|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পূর্ণতা লাভ করে আত্মার মুক্তির উপায়কে যোগ বলে। যোগ শব্দটি ব্যাপকভাবে পরিচিত। সনাতন ধর্মের অন্যতম দুটি প্রধান স্তম্ভ সাংখ্য দর্শন এবং বেদান্ত উভয় মতই যোগকে সমর্থন করে। চার হাজার বছরেরও বেশি আগে ঋষি পতঞ্জলি এ যোগ আবিষ্কার করেন। পাতঞ্জল দর্শন সাংখ্যমতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সাংখ্যমতের প্রণেতা মহর্ষী কপিল এবং পাতঞ্জল দর্শনের প্রণেতা ঋষি পতঞ্জলি। পাতঞ্জল দর্শনকে পাতঞ্জল-সূত্র নামে অভিহিত করা হয়।
আত্মা মাত্রই অব্যক্ত ব্রহ্ম। বাহ্য ও আন্তঃপ্রকৃতি বশীভূত করে আত্মার এ ব্রহ্মভাব ব্যক্ত করাই জীবনের চরম লক্ষ্য। কর্ম, উপাসনা, মনঃসংযোগ অথবা জ্ঞান- এদের মধ্যে এক, একাধিক বা সব উপায়ের দ্বারা নিজের ব্রহ্মভাব ব্যক্ত করো ও মুক্ত হও- এটিই ধর্মের পূর্ণাঙ্গ সত্য। মতবাদ, অনুষ্ঠান পদ্ধতি, শাস্ত্র, মন্দির বা অন্য বাহ্য ক্রিয়াকলাপ এর গৌণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাত্র।
ধর্ম প্রত্যক্ষানুভূতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সব ধর্মাচার্যই ঈশ্বরকে দর্শন করেছেন। তারা প্রত্যেকেই আত্মদর্শন করেছেন। সবাই নিজ নিজ ভবিষ্যৎ দেখেছেন এবং অনন্ত স্বরূপ অবগত হয়েছেন। প্রত্যক্ষানুভূতি ছাড়া কেউই ধার্মিক হতে পারে না। যে বিজ্ঞানের দ্বারা এসব অনুভূতি হয় তার নাম যোগ।
যোগাগ্নি মানবের পাপ পিঞ্জরকে দগ্ধ করে, তখন চিত্তশুদ্ধি হয় এবং সাক্ষাৎ নির্বাণ লাভ হয়। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কার্যকে যোগী নিজ কর্তব্য বলে মনে করেন। যোগী অধিক বিলাসিতা ও কঠোরতা দুই-ই পরিত্যাগ করবেন। অতিভোজনকারী, একান্ত উপবাসী, অধিক জাগরণকারী, অধিক নিদ্রালু, অতিরিক্ত কর্মপরায়ণ অথবা একেবারে নিষ্কর্মা- এদের কেউই যোগী হতে পারেন না।
আমরা জানি শরীর হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলেও চরমে সেই একই গতি। যেসব শক্তিতে দেহ বিধৃত রয়েছে, সেগুলো অপসৃত হলে দেহ থাকবে না। একমুহূর্তের জন্যও শরীরের পরিবর্তন নিবারণ করতে কেউই সমর্থ হয় না। শরীর আসলে কতগুলো পরিবর্তনের পরম্পরামাত্র। নদীর জলরাশি প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে, নতুন জলরাশি আসছে; কিন্তু দেখতে ঠিক আগের মতো। এ শরীরও তদ্রূপ। তথাপি শরীরকে সুস্থ ও বলিষ্ঠ রাখা আবশ্যক। কারণ শরীরের সাহায্যেই আমরা জ্ঞান লাভ করতে হবে। শরীরই আমাদের শ্রেষ্ঠ যন্ত্র। বিশ্বজগতে এ মানবদেহই শ্রেষ্ঠ দেহ এবং মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব।
যোগ প্রধানত দুই প্রকার। একটিকে বলে অভাব যোগ এবং অন্যটিকে বলে মহাযোগ। যখন নিজেকে শূন্য ও সর্বপ্রকার গুণবিরহিতরূপে চিন্তা করা যায় তখন তাকে অভাব যোগ বলে। যে জোগে আত্মাকে আনন্দপূর্ণ, পবিত্র ও ব্রহ্মার সঙ্গে অভিন্নরূপে চিন্তা করা হয় তাকে মহাযোগ বলে। যোগী প্রতিটির সাহায্যেই আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করেন। এই মহাযোগে যোগী নিজেকে ও সমূদয় জগৎকে ঈশ্বররূপে অনুভবন করেন। এটিই সব যোগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এটিই রাজযোগ। এ ছাড়াও হঠযোগ, জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ধ্যানযোগ, ভক্তিযোগ ইত্যাদি যোগ আছে।
হঠযোগ মূলত কতগুলো আসনের সমষ্টি। আসন সংখ্যা অসংখ্য হলেও যোগীরা ৭০টি আসনকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বর্ণনা করেন। আসনগুলো আবার দু’ভাগে বিভক্ত। ধ্যানাসন ও স্বাস্থ্যাসন। যোগীকে নিয়মিতভাবে কতগুলো শারীরিক ও মানসিক প্রক্রিয়া পরপর অভ্যাস করতে হয়। দীর্ঘসময় একভাবে বসে থাকতে পারা যায় এমন একটি আসন অভ্যাস করা যোগীদের জন্য প্রয়োজন। ধ্যানাসনগুলোর মধ্যে পদ্মাসন, গোমুখাসন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। হঠযোগ কেবল স্থূল দেহ নিয়ে ব্যস্ত। এর উদ্দেশ্য কেবল স্থূল দেহকে সবল রাখা। মানুষকে দীর্ঘজীবী করাই হঠযোগের উদ্দেশ্য। স্বাস্থ্যই মুখ্য ভাব, এটিই হঠযোগীদের একমাত্র লক্ষ্য। আমার যেন পীড়া না হয় এটিই হঠযোগীর দৃঢ় সংকল্প। তার পীড়া হয় না, তিনি দীর্ঘজীবী হন। শতবর্ষ জীবিত থাকা তার পক্ষে কিছুই নয়। দেড়শ’ বছর বয়সে তিনি পূর্ণ যুবা ও সতেজ থাকেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। বটবৃক্ষও কখনও কখনও পাঁচ হাজার বছর জীবিত থাকে, কিন্তু তা বটবৃক্ষই থেকে যায়, এর বেশি কিছু নয়।
রাজযোগের সঙ্গে দেহতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সর্ম্পক আছে। মানুষের দেহ অস্থিরূপ স্তম্ভের ওপর বিধৃত, স্বায়ুরূপ রজ্জুর দ্বারা বদ্ধ, রক্ত ও মাংসের দ্বারা প্রলিপ্ত, চামড়ার দ্বারা আচ্ছাদিত, মূত্র ও বিষ্ঠার দ্বারা পূর্ণ ও দুর্গন্ধযুক্ত। দেহটি আবার জরা ও শোকে আক্রান্ত, নানারকম ব্যাধির আধার, ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর, রজোগুণাসক্ত, অনিত্য এবং ভূতের বাড়ির মতো। এসব জেনে ভূতের বাড়ির মায়া পরিত্যাগ করা উচিত। যাতে পুনরায় এই দেহরূপ ভূতাগারে প্রবেশ করতে না হয় এজন্য মানুষকে চেষ্টা করা উচিত। আমাদের দেহে বাহাত্তর হাজার নাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুর্মা প্রধান। যোগসাধনকালে নানারকম কাজ শরীরের ভেতর চলতে থাকে। এর অধিকাংশই মেরুদণ্ডের ভেতর এবং সুষুর্মা নাড়ির মধ্যে হয়ে থাকে। ইড়া (চন্দ্র নাড়ি) মেরুদণ্ডের বামে এবং পিঙ্গলা (সূর্য নাড়ি) মেরুদণ্ডের ডানে অবস্থিত এবং সুষুর্মা নাড়ি মেরুদণ্ডের মাঝখানে অবস্থিত। ইড়া ও পিঙ্গলা আজ্ঞাবাহী নাড়ি এবং সব মেরুদণ্ড প্রাণীতেই এর কার্যকারিতা রয়েছে এবং মস্তিষ্কের আদেশে দেহ এর মাধ্যমেই কাজ করে।
মেরুদণ্ডের মাঝখানে সুষুর্মা নাড়ির অবস্থান এবং মেরুদণ্ডী প্রাণীর দেহেই এর অস্তিত্ব রয়েছে। মেরুদণ্ডের নিুাংশের সামান্য নিচে কুলকুণ্ডলিনী বা মূলাধারের অবস্থান এবং দেহের শক্তির কেন্দ্র এ মূলাধার। সাধারণ মানুষের এ সুষুর্মা নাড়ির কোনো কার্যকারিতা নেই এবং এর নিুাংশ বদ্ধ থাকে। যোগীরা যোগ সাধনের দ্বারা সুষুর্মার নিুাংশ খুল ফেলেন এবং শক্তি-ঊর্ধ্বমুখে চালিত করেন। মূলাধার থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত ৭টি চক্র রয়েছে। সর্বনিম্ন ১. মূলাধার চক্র, ২. স্বাধিষ্ঠান চক্র, ৩. মনিপুর চক্র, ৪. অনাহত চক্র, ৫. বিশুদ্ধ চক্র, ৬. আজ্ঞা চক্র এবং ৭. মস্তিষ্কে সহস দল চক্র। নিুভূমি মূলাধার চক্র থেকে মস্তিষ্কে সহস দলে পৌঁছলে পাশবিক শক্তি ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়। এ ওজঃশক্তিই মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচায়ক। মানুষের জ্যোতির্ময় দেহের কারণও এ ওজঃশক্তি। কুণ্ডলিনী জাগ্রত করাই দিব্যজ্ঞান, জ্ঞানাতীত অনুভূতি বা আত্মানুভূতি লাভের একমাত্র উপায়। কারও ভগবৎপ্রেমে, কারও সিদ্ধ মহাপুরুষের কৃপায় আবার কারও সূক্ষ্ম জ্ঞান বিচার দ্বারা কুণ্ডলিনী জাগরিত হয়।
আমাদের জীবনের চরম লক্ষ্য আত্মার সাক্ষাৎ উপলদ্ধি করা। আমাদের বিভিন্ন সংস্কার আত্মার স্বরূপকে আবৃত করার ফলে আমরা আত্মার প্রকৃত স্বরূপ অনুভব করতে পারি না। চিত্তহৃদে যতক্ষণ একটি তরঙ্গও থাকবে, ততক্ষণ আত্মার প্রকৃত স্বরূপ অনুভব হবে না। একটি তরঙ্গ এমনভাবে প্রবল করতে হবে যাতে অপর তরঙ্গগুলো একবারে তাতে লুপ্ত হয়ে যায়। যখন একটি মাত্র তরঙ্গ অবশিষ্ট থাকে তখন তাকে দমন করা সহজ হবে। যখন তাও চলে যাবে, তখন সে সমাধিকে নির্জীব সমাধি বলে। তখন আত্মা নিজ স্বরূপে নিজ মহিমায় অবস্থান করবে। আমরা তখনই জানতে পারব আত্মা মিশ্র বা যৌগিক পদার্থ নয়, আত্মাই জগতে একমাত্র নিত্য অমিশ্র মৌলিক পদার্থ। সুতরাং আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, আত্মা অমর, অবিনশ্বর, নিত্য, চৈতন্যময় সত্যস্বরূপ।
ভারতীয় দার্শনিকরা মনে করেন সমগ্র জগৎ দুটি উপাদানে গঠিত। এর একটির নাম আকাশ এবং অপরটির নাম প্রাণ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তু এ আকাশ থেকে উৎপন্ন এবং যাবতীয় শক্তি প্রাণ থেকে উৎপন্ন হয়। কল্পান্তে সব বস্তু এ আকাশে এবং সমস্ত শক্তি প্রাণে লয় হয়। সৃষ্টির শুরুতে আকাশের ওপর প্রাণের আঘাতে জগতের সব বস্তু ও শক্তির উৎপন্ন হয়। এ প্রাণকে নিয়ন্ত্রণ করাই প্রাণায়ামের একমাত্র উদ্দেশ্য। যে শক্তিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রাণস্বরূপ তাকে প্রাণ বলে।
মহাসমুদ্রের একটি বুঁদবুঁদও মহাসমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত। সংসারের সামান্য ব্যক্তিও সেই অনন্ত শক্তির সঙ্গে সংযুক্ত। এ মহাসমুদ্রে জীবমাত্রই জন্মগত অধিকার। যেখানেই জীবনীশক্তির প্রকাশ, সেখানেই পশ্চাতে অনন্ত শক্তির ভাণ্ডার রয়েছে।
যে কেন্দ্রে সংবেদনগুলোর সংস্কারসমষ্টি অবশিষ্ট থাকে তাকে মূলাধার বলে বলে এবং ওই কুণ্ডলীকৃত ক্রিয়াশক্তিকে কুণ্ডলিনী বলে। যখন এ কুণ্ডলিনী শক্তিকে জ্ঞাতসারে সুষুর্মা নাড়ির ভেতর দিয়ে নেয়া যায় তখন তা এক কেন্দ্রের পর আরেক কেন্দ্রের ওপর ক্রিয়া করবে, অমনি প্রবল প্রতিক্রিয়া উৎপত্তি হবে। যখন দীর্ঘকাল সঞ্চিত বিপুল শক্তিপুঞ্জ তীব্র ধ্যানের শক্তিতে সুষুর্মামার্গ অতিক্রম করে তখন যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি। এ অবস্থায় মন জ্ঞানাতীত ভূমিতে আরোহণ করেছে বলা যায়। শক্তিপুঞ্জ যখন সমুদয় অনুভূতির কেন্দ্রস্বরূপ মস্তিষ্কে গিয়ে উপস্থিত হয় তখন সমুদয় মস্তিষ্ক এবং এর অনুভবসম্পন্ন প্রত্যেক পরমাণু থেকেই যেন প্রতিক্রিয়া হতে থাকে। ফলে মনের একেকটি স্তর উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং তখন যোগী জগতের সূক্ষ্ম বা কারণাবস্থাটি উপলব্ধি করতে পারেন। এভাবেই জগতের সর্ববিষয়ে পূর্ণজ্ঞান হবে।
রাজযোগ অষ্ঠাঙ্গ : ১. যম : যম অর্থাৎ অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (অচৌর্য), ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ; ২. নিয়ম : শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় (আধ্যাত্মশাস্ত্র পাঠ) এবং ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ; ৩. আসন : দীর্ঘসময় একভাবে বসে থাকার জন্য নির্ধারিত ধ্যানাসন যেমন- পদ্মাসন, গোমুখাসন ইত্যাদি; ৪. প্রাণায়াম : শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা করাই প্রাণায়াম। শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের শরীরের শক্তির মূল জোগানদাতা এবং শক্তিকে নিয়মিত করে। প্রাণায়ামের ক্রিয়া তিন প্রকার, যেমন- ক. রেচক : শ্বাস দেহের বাইরে নেয়া অর্থাৎ নিঃশ্বাসকে রেচক বলে। খ. শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে বাইরের বাতাস দ্বারা দেহকে পূর্ণ করাকে পূরক বলে। গ. কুম্ভক : শ্বাস দেহের মধ্যে বা বাইরে আবদ্ধ করাকে কুম্ভক বলে। উপযুক্ত গুরু না থাকলে এবং গৃহীদের জন্য কুম্ভক নিষিদ্ধ। অনেকে মনে করেন প্রাণায়াম শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। প্রাণায়াম মূলত প্রাণের সংযম। প্রাণায়াম ফুসফুসের ক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। শ্বাস-প্রশ্বাস দেহযন্ত্রের গতি নিয়ামক মূলচক্র। প্রাণ আমাদের শরীরযন্ত্রকে চালায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসই প্রাণশক্তির প্রত্যক্ষ প্রকাশ।
শচীন্দ্র নাথ হালদার : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ; যোগ ও প্রাণায়াম অনুশীলনকারী
snathhalder@yahoo.com
