Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কাতার প্রবাসীদের স্বপ্ন এবং দেশের উন্নয়ন

Icon

ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ও মো. জসীম উদ্দিন

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কাতার প্রবাসীদের স্বপ্ন এবং দেশের উন্নয়ন

প্রচলিত শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়া বাংলাদেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়ে এসে তাদের দক্ষ জনশক্তি হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) গঠিত হয়।

আর্থিক অসচ্ছলতাসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের অনেক প্রবাসী পরিবার তথা দেশের স্বার্থে জীবিকার প্রয়োজনে দেশে তাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা সমাপ্ত না করেই বিদেশে পাড়ি জমান।

নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে দেশের স্বার্থে শত কষ্ট সহ্য করেও পরিবার থেকে অনেক দূরে থাকেন। শিক্ষাবঞ্চিত এ প্রবাসীদের জন্য বাউবি শিক্ষা কার্যক্রম আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার ফলে যে কোনো বয়সে ঝরে পড়া অথবা কর্মজীবী শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছেন। কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা অর্জনের অধরা স্বপ্ন প্রবাসীদের সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়।

প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই বিশ্বে শিক্ষার অভাবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের কর্মস্থলে তথা সমাজে বিভিন্নভাবে অবমূল্যায়িত হচ্ছেন। অন্যান্য দেশের দক্ষ, শিক্ষিত কর্মীদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করে যেতে পারছেন না। উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা গেলে এ প্রবাসীরাই হয়ে উঠবেন বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেলে প্রবাসীরা নিজ নিজ কর্মস্থলে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়িত হওয়ার সুযোগ পাবেন, শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের মননশীলতা, সৌন্দর্যবোধ ও মানবিক সহমর্মিতা বিকাশের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে ওঠার সুযোগ পাবেন।

এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের এ যুগে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আর্থ-সামাজিক কাজে দক্ষতা অর্জন করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারবেন।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনায় সবার জন্য শিক্ষার গুরুত্ব ফুটে উঠেছিল, যা তার সাম্যবাদী চিন্তা থেকে উৎসারিত। তার রাজনৈতিক দর্শনে ধনী, গরিব, শ্রেণি, পেশা নির্বিশেষে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি সবসময় গুরুত্ব পেয়েছে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন শিক্ষা কাঠামোর ভিত্তিতে দেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন-কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়।

একটি বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক, যুগোপযোগী ও বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা গঠনে বঙ্গবন্ধু সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন-যেখানে সাধারণ, কারিগরি, বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন, সহজলভ্য শিক্ষাব্যবস্থায় সবাই শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে।

২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইন্টারন্যাশনাল একাডেমিক উইং’ গঠন করে, যার উদ্দেশ্য শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। এই লক্ষ্য অর্জনে নিশ-২ নামে বহিঃবাংলাদেশ প্রোগ্রামের আওতায় পৃথিবীর নানা দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে বাউবি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের আয়ের ভূমিকা অপরিসীম।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা শ্রম ভাবনা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রবাসীবান্ধব নীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এবং যেসব প্রবাসী ভাই ও বোনেরা কঠোর পরিশ্রম করে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত তৈরি করছে, তাদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাউবি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসএসসি, এইচএসসি ও বিএ/বিএসএস প্রোগ্রামের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে।

এরই ধারাবাহিকতায় কাতারের দোহায় বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে বাউবি’র সহযোগিতায় সেদেশে ২০২০ সালে এসএসসি ও এইচএসসি প্রোগ্রামের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় এবং উভয় প্রোগ্রামে যথাক্রমে ৫০ জন ও ১১০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। ১৭ মার্চ ২০২১, জাতির পিতার জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে বাউবি’র নিশ-২ কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত এসএসসি ও এইচএসসি প্রোগ্রামের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্যায়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক প্রোগ্রাম প্রবাসীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি প্রবাসী দূরশিক্ষণ প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পায়। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের ৫১তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ প্রবাসীদের জন্য স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত হয়।

দূরশিক্ষণ এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে যে কোনো বয়স, শ্রেণি ও পেশার মানুষ ঘরে বসে প্রযুক্তি তথা গণমাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পায়। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষাপ্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ ও গণমাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে উভয়মুখী যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইতোমধ্যে সারা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশেও টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে শিক্ষাব্যবস্থায়ও এসেছে আমূল পরিবর্তন। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণে সহযোগিতার জন্য রয়েছে BOUTube, WEB Radio, WEB TV, e-book, Mobile appsmn পূর্ণাঙ্গ মিডিয়া সেন্টার। এখানে ক্লাসে উপস্থিত থেকে শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে অনলাইনে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। কাতার তথ্যপ্রযুক্তি খাতে খুব উন্নত একটি দেশ। এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোতেও দূরশিক্ষণ ও শিক্ষাপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষা প্রদান করা হয়। টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির এ সুবিধা নিয়েই কাতারস্থ প্রবাসী বাংলাদেশিরা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে শিক্ষা অর্জন করে তাদের অধরা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দান করার সুযোগ পাচ্ছেন।

তথ্যপ্রযুক্তি ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়ায় কাতারে দক্ষ জনশক্তির অনেক চাহিদা রয়েছে। কাতার তাদের শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ‘World Innovation Summit on Education’ শীর্ষক দ্বিবার্ষিক শিক্ষা সম্মেলন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে এখানে উন্নতমানের হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ পর্যটনের বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। এছাড়াও সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের এ দেশটি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও রাজনীতিতে খুব তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে উন্নত অর্থনীতি ছাড়াও দেশটি তথ্যপ্রযুক্তি ও উন্নত শিক্ষার একটি হাব-এ পরিণত হয়েছে, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২২ আগস্ট (২০২২) কাতার ও বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা পর্যায়ে এবং দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনায় কাতার বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে কাতারে প্রবাসী শ্রমিকদের শিক্ষিত করার পাশাপাশি যদি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা যায়, তাহলে কাতারে ক্রমবর্ধমান দক্ষ জনশক্তির বাজার সুবিধা বাংলাদেশ সহজেই নিতে পারবে। কাতারের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। কাতার বিশ্ববিদ্যালয় ও এদেশের অন্যান্য স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি করে এ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করা যায়। এর ফলে বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাতারের শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর কাতারে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দ্বিতীয় সভায় কাতারের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে শিক্ষা মেলা আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ ধরনের মেলার মাধ্যমে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা কাতারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অধ্যয়নে উৎসাহিত হবে।

কাতারে বর্তমানে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি মানুষের বসবাস, যাদের অধিকাংশই নির্মাণ শ্রমিক এবং শিক্ষাগত যোগ্যতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাবে এসব বাংলাদেশি তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রেও অন্যান্য দেশের কর্মীদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করে তারা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়িত হওয়ার সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি লেখাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে পারবেন এবং কাতারে নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সক্ষম হবেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম চালিকাশক্তি। শিক্ষিত ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশিরা আরও অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠাতে সক্ষম হবেন, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে সহায়ক হবে এবং ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা রাখবে।

ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

মো. জসীম উদ্দিন, এনডিসি : কাতারে বাংলাদেশের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রদূত, বর্তমানে চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।

 

পরবার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম