কিছুমিছু
হৃদয় ভেঙেছে ফুটবল বিশ্বকাপ
মোকাম্মেল হোসেন
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ছবদান খান অবাক হলেন। তিনি ‘বাটন ফোন’ ব্যবহার করেন। এজাতীয় ফোনসেট দিয়ে ‘সেলফি’ তোলা অসম্ভব।
অথচ তিনি ফুটবল বিশ্বকাপের ট্রফির পাশে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে একের পর এক ‘সেলফি’ তুলে যাচ্ছেন-হাউ ইট পসেবল?
‘সেলফি-যজ্ঞের’ মধ্যেই আরও আচানক ঘটনা ঘটল, যাকে বলা যেতে পারে সেরের ওপরে সোয়া সের। এ ধরনের ঘটনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না ছবদর খান। তিনি দেখলেন, স্বয়ং কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি তার গায়ে স্বর্ণখচিত আলখেল্লা পরিয়ে দিচ্ছেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় ছবদার খান ‘হায় আল্লাহ তুমি সোবহান’ বলে ঢোক গিললেন। এসব কী ঘটছে? ঘটনাস্থল যদি কাতার না বাগদাদ নগরী হতো, তাহলে ধরে নেওয়া যেত-‘আরব্য রজনী’র কোনো এক অধ্যায়ের চরিত্র হয়ে গেছেন তিনি।
কিন্তু এটা তো ইরাকের রাজধানী বাগদাদ নয়; কাতারের রাজধানী দোহা। আচ্ছা, দোহা কি কখনো বাগদাদের অংশ ছিল? বিষয়টি জানা নেই ছবদর খানের। যদি এ মুহূর্তে তার হাতে স্মার্টফোন থাকত, তাহলে অবশ্য গুগলে ঢু মেরে এক লহমায় জেনে নেওয়া যেত এবং সত্যি সত্যি বাগদাদের সঙ্গে দোহার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে ঘটনার একটা যোগসূত্র পাওয়া যেত। কিন্তু এখন তিনি করবেন? কিছু একটা করা দরকার। ছবদর খান করমর্দন করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দন শেষে ছবদর খানের জন্য আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল। ট্রফিটা আমির হাতে নিলেন এবং মারহাবা-মারহাবা আওয়াজ তুলে ছবদর খানের হাতে তুলে দিলেন। ছবদর খানের তখন বেহুঁশ হওয়ার মতো অবস্থা। তিনি কোনোমতে উচ্চারণ করলেন-
: মহামান্য আমির সাব! ট্রফি তো আর্জেন্টিনার। এই বস্তু আমার হাতে দিতেছেন কীজন্য!
ছবদর খানের কথা শুনে কাতারের আমির মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন-
: ইয়া হাবিবি; যেহনুকা কাললুন জিদ্দান (হে বন্ধু! আপনার স্মরণশক্তি দেখছি খুবই কম)। আপনি কী করে বিস্মৃত হলেন-এবারের ফুটবল বিশ্বকাপে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে?
এ কথার পর আমির তার পকেট থেকে সোনালি রঙের আইফোন বের করে ছবদর খানকে একটা ভিডিও দেখতে দিলেন। আরে সর্বনাশ! ভিডিও দেখা যাচ্ছে-বাংলাদেশ ফুটবল টিম ফাইনাল খেলছে; যে খেলায় বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে অধিনায়কত্ব করছেন ছবদর খান নিজে। শুধু তাই নয়; ছবদর খান অন্য খেলোয়াড়কে দিয়ে গোল তো করালেনই; উপরন্তু তিনি নিজে একে একে তিন গোল দিয়ে হ্যাট্রিক করলেন। শেষ গোলটা করার পর মাঠভর্তি দর্শক এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে, সেই শব্দে ছবদর খানের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও স্বপ্নের ঘোরে অনেকক্ষণ আবিষ্ট হয়ে রইলেন ছবদর খান। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললেন-
: বাংলাদেশ অবশ্যই একদিন ফুটবল বিশ্বকাপের ট্রফি অর্জন করবে। তবে আফসোস একটাই-ততদিন হয়তো আমি জীবিত থাকব না।
ছবদর খানকে আপন মনে কথা বলতে দেখে আবেদন নেছা প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলল-
: বিড়বিড়ানি বন্ধ কইরা উঠেন।
বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। পুনরায় আবেদন নেছার তাড়া খেয়ে বিষাদমাখা গলায় ছবদর খান বললেন-
: আই অ্যাম অ্যা ম্যান অব ব্রোকেন হার্ট; ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।
ছবদর আলীর কথা শুনে আবেদন নেছা কিছুক্ষণ তেরছা চোখে তাকিয়ে রইল। এপর হেসে বলল-
: বাংলাদেশে নদীভাঙন আর আপনের হৃদয়ভাঙন অতি স্বাভাবিক একটা বিষয়। যতদিন জিন্দেগি আছে, ততদিন মেগা সিরিয়ালের মতন ভাঙনের এ খেলা চলতেই থাকবে। কাজেই এই চাপ্টার ক্লোজ কইরা গো টু কাঁচাবাজার। ঘরে চাল ছাড়া সিদ্ধ করার মতন আর কোনো আইটেম অবশিষ্ট নেই।
আবেদন নেছা তার কথার হুলে যতই বিদ্ধ করুক, হৃদয় ভাঙার নিয়তি থেকে নিস্তার নেই ছবদর খানের। একেকদিন এক-একটা ঘটনার মুখোমুখি কিংবা ভাবনার উদয় হয় ছবদর খানের মনে আর তা শেষ হয় হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই যেমন কয়েকদিন আগে হঠাৎ মনে হলো, বয়স বেড়ে যাচ্ছে। বয়স বেড়ে যাওয়া মানে বুড়া হয়ে যাওয়া; আর বুড়া হয়ে যাওয়া মানেই জীবনের সব রং ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া। বয়স বাড়বে কেন? হোয়াই? ছবদর আলীর এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তখন সেখানে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। উত্তর না পেয়ে প্রথমে সৃষ্টিকর্তার ওপর অভিমান এবং পরে অবধারিতভাবে হৃদয়ভাঙনের শিকার হলেন ছবদর খান।
আজ হৃদয় ভাঙার মূলে রয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপ। ফুটবলের জাদুকরী নেশায় মত্ত হয়ে বিগত এক মাস অতি উত্তম সময় কেটেছে। আগে কোনো কারণে রাত জাগলে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা পাগল করে ফেলত। কিন্তু বিশ্বকাপ চলাকালীন রাত জেগে খেলা দেখার সময় তার যে গ্যাস্ট্রিকের ব্যামো আছে, এটা টেরই পাননি ছবদার খান। শুধু তাই নয়, আগে বাজারে যাওয়া মানেই হচ্ছে দোকানদারের সঙ্গে ঝগড়া অবধারিত। পনেরো টাকা কেজির আলু কেন ত্রিশ টাকা, সত্তর টাকা কেজির চিনি কেন একশ এগারো টাকা, ষাট টাকা কেজির রসুন কেন একশ বিশ টাকা ইত্যাদি নিয়ে হররোজ বিবাদ-কথা কাটাকাটি। অথচ গত একমাস জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য নিয়ে চিন্তা করার ফুরসতই মেলেনি। সারাক্ষণ মাথায় গিজগিজ করেছে ফুটবল। ফুটবল যেন হয়ে উঠেছিল কৈশোরের সেই প্রথম ভালোবাসার মানুষ, যে একদিন হারিয়ে গিয়েছিল; হঠাৎ আবার তার খোঁজ পাওয়া গেছে। উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা আর আবেগ সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছিল ফুটবলকে ঘিরে। কিন্তু এত ভালোবাসা, এত আবেগ দিয়েও তাকে ধরে রাখা গেল না। সে চলে গেল। কেন চলে গেল-এই দুঃখেই হৃদয় ভেঙেছে ছবদর খানের।
ভাঙা হৃদয় নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকাটা দোষের কিছু না। তবে মুশকিল একটাই; খালি পেট হৃদয়বৃত্তির এ চর্চা সমর্থন করে না। অতএব আগে উদর পূর্ণ করো। তারপর মন চাইলে গান গাও, বগল বাজাও অথবা দুঃখবিলাসে নিমগ্ন হও। আবেদন নেছা এ কথাটিই ছবদর খানকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাড়া দিল-
: এইবার দয়া কইরা বিছানা ত্যাগ করেন।
: হু।
: হু কী! ঘড়িতে কয়টা বাজে, হুঁশ আছে? এরপর তো বাজারে মাছি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না!
: এই যে উঠতেছি...
: উঠতেছি বইলা বাম কাইত থেইকা ডাইন কাইতে শুইলে আর উঠা হবে না।
: পাঁচ মিনিট সময় দেও। ঘড়ি ধইরা জাস্ট ফাইভ মিনিট। শেষবারের মতো হার্টে একটা প্রলেপ মাইরা লই।
বাজারে যাওয়ার পথে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা। ছবদর খান হাত তুলে সালাম দেওয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন-
: কেমন আছেন?
: এই কয়দিন ভালোই ছিলাম; কিন্তু এখন...
: এখন?
: এখন আর ভালো নাই। শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে আবার সবকিছু আবার আগের মতো হইয়া গেছে। অথচ বিগত এক মাস লোডশেডিং কী জিনিস টের পাই নাই। দাম্পত্য কলহ কী জিনিস বুঝতে পারি নাই। সন্ধ্যার আগেই রাস্তাঘাট সব ফকফকা। জ্যাম-ফ্যামের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। আহ! কী সুখেই না কাটছে গত একটা মাস। এখন বিশ্বকাপের খেলা নাই, সুখও নাই। কী, ঠিক কইলাম কিনা?
: জি। আমি আপনের সঙ্গে শতভাগ সহমত পোষণ করতেছি। ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও হৃদয় ভাঙনের শিকার হইছি।
: কী ভাঙনের শিকার হইছেন?
: হৃদয়। হার্ট।
: হার্টের অসুখ হইছে আপনার?
: জি।
: এখন কী অবস্থা?
: অবস্থা সিরিয়াস।
: ছবদর সাহেব, ডোন্ট মাইন্ড। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে কাইন্ডলি এই মাসের বাড়ি ভাড়াটা দিয়া যাবেন।
এই রে! কী বুঝতে কী বুঝল! ছবদর খান ভাবেন-এটাও ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ হওয়ারই কুফল। খেলা চলাকালীন এমন বৈষয়িক ভাবনা বাড়িওয়ালার মাথায় কিছুতেই আসত না। কিন্তু এখন এসেছে। কারণ, এখন খেলা শেষ।
বাজারে যেতে যেতে ছবদর খানের মনে হলো-বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলাটা যদি সারা বছর চলত, তাহলে খুবই সুবিধা হতো। বাড়িওয়ালারা ভাড়া চাইতে ভুলে যেত। গিন্নিরা ঝগড়া ভুলে যেত। বিদ্যুৎ বিভাগের অভিধান থেকে লোডশেডিং শব্দটা উঠে যেত। তবে সবচেয়ে আরামে থাকতেন শাসকদলের লোকজন। তারা বাংলাদেশের আমজনতার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, জার্মানি-ফ্রান্স নিয়ে মাতামাতি করার সুযোগে বিনা উপদ্রুপে শাসনক্ষমতা অটুট রাখার সুযোগ পেতেন।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
mokamia@hotmail.com
