Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

বিদ্যুৎ সংকটে দুর্ভিক্ষের বিপদ

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যুৎ সংকটে দুর্ভিক্ষের বিপদ

দেশ একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। এ সংকটের সূচনা জ্বালানি সমস্যা থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে ডিজেল আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপর চাপ পড়েছে।

বর্তমান সংকট শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল। এ রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তখন কেউ ভাবতে পারেনি বাংলাদেশ বিদেশি মুদ্রার মজুত নিয়ে সংকটে পড়বে। কিন্তু বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে।

একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কোথা থেকে আসে? একটি দেশ অন্যান্য দেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। দেশের উন্নয়ন সহযোগীরা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশকে যে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়, তাতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে, তার মাধ্যমেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে বিদেশ থেকে পণ্যসামগ্রী আমদানি করতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে হাত পড়ে। এক সময় বলা হতো, তিন মাসের পণ্যসামগ্রী আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যদি একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকে, তাহলে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়-বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে ঘাটতি নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই Rule of the thumb এখন প্রযোজ্য বলে মনে হয় না। দেশে অনেক মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিদেশ থেকে অনেক কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। তিন মাসের নিয়মটিতে এত বেশিসংখ্যক মেগা প্রকল্পের কথা হয়তো ভাবা হয়নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, প্রতিটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর সিমেন্টের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে এখন বেশকিছু সিমেন্ট ফ্যাক্টরি সিমেন্ট উৎপাদনে নিয়োজিত আছে। দেশে সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য যে ক্লিংকার ও অন্যান্য কাঁচামালের প্রয়োজন হয়, তা বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় না। এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। যেহেতু দেশে এখন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রচুর সিমেন্টের প্রয়োজন হয়, সেহেতু এর সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য সিমেন্টের কাঁচামাল বড় পরিমাণে আমদানি করতে হয়। আমদানি ব্যয় কেন বাড়ছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য এ দৃষ্টান্তটিই যথেষ্ট।

মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকায় বেশি পরিমাণে ইস্পাতের সামগ্রী প্রয়োজন হয়। দেশে বেশকিছু ইস্পাত কারখানা চালু আছে। এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালও আমদানি করতে হয়। সব মিলে আমদানি বেড়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত দিনগুলোতে আমরা দেখেছি আমদানিতে উল্লম্ফন ঘটেছে। আমদানি ব্যয় ৫০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। এর পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধি পেলেও আমদানিতে যে ব্যয় হয় তা রপ্তানি আয় দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চলতি খাতে ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমান বছরের অভিজ্ঞতা হলো, রপ্তানি বাড়ছে না। সুতরাং আমদানি ব্যয় নির্বাহ করার জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা হাতে আসছে না।

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে বাংলাদেশি টাকার মূল্যমান হ্রাস পাচ্ছে। ডলারের বাজারে উথাল-পাথাল চলছে। এ বাজারে ভয়াবহ ওলটপালট চলছে। এক সময় ৮৩-৮৪ টাকা দিয়ে ১ ডলার কেনা যেত। এখন ১ ডলার কেনার জন্য ১০০ টাকা বা কখনো কখনো এর চেয়ে বেশি টাকার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশি টাকায় ডলারের মূল্য ওঠানামা করছে। এ অবস্থায় দেশে যারা রেমিট্যান্স পাঠান, ডলারের বাজারের ওঠানামার কারণে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। এর ফলে সামগ্রিকভাবে রেমিট্যান্স-প্রবাহ সুস্থির থাকছে না। অনানুষ্ঠানিক বাজার বা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আনুষ্ঠানিক বাজারে দেখা দিচ্ছে অনিশ্চয়তা। ১ ডলার ক্রয় করার জন্য যে পরিমাণ দেশীয় টাকার প্রয়োজন হয়, তা নির্ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ও চাহিদার ওপর। সরবরাহ ও চাহিদার সূত্রটি একটি অমোঘ সত্য। বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে কাম্য স্তরে নিয়ে আসার জন্য এর চাহিদা ও সরবরাহের উপাদানগুলোর ওপর নজর রাখতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করতে হবে।

আমরা শুনেছিলাম ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হলো, বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় লোডশেডিং দিনে ৫-৬ বার পর্যন্ত হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের ফলে ২৪ ঘণ্টায় ১০-১২ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ নিয়ে যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য মূলত দায়ী জ্বালানি তেলের অভাব এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর মূল্যবৃদ্ধি। বেশি টাকা খরচ করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করতে হলে রিজার্ভের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। তাই এই জটিল সময়ে খুব হিসাব-নিকাশ করে চলতে হবে। তা না হলে আমাদেরও শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

