সড়ক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন রোড সেফটি অডিট
শাহনেওয়াজ হাসানাত-ই-রাব্বি
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তাব্যক্তি রহিম সাহেব খুব চিন্তিত। তিনি জানেন, রান্নার আয়োজন করা একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।
পরিমাণে সামান্য হেরফের হলে রক্ষা নেই, বিশেষ করে যখন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দাওয়াত দেওয়া হয়। যেমন আজ সন্ধ্যায় ছেলেপক্ষের লোকজন তার মেয়েকে দেখতে আসবে। গতবারের মতো তিনি আর ভুল করতে চান না। সেসময় সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু পেরেছিলেন করেছিলেন। খাবারের স্বল্পতা ছাড়াও তরকারিতে ঝাল-লবণও একটু বেশিই হয়েছিল।
রহিম সাহেবের ছোট বোন একজন পাকা রাঁধুনি। খবর পেয়ে তিনি নিজ আগ্রহে গ্রাম থেকে চলে এসেছেন, ভাইঝির আয়োজনে রান্না করতে চেয়েছেন। কিন্তু রহিম সাহেব কারও কথাই শোনেননি। ধার-দেনা করে কোনো এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টের একজন বাবুর্চি নিয়ে এসেছেন।
রহিম সাহেবের বোন দাঁড়িয়ে থেকে বাবুর্চির কাজ দেখছেন। বাবুর্চি তো চাইনিজ রান্নার এক্সপার্ট, তিনি মাছের দো-পেঁয়াজা বা গরুর মাংসের ভুনা কী করে রাঁধবেন? তিনি চাল-মসলা-তেলের এস্টিমেটে ভুল করলেন। রহিম সাহেবের বোন একটু ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে বাবুর্চি ও রহিম সাহেব দুজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। ভাবখানা এমন-তুই কি বেশি বুঝিস?
রান্নার মাঝে ঝাল-নুন চেখে দেখার কথা বলতেই বাবুর্চি এবার যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন।
শেষমেশ রান্না হলো ঠিকই, তরকারিতে ঝালও মোটামুটি ঠিক আছে। সমস্যা বাধল লবণ নিয়ে। লবণ একটু বেশিই হয়ে গেছে। আর চালও ঠিকমতো ফোটেনি, পানি কম হয়েছিল। এখন কী করা যায়? রহিম সাহেবের মাথায় হাত। বাবুর্চিও নিশ্চুপ। পরে বোনের নির্দেশনা অনুযায়ী তরকারিতে কিছু আলু গোটা গোটা করে দেওয়ায় লবণের আধিক্য কিছুটা কমল। কিন্তু আধা সিদ্ধ চাউল আর সিদ্ধ হলো না।
ওগুলোই খাবার টেবিলে পরিবেশন করা হলো। পাত্রপক্ষের লোকজনের প্রতিক্রিয়া কী ছিল সেটা নাইবা জানলাম।
মধ্যম আয়ের আমাদের এ দেশে সড়কের ডিজাইন যেন ওই বাবুর্চির রান্না করার মতোই। এটা বলছি না যে, যেসব বিদেশি কনসালটেন্ট আমাদের রাস্তার ডিজাইন করেন, তাদের কোনো যোগ্যতা নেই, বরং তাদের জ্ঞান অনেক। কিন্তু কমতি হলো আমাদের দেশের চালকদের ড্রাইভিং কালচারের এবং সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের সম্যক ধারণার। স্থানীয় যানবাহন চলাচলের ধরন বা ভারী যানবাহনের ওভারলোডিং সম্পর্কে তাদের জ্ঞান সীমিত। একইভাবে যাত্রী ওঠানামা বা পথচারীদের যত্রতত্র রাস্তা পারাপারের বিষয়েও তারা অতটা অবগত থাকেন না।
এ ছাড়া সড়কের পাশে স্থানীয় জনগণ কর্তৃক হাট-বাজার বসানো বা স্কুল/মসজিদ তৈরি করাসহ আরও কিছু বিষয় বিবেচনায় না থাকার কারণে সুন্দরভাবে নির্মিত হওয়ার পরও প্রায় সময়ই সড়ক কাক্সিক্ষত সার্ভিস দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে বেড়ে যায় সড়ক দুর্ঘটনা। এতে জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি সড়কেরও ক্ষতি হয়। দুর্ঘটনার বিবিধ কারণ থাকলেও যখন দেখা যায় একই স্থানে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে, তখন বুঝে নিতে হয় ওই স্থানে সড়কের ডিজাইনগত ত্রুটি রয়েছে।
সেক্ষেত্রে ওই স্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয় কিছু টুলস। যেমন-গতি সীমিত করার জন্য সাইন বা ওভারটেকিং নিষেধসংক্রান্ত সাইন/মার্কিং। অনেক সময় সড়কের প্রশস্ততা কিছুটা বাড়িয়ে ডিভাইডার দেওয়া হয়। এতে ওই স্থানে দুর্ঘটনা কমে গেলেও অন্য কোনো স্থানে একইভাবে ডিজাইনগত ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। তখন আবার ওই স্থানেও কিছু সেফটি মেজার নিতে হয়।
এভাবে বারবার জ্বর বা ব্যথানাশক ওষুধ না খেয়ে শুরুতেই যদি পুরো শরীরটা পরীক্ষা করে নেওয়া যেত, তাহলে আগে থেকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো। একইভাবে সড়কের সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন সড়ককে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা। এ পরীক্ষা করাটাই হলো রোড সেফটি অডিট, যার প্রধান উদ্দেশ্য সড়কের নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি চিহ্নিত করা এবং তার প্রতিকার/প্রতিরোধের জন্য সুপারিশমালা প্রণয়ন করা।
এ সেফটি অডিটের প্রচলন আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। যাওবা দু-একটি ক্ষেত্রে করা হয়, সেটিও সড়ক ডিজাইনের শুরুতে করা হয় না, ফলে সেসব ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা হয় রহিম সাহেবের বাবুর্চি কর্তৃক পোলাও রান্নার মতো। কখনোবা গোটা গোটা আলুর মতো নামকাওয়াস্তে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয় দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে, কিন্তু তা কি আসলেই যথেষ্ট?
সাধারণত সেফটি অডিট বিভিন্ন স্টেজে করা হয়। যেমন, পরিকল্পনা/প্ল্যানিং স্টেজে বা ডিজাইন করার পর ডিজাইনগুলো অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান (যারা এ বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্ট নয় এবং অভিজ্ঞ) দিয়ে চেক করা। ফলে ডিজাইনে কোনো কমতি/দুর্বলতা থাকলে তা সমাধান করে সড়ক নির্মাণ করা হলে ভবিষ্যতের দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে যাবে। কিন্তু দুর্বলতাসহ সড়ক একবার নির্মাণ হয়ে গেলে সেগুলো সংশোধন করা যেমন কঠিন, তেমনি এতে খরচও অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া সড়কের নির্মাণকাজ চলমান অবস্থায় সেফটি অডিট করে অপর্যাপ্ত ডিজাইনে সমন্বয় আনা যায়। ফলে নির্মাণকাজ শেষে আমরা পেতে পারি ‘রোগমুক্ত সুস্থ-সবল’ সড়ক।
আবার সড়কের নির্মাণ শেষে যানবাহন চলাচল শুরুর আগেও যদি সেফটি অডিট করা যায়, তাহলেও দুর্ঘটনা ঘটার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়। দুর্ঘটনার পর স্থানভিত্তিক চিকিৎসা না করে অর্থাৎ শুধু ওই নির্দিষ্ট স্থানে সেফটি মেজার না দিয়ে নিদেনপক্ষে যদি বিদ্যমান সড়কের ক্ষেত্রেও সেফটি অডিট করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতের দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানোর মাধ্যমে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তাই নতুন সড়কের ক্ষেত্রে ডিজাইন স্টেজে এবং অন্যান্য বিদ্যমান সড়কের ক্ষেত্রে সেফটি অডিট সম্পন্ন করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এ ছাড়া নতুন কোনো সড়কের নির্মাণ কাজ শুরুর আগে সেফটি অডিট সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতার বিষয়েও দৃষ্টি দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
শাহনেওয়াজ হাসানাত-ই-রাব্বি : সহকারী অধ্যাপক, দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
