বললেন, তিনি জানতেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা। তাই বাজেট বাড়িয়েই বাজারে গিয়েছিলেন। সব মাসের মতোই বাজার তালিকা ছিল। বললেন বাজেটের টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার পর ব্যাগের গোপন পকেটে হাত দিতে হলো। বিপদ-আপদের জন্য সেখানে কিছু সঞ্চয় ছিল, সেটিও উড়ে গেল বাজারের দমকা হাওয়ায়।
বাজার ঘুরে এসে যে অভিজ্ঞতা হলো, তাতে গৃহকর্ত্রী চিন্তিত হয়ে পড়লেন নিম্নআয়ের মানুষদের নিয়ে। মধ্যবিত্তের যেখানে নাভিশ্বাস, সেখানে নিম্নআয়ের মানুষ কতটা কষ্টে আছে বোঝা যায়। সেদিনের সংবাদপত্রটি টেবিলে ছিল। তাতে মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ছবি। নিচে তার বক্তব্য দিয়ে হেডিং করা হয়েছে। দেশবাসীর যাপিতজীবন বা অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সম্ভবত তিনি সরলভাবে বলেছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে। পরে মন্ত্রী মহোদয় ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি মুদ্রাস্ফীতির তুলনা করে বলেছেন। আমাদের মনে হয়েছে, যাহা বায়ান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। আমি সংগোপনে গৃহকর্ত্রীর দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে গেলাম পত্রিকাটি। সদ্য বাজার ফেরত মানুষের অমন হেডিং পড়ে কী প্রতিক্রিয়া হয় কে জানে!
মন্ত্রী মহোদয়ের মন্তব্য পড়ে আমার কেন যেন ফরাসি বিপ্লবের সময়ের কথা মনে হলো। বিপ্লবীরা রাজপ্রাসাদের বাইরে স্লোগান তুলছে। ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের রানি জানতে চাইলেন কৃষক এত হইচই করছে কেন। প্রহরীরা জানালো রুটির অভাবে ওরা আন্দোলন করছে। তখন এমনি সরলভাবে রানি উত্তর করলেন, রুটি নেই তাতে কী! ওদের কেক খেতে বল!
বেহেশতে বসবাস করে কি দোজখের উত্তাপ অনুভব করা যায়? রানি হয়তো কাছে থেকে কখনো সাধারণ মানুষের কষ্ট অনুভব করতে পারেননি। তাই তার মন্তব্যকে বিদ্রুপ মনে না করে সরল উক্তিই ভাবা যেতে পারে। আমাদের দেশের কোনো কোনো দায়িত্ববান নাকি বলেন, দেশে কি মানুষ না খেয়ে মরেছে? শুনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথা মনে হয়েছিল। এখন বোধহয় কাদম্বিনীদের ‘মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে তাহারা মরে নাই।’
আমি তো বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মানুষ অনেক সহনশীল। বাস্তবতা তারা বিবেচনা করতে জানে। মানুষ জানে বর্তমানের বৈশ্বিক সংকটের কথা। করোনার আঘাতে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক সংকটে ভুক্তভোগী মানুষ। সরকারও নানাভাবে চেষ্টা করেছে যতটা সম্ভব দুর্ভোগ কমিয়ে আনতে। আমরা অনেকেই সংকট মোকাবিলা করে টিকে আছি। নিম্নআয়ের মানুষ অনেকেই কর্মহীন হয়ে বিপদে পড়েছিলেন। তাদের কেউ কেউ এখনো কাজে ফিরতে পারেননি। অনেক বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা স্কুল কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবন কাটিয়েছিলেন। এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। বেতন বৃদ্ধির আনন্দে ও স্বস্তিতে থাকা মধ্যবিত্ত চাকুরে করোনা ও করোনা-উত্তরকালে নিত্যপণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধিতে সংসারের বাজেট ঠিকমতো মেলাতে পারছিলেন না।
এমন বাস্তবতায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আঘাত বিপর্যস্ত করে তুলছে সাধারণ মানুষের জীবন। এমন সংকটেও বাস্তবতা অনুভব করে মানুষ সহ্য করে যাচ্ছিল; কিন্তু সরকারি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি তৈরি করছে বড় ধরনের সংকট। বিপন্ন সাধারণ মানুষ দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক বলে দুষছে সরকারকে। সাধারণ মানুষের কঠিন জীবনধারা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা ক্ষমতাবান সুখী মানুষ তাদের প্রতিদিনের নতুন নতুন বাণীতে ফরাসি রানির মতো কৌতুকের উপাদান ছড়াচ্ছেন; কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবছেন না।
তেলসহ নানা আমদানিনির্ভর পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে দেশে। এখন সাধারণ মানুষ বুঝতে শিখেছে, মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া পণ্য আমদানি করে দেশে আনতে কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগে। কিন্তু এদেশে ব্যবসায়ীরা মূল্যবৃদ্ধির শব্দ শুনে তিন মাস আগেই পূর্বে কেনা পণ্যে বাড়তি লেবেল এঁটে দেন। দেশবাসীকে সেই কশাঘাত হজম করতে হয়। আমদানি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতা দেখিয়ে আসছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ। অনেকে মনে করেন, হয়তো অন্যরকম আপস আছে পরস্পরের মধ্যে।
প্রতিদিন রাজনৈতিক বক্তব্য রাখা সরকারি মুখপাত্রগণ যেসব বাণী বিতরণ করেন, তাতে মনে হয় না তারা সাধারণ মানুষের যাপিতজীবনের কষ্ট অনুভব করতে পারেন। এর মধ্যে নতুন সংকট তৈরি করেছে ইতিহাস সৃষ্টি করা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিশাল উল্লম্ফন। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব পড়ে জীবন চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে। যত অর্থনৈতিক সংকটেই থাক, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কথা নয়। কিছুদিন আগেও সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ডলার রিজার্ভ এখনো যথেষ্ট ভালো। আর এরপরই আইএমএফের কাছে ঋণ চাইতে গিয়ে কঠোর শর্তে জড়িয়ে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে কাঁঠাল ভাঙতে হলো সরকারকে। রাতারাতি ৮০ টাকার ডিজেল, কেরোসিন হয়ে গেল ১১৪ টাকা, ৮৬ টাকার পেট্রোল হয়ে গেল ১৩০ টাকা, ৮৯ টাকার অকটেন হয়ে গেল ১৩৫ টাকা। এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় ভারত জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমিয়েছে। ভারতে বর্তমানে পেট্রোল ১০৫ রুপি, ডিজেল ৯৩ রুপি। আমাদের বিধায়করা কেবল মুখে বলছেন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমলে সমন্বয় করবেন। এর কোনো বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি না।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে বাস মালিকদের পোয়াবারো হয়। ভাড়া বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করে নেয়। বাজারে প্রচার রয়েছে, অধিকাংশ পরিবহণ মালিক সরকারি দলের এবং ক্ষমতার বড় বড় আসনে আসীন। তাই জনগণের ঘাড় ভেঙে সমন্বয়টা তাদের পক্ষেই যায়। কয়েক মাস আগে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে পরিবহণ ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। এবার বাস মালিকদের দাবির মুখে বাড়ানো হলো ২৭ শতাংশ যোগ করে ৪৭ শতাংশ। এরপরও অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদায় করা হচ্ছে এর চেয়েও বেশি। নির্দিষ্ট আয়ের পেশাজীবী, যাদের প্রতিদিন বাসে চড়ে কর্মক্ষেত্রে যেতে-আসতে হয়, তারা বাজেট সমন্বয় করবেন কীভাবে? এমনিতেই তো নাভিশ্বাস তাদের। কৃষকের উৎপাদন খরচ হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এসব বাস্তবতার উঠোনে দাঁড়িয়ে মানুষ যে সহ্যশক্তি হারাতে বসেছে, তা নীতিনির্ধারকরা টের পাচ্ছেন কিনা জানি না।
ছোট দেশ, সবাই সবাইকে জানে ও চেনে। মানুষ বুঝতে শিখেছে বৈশ্বিক সংকট থাকলেও চরম দুর্নীতির গ্রাস দেশকে অনেক বড় সংকটে ফেলেছে। বিএনপি আমলে সরকার তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, একে টপকিয়ে এখন আবার চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরার জন্য সরকারি দল তৎপর বলেই মানুষ বিশ্বাস করে। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, আসামের সেই চক্রবর্তী মহাশয়ের দশায় পড়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। গল্পটি আমি প্রাসঙ্গিক বলে কয়েক বছর আগে একটি কলামে উল্লেখ করেছিলাম। মায়ের কাছে শোনা আমার নানার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প। ব্রিটিশ আমলে নানা ইংরেজ সাহেবদের র্যালি ব্রাদার্সে পার্চেজার ছিলেন। পণ্য কিনতে মাঝেমধ্যে আসামে যেতে হতো। বনের পাশে চক্রবর্তী মহাশয়ের বাড়ি। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় নানার। চক্রবর্তী বাবু তার জীবন থেকে গল্পটি বলেছিলেন। জঙ্গল থেকে এক দলছুট চিতা শাবককে কুড়িয়ে এনেছিলেন তিনি। দিনে দিনে পোষ মেনে যায় চিতাটি। চিতাটি তখন তারুণ্যে দীপ্ত। চক্রবর্তী বাবু শীতের সকালে উঠোনে ইজিচেয়ারে শুয়ে পেপার পড়ছিলেন। পাশে চিতাটি দাঁড়ানো। একসময় চক্রবর্তী বাবুর হাত চাটতে থাকে পরম আদরে। এক পর্যায়ে রক্তের গন্ধ পেয়ে যায়। চিতাটিকে সরাতে গেলে চোখ কটমট করে তাকায়। বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। বুনো স্বভাব জেগে উঠেছে চিতার। বাড়ির লোকজনকে ডেকে বন্দুকের নল মাথায় ঠেকিয়ে মেরে ফেলতে হয় চিতাটিকে।
মানুষ সন্দেহ করে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি রক্তের গন্ধ পাওয়া এমন অনেক চিতা হয়তো আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সততার মূল্য তাদের কাছে নেই। নানা কারণে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে হয়তো পারা যাচ্ছে না। কষ্টে থাকা সাধারণ মানুষও এখন এভাবে মূল্যায়ন করে। দিনকয়েক আগে পলাশী থেকে রিকশায় বাংলাবাজার যাব। রিকশাওয়ালা দেড়শ টাকার কমে যাবে না। অগত্যা রিকশায় চড়তে হলো। যেতে যেতে রিকশাওয়ালা সমাজ-রাজনীতির বিশ্লেষণ করছিলেন। এত ভাড়া নেওয়ার পরও সংসার চলে না ঠিকমতো। মাছ-মাংস কেনা ছেড়ে দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে ডিম খেতেন। এখন ডিমের হালি ৫০ টাকা (এর মধ্যে ডিমের দাম আরও বেড়েছে)। ডিম কিনতে হলেও তিনবার ভাবতে হয়। রিকশাওয়ালার দুঃখ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য। নিজে থেকেই বললেন, চারপাশের মানুষ সৎ না হলে তিনি একা কী করবেন।
আমি ভাবছিলাম ১২০৪ সালের কথা। বাংলার মানুষ বরাবরই স্বাজাত্যবোধে দৃঢ় ছিল। দেশের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্বের জন্য তারা লড়াই করেছে। কিন্তু ভিন্ন রূপ দেখা গেল ১২০৪ সালে। মুসলিম বিজেতা বখতিয়ার খলজি এসেছেন নদীয়ার দ্বারপ্রান্তে। সেন রাজা লক্ষণ সেনের দ্বিতীয় রাজধানী এটি। তিনি আক্রমণ করে একরকম বিনাযুদ্ধে দখল করে ফেললেন নদীয়া। এই প্রথম সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। কারণ সেন শাসকদের বৈরী শাসনে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষ। সহ্যশক্তির সীমা অতিক্রম করেছিল তাদের। তাই স্বধর্মীয় শাসকরা সাধারণ মানুষের সমর্থন হারায়। তুর্কি আক্রমণকারীদের পক্ষে বাঙালি দাঁড়ায়নি ঠিকই, কিন্তু কোনো সমর্থনও দেয়নি সেন শাসকদের। অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পরিবর্তন তাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। ১২০৪ সালে আরেকবার প্রমাণিত হয়েছিল, টিকে থাকতে হলে জনসাধারণের সমর্থন অনেক বেশি প্রয়োজনীয়।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