কিছুসংখ্যক বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশে রিজার্ভের পরিমাণ আশঙ্কাজনক নয়, তবে একে উদ্বেগজনক বলা যায়। দেশে এখন ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা আছে। তবে এর মধ্যে সরবরাহ করা হচ্ছে ১২-১৩ হাজার মেগাওয়াট। এই যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতানুযায়ী সঞ্চালন ও পরিবহণ করা যাচ্ছে না, তার জন্য একদিকে দায়ী উপযুক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার প্রচণ্ড ঘাটতি এবং আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জ্বালানি আমদানি করতে না পারা। একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামালের সংকট এবং অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের ঘাটতি-সবকিছু মিলে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে গেছে।

আমাদের দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমের একটি বড় সমস্যা হলো সম্পূরক সুবিধা গঠন করতে ব্যর্থতা। সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বেশকিছু ছোট ও মাঝারি সেতু। এগুলো নির্মাণ করতে যে ব্যয় হয়েছে, তা তুলে আনতে না পারা। এই সেতুগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, কারণ সেতুগুলোর দুপাশে সংযোগ সড়ক তৈরি করা হয়নি। এভাবে ব্যয়িত অর্থ থেকে কোনোরকম সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হলেও এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের রয়েছে বড় ধরনের ঘাটতি। এই ঘাটতি নিকট ভবিষ্যতে পালটে দেওয়া সম্ভব হবে না। কুইক রেন্টাল ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো দ্বারা যখন বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছিল, তখন এ বাড়তি বিদ্যুৎ কীভাবে বণ্টন ও সঞ্চালন করা হবে-সেই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে আমলে নেওয়া হয়নি। কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার সময় ভাবা উচিত ছিল কীভাবে প্রাপ্ত বাড়তি বিদ্যুৎ ভোক্তার ঘরে পৌঁছে দেওয়া হবে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেকগুলো এখন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। চুক্তি মোতাবেক সরকারকে এখন অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। সরকারকে কোনো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান করতে খেলাপি হতে হচ্ছে। ক্যাপাসিটি চার্জ জনগণের ওপর একটি বাড়তি চাপ। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবরকম পণ্যসামগ্রীর মূল্য দেড় থেকে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় একই অনুপাতে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে। মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করার পদক্ষেপ বলিষ্ঠভাবে নেওয়া হচ্ছে না। ভাবতে অবাক লাগে, আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার জ্ঞাণী-গুণী বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছে। তবুও তারা কেন যথাসময়ে সরকারকে সাবধান করার জন্য উদ্যোগ নিলেন না!

বিদ্যুৎ নিয়ে বড় ধরনের সংকট অবশ্যম্ভাবী জেনে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো হলো লোডশেডিং করা এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া। এখন দোকানপাটগুলো রাত ৮টায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। বলা হয়েছিল, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে লোডশেডিং করার জন্য লোডশেডিংয়ের সময় আগাম জানিয়ে দেওয়া হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন লোডশেডিং কোনো ছকের মধ্যে পড়ছে না। ধীরে ধীরে লোডশেডিং নিয়ে নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সংবাদমাধ্যম থেকে গত সোমবার জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, গ্যাস বিদ্যুতের সংকটে দিনের প্রায় অর্ধেক সময় তাদের কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন কমছে। রপ্তানির ক্রয়াদেশও কমে যাচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তা বাড়ছে কর্মসংস্থান নিয়ে। ব্যবসায়ী নেতারা এখন চান প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ। প্রয়োজনে দ্রুত তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে সরকারকে শিল্প-কারখানায় সরবরাহ করতে হবে। আবার কেউ বলছেন বাসাবাড়ি, সার কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে। ব্যবসায়ীদের এসব প্রস্তাব শুনে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী কোনো আশ্বাস দিতে পারেননি। বরং বলেছেন, দেশে রিজার্ভের বর্তমান যে অবস্থা, তাতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা সম্ভব নয়। আবার কৃষি উৎপাদন ঠিক রাখতে সার কারখানাতেও গ্যাসের সরবরাহ কমানো সম্ভব নয়। এ অবস্থায় উপদেষ্টার সমাধান হচ্ছে-সবাই মিলে শপথ করে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ রাখা।

দিনের বেলা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকলে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অফিস-আদালতের কাজকর্ম চালানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। সুতরাং দিনের বেলা বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকলে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পাবে। প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত দুবার বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশেও খাদ্য সংকট হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা হলো ‘দুর্ভিক্ষ’। দুর্ভিক্ষের কথা উঠলে মনে পড়ে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের কথা। ঔপনিবেশিক শাসনামল এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ অনেক দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়েছে। বলা যায়, বাংলাদেশও একটি দুর্ভিক্ষপ্রবণ দেশ। নীতি-নির্ধারণে দুর্বলতা দুর্ভিক্ষ ডেকে এনেছে। এখন বিদ্যুৎ সমস্যার মোকাবিলা করতে গিয়ে মাথায় রাখতে হবে দুর্ভিক্ষের মহাবিপর্যয়ের ঝুঁকিটি।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

জ্বালানি .

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম